Sitaram Yechury

দেশ বাঁচাতে হটাও মোদীকে জ্যোতি বসু কেন্দ্রের উদ্বোধনে ইয়েচুরি

রাজ্য

ছবি: শ্যামল মজুমদার

প্রসূন ভট্টাচার্য - কলকাতা 


স্বাধীনতার সময়ে আরএসএস যে কাজ করতে পারেনি ৭৫ বছর পর সেই অধরা লক্ষ্য পূরণ করতে ক্ষমতাসীন বিজেপি দেশের ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক সংবিধানকে ধ্বংস করছে বলে সতর্ক করলেন সিপিআই(এম)’র সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি। বুধবার জ্যোতি বসু নগরে (নিউটাউন) জ্যোতি বসু সমাজবিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্রের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত সেমিনারে তিনি বলেছেন, স্বাধীনতার সময় জিন্না যেভাবে ইসলামিক রাষ্ট্র পাকিস্তান চেয়েছিলেন সেভাবেই আরএসএস ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্র করতে চেয়েছিল। আমাদের দেশনেতাদের জন্য তারা তখন সফল হয়নি। আজকে দেশের সরকারে বসে ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক চরিত্র ভেঙে সেই কাজ করতে উদ্যত তারা। এই মুহূর্তের সোজা সত্য হলো, ভারতকে বাঁচাতে হলে এখনই রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে, কেন্দ্রের সরকার থেকে আরএসএস পরিচালিত বিজেপি’কে সরাতে হবে। কোনোমতেই মোদীকে ক্ষমতায় থাকতে দেওয়া চলবে না। 
এদিন জ্যোতি বসুর ১৫তম প্রয়াণ দিবসে জেবিসিএসএসআর’র উদ্যোগে অনুষ্ঠিত ‘দেশের ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্র রক্ষার চ্যালেঞ্জ’ বিষয়ে আলোচনায় সীতারাম ইয়েচুরি এবং সিপিআই(এম)’র রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম অংশ নেন। সভাপতিত্ব করেন জেবিসিএসএসআর’র চেয়ারম্যান বিমান বসু। সেমিনারের পরে ‘জ্যোতি বসু সেন্টার ফর সোশাল স্টাডিজ অ্যান্ড রিসার্চ’ ভবনের শিলান্যাস করেন সীতারাম ইয়েচুরি। 
ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক ভারত গঠনে কমিউনিস্টদের ভূমিকা, জননেতা জ্যোতি বসুর অবদান এবং আজকের দিনে তাঁর শিক্ষার প্রাসঙ্গিকতা বারবার উঠে আসে সেমিনারে বক্তাদের ভাষণে, বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার, উপ মুখ্যমন্ত্রী তেজস্বী যাদব, কেরালার মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়ন, নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়, অর্থনীতিবিদ প্রভাত পট্টনায়েক ও অমিয় বাগচী, বিশিষ্ট সাংবাদিক পি সাইনাথের পাঠানো বার্তায়। ইয়েচুরি বলেছেন, ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক চরিত্রকে মজবুত করে সমাজবাদের পথে অগ্রসর হওয়ার জন্য সারাজীবন সংগ্রাম করেছিলেন জ্যোতি বসু। আজকের ভারত কি সেইদিকে যাচ্ছে? মহম্মদ সেলিম বলেছিলেন, এই জমানায় চারিদিকে দল পালটানো দেখা যায়। জ্যোতি বসু কোনোদিন মত ও পথ পালটাননি। অবিচল এই নেতাকে রাষ্ট্র জেলে পুরেছিল, আর মৃত্যুর পরে গান স্যালুটে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দিয়েছিল। মিথ্যা মামলা আর হামলা সত্ত্বেও মানুষকে পাশে নিয়ে কীভাবে লড়াইতে অবিচল থাকতে হয় তিনি শিখিয়ে দিয়েছেন।
ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রের আদর্শে অবিচল থেকে সেই লড়াইটাই আজকের ভারতের বুকে কেন চূড়ান্ত গুরুত্বপূর্ণ তা ভাষণে ব্যাখ্যা করেছেন সীতারাম ইয়েচুরি। তিনি বলেছেন, আজকের সঙ্কট যে বিপদ থেকে তার সূত্রপাত স্বাধীনতার সময়ে ব্যর্থ আরএসএস’র প্রচেষ্টা থেকে। ধর্মের ভিত্তিতে দেশের চরিত্র নির্ধারণের পক্ষে দৃষ্টিভঙ্গি ছিল মুসলিম লিগ এবং আরএসএস। এরফলেই দেশভাগ, পাঞ্জাব এবং বাংলায় উদ্বাস্তু স্রোত। কিন্তু ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্র করতে আরএসএস ব্যর্থ হয়েছিল কমিউনিস্টদের লড়াই, নেহরুর দৃঢ়তা, অনড় গান্ধীজীর জন্য। আরএসএস’র রাগ তাই এদের ওপরেই, গান্ধীজীকে তারা খুনই করে দিল এই কারণে। 
কিন্তু আজকের ভারতের বিপজ্জনক অবস্থা উল্লেখ করে ইয়েচুরি বলেছেন, পঁচাত্তর বছর ধরে অধরা লক্ষ্য পূরণে, ভারতকে কট্টর হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্রে পরিণত করতে এখন ক্ষমতাসীন বিজেপি সংবিধানের চারটে স্তম্ভকেই ভাঙছে। ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্র, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো, অর্থনৈতিক সার্বভৌমত্ব এবং সামাজিক ন্যায়কে ছারখার করছে। এরজন্যই নয়া ইতিহাস বানাতে বলছে ২২ জানুয়ারি রামমন্দির উদ্বোধনে আসল আজাদি আসবে। 
ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রের মর্মবস্তুকে সোজা কথায় ব্যাখ্যা করে ইয়েচুরি বলেন, এর মানে ভারত সব ধর্মের বিশ্বাসীদের দেশ। কিন্তু আত্মা আর পরমাত্মার পবিত্র সম্পর্ক আত্মাকেই নির্ধারণ করতে দিতে হবে। হিন্দু, মুসলিম, শিখ, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, জৈন এবং আমাদের মতো নাস্তিক, সবার এই অধিকার আছে নিজের উপাস্যকে নির্ধারণের। আমরা কমিউনিস্টরা মানুষের এই ধর্মীয় বিশ্বাসের অধিকারকে ইজ্জত দিই এবং তা রক্ষার জন্য লড়াই করি। কিন্তু সরকারের কোনও ধর্ম হতে পারে না। এই জন্যই আমি রামমন্দিরের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করেছি। 
বাবরি মসজিদ ভাঙার পরে কলকাতায় এসে বিজেপি নেতা ও উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী পদে থাকা কল্যাণ সিং ঠিকাদারের থেকে কম সময়ে মসজিদ ভাঙার কৃতিত্ব দাবি করেছিলেন। ইয়েচুরি বলেন, তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু সেই বক্তব্য রেকর্ড করে লিবেরহান কমিশনে জমা দিয়েছিলেন। মসজিদ ভাঙার পরে সারা দেশে দাঙ্গার সময়ে জ্যোতি বসুর নেতৃত্বে পশ্চিমবঙ্গের সরকার কঠোর হাতে শান্তি বজায় রেখেছিলো, মুসলিমরা পশ্চিমবঙ্গকেই নিরাপদতম মনে করেছিলেন।
সেই অযোধ্যায় রাম মন্দির ঘিরে উন্মাদনা ছড়ানোর মাধ্যমে দেশের রাজনীতির কেন্দ্রে ধর্মকে টেনে আনার চেষ্টা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন মহম্মদ সেলিম। তিনি বলেছেন, সংবিধানকে প্রতিস্থাপিত করা হচ্ছে ধর্মকে দিয়ে। জনজীবনের দুর্দশাকে ‌আড়াল করা হচ্ছে এভাবে। 
জনগণের ওপরে যে আক্রমণকে আড়াল করা হচ্ছে তার উল্লেখ করে ইয়েচুরিও বলেছেন, মোদী ভাইব্র্যান্ট ইন্ডিয়া প্রচার করছে। আর দেশের অর্থনীতিতে বিনিয়োগ ৪৬ শতাংশ কমে গেছে। একবছরে বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ কমেছে ২৫ বিলিয়ন ডলার। মূল্যবৃদ্ধি আর বেকারি চরমে। এসব আড়াল করতে লাভ জিহাদ, গোহত্যা, বুলডোজার রাজনীতি করা হচ্ছে। সরকারের সমালোচনা করলে ইউএপিএ ধারায় জেলে পোরা হচ্ছে। শ্রমিকদের অধিকার কেড়ে, দেশের আত্মনির্ভরতা ধ্বংস করে মিত্র পুঁজিপতিদের মুনাফা লোটার ধান্দার ধনতন্ত্র কায়েম করা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো ভেঙে রাজ্যপালদের দিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ানো হচ্ছে অবিজেপি রাজ্যগুলিতে। ইডি সিবিআই’র অপব্যবহার করে দল বদলে ব্যবহার করা হচ্ছে, সওদাগরি হচ্ছে। প্রকৃত অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে বিরোধীদের হেনস্তা করা হচ্ছে। 
এই রাজনৈতিক পটভূমিতে বাংলার বুকে মাঠে ময়দানের সংগ্রামকে শক্তিশালী করতে সমাজ গবেষণা জাত বস্তুনিষ্ঠ তথ্যের প্রয়োজনীয়তা মেটাতে জ্যোতি বসু সমাজবিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্র ভূমিকা পালন করবে বলে জানিয়েছেন মহম্মদ সেলিম। তিনি সভায় বলেছেন, আমরা কোনো ভাড়াটে সংস্থাকে দিয়ে আন্দোলন সংগ্রাম ও পথ চলার দিশাকে আউটসোর্সিং করি না। একাজের জন্যই আমরা ধাপে ধাপে জ্যোতি বসুর নামাঙ্কিত গবেষণা কেন্দ্র গড়ে তুলবো। ভবন লাইব্রেরি অতিথিশালা ইত্যাদি গড়ে তোলা হবে, সামাজিক অর্থনৈতিক গবেষণার জন্য চিন্তাশীলদের যুক্ত করা হবে। মানুষের কাছ থেকে সংগৃহীত অর্থে এই কাজ করা হচ্ছে। 
তিনি বলেন, মন্দির উদ্বোধনের কথা পূজারীর, সেটা করা হচ্ছে একজন মেগালোমেনিয়াককে দিয়ে। ভবিষ্যতে হয়তো বলা হবে যে ওখানে রাম নয়, মোদীর মূর্তি থাকবে। সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদ দিয়ে সংসদীয় গণতন্ত্রকে ধংস করে প্রধানমন্ত্রীকে দেশের সর্বক্ষমতাসম্পন্ন রাষ্ট্রপ্রধান বানানো হচ্ছে, এরপর ঈশ্বর বানানোর চেষ্টা হবে। ভারতের সংস্কৃতির বহুত্বকে অস্বীকার করে ওরা দেশে অভিন্নতা নামিয়ে আনতে চাইছে। আমরা বামপন্থীরা বহুত্বকে মর্যাদা দিয়ে সমতার কথা বলছি। সমতা আদায়ের লড়াই জোরদার করতে মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে। 
অনুষ্ঠানে জেবিসিএসএসআর’র সাধারণ সম্পাদক রবীন দেব জ্যোতি বসুর নামাঙ্কিত এই কেন্দ্র গড়ে তুলতে অর্থ দান করে এবং নানাভাবে যারা সাহায্য করেছেন তাঁদের সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছেন, গত কয়েক বছরে সাড়ে তিন কোটি টাকা এভাবে সাধারণ মানুষের থেকে সংগৃহীত হয়েছে। আরও সাহায্যের জন্য আমরা সবার কাছে আবেদন করছি। ২০১০ সালের নভেম্বর মাসে এই কেন্দ্র গড়ে তোলার জন্য ট্রাস্ট গঠিত হয়েছে, ২০১১ সালে ট্রাস্ট ৪ কোটি টাকা দেয় বরাদ্দকৃত জমির জন্য। কিন্তু নতুন সরকার আসার পরে বহু বাধা পেরিয়ে শেষপর্যন্ত ২০১৯ সালে বরাদ্দ হওয়া ৫ একর জমি হাতে পাওয়া গেছে। 
আর্থ-সামাজিক রাজনৈতিক পরিবেশ সব দিক থেকে অগ্রগতির লক্ষ্যে ভূমিকা পালন করবে জেবিসিএসএসআর। পরিবেশের প্রতি দায়বদ্ধতা ঘোষণা করে এদিন সভার শুরুতে বৃক্ষরোপণ করেন নেতৃবৃন্দ। উপস্থিত ছিলেন সিপিআই(এম)’র পলিট ব্যুরো সদস্য সূর্য মিশ্র, রামচন্দ্র ডোম, পার্টিনেতা শ্রীদীপ ভট্টাচার্য, আভাস রায়চৌধুরি, গৌতম দেব, রেখা গোস্বামী, সুজন চক্রবর্তী, শমীক লাহিড়ী, সুমিত দে, অঞ্জু কর, সাংসদ বিকাশ ভট্টাচার্য প্রমুখ। প্রাক্তন মুখ্যসচিব অমিতকিরণ দেব এবং মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন জ্যোতি বসুর প্রেস সচিবের দায়িত্ব পালনকারী সরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় সহ বহু বিশিষ্ট ব্যক্তিও এদিনের অনুষ্ঠানে যোগ দেন। ছিলেন বামফ্রন্টের শরিক দলগুলির নেতৃবৃন্দও। সভার শুরুতে সঙ্গীত পরিবেশন করেন ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘের শিল্পীরা, কাজি কামাল নাসের এবং রিয়া, রাহুল, দিগন্ত।

Comments :0

Login to leave a comment