CPI(M) Protest

মোদী সরকারের ইজরায়েলমুখী অবস্থান ভারতবাসীর মনোভাব নয়

জাতীয়

 
অরূপ সেন: নয়াদিল্লি


প্যালেস্তাইনে মার্কিন মদতপুষ্ট ইজরায়েলের ঘৃণ্যতম হামলার ঘটনায় রাষ্ট্রসঙ্ঘের যুব্ধবিরতি প্রস্তাবে ভারতের লজ্জাজনক অনুপস্থিতি কোনোভাবেই ভারতের জনতার মনোভাব নয়। রবিবার নয়াদিল্লিতে এক প্রতিবাদ সভায় এই কথাই জোরের সঙ্গে জানালেন সিপিআই (এম) নেতৃবৃন্দ। সেই সভা থেকেই ভারতের মানুষের অবস্থান দৃঢ়তার সঙ্গে জানিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে উদ্ধৃত করে সিপিআই (এম) সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি বললেন, ‘কণ্ঠে মোর আনো বজ্রবাণী, শিশুঘাতী নারীঘাতী কুৎসিত বীভৎসা পরে ধিক্কার হানিতে পারি যেন’। কেরালার মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়ন বলেছেন, প্যালেস্তাইনের মানুষের ন্যায়সঙ্গত অধিকারে পক্ষে ভারতের মানুষ দৃঢ়তার সঙ্গে আছে। পলিট ব্যুরো সদস্য মহম্মদ সেলিম বলেন, ইহুদি ধর্ম আর জায়োনিজমে পার্থক্য আছে, যেমন হিন্দু ধর্ম আর হিন্দুত্বের মধ্যে ফারাক আছে। প্রতিবাদ সভায় মানিক সরকার, বৃন্দা কারাত বক্তব্য রাখেন। সভায় সভাপতিত্ব করেন বিমান বসু।
প্যালেস্তাইন নিয়ে রাষ্ট্রসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদে ভারতের অবস্থানের তীব্র বিরোধিতা শনিবারই করেছিল সিপিআই (এম) এবং সিপিআই। প্রতিবাদে সিপিআই (এম)’র পক্ষ থেকে রবিবার থেকেই দেশজুড়ে বিক্ষোভের ডাক দেওয়া হয়েছিল। এদিন সিপিআই (এম) কেন্দ্রীয় কমিটির দপ্তর এ কে গোপালন ভবনের সামনে প্রতিবাদ সভা হয়। সভায় সিপিআই (এম) কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সহ দিল্লির পার্টি কর্মীরা উপস্থিত ছিলেন। তাঁদের হাতে হাতে ছিল প্ল্যাকার্ড। প্যালেস্তাইনের মানুষের সংহতির পাশাপাশি কেন্দ্রের মোদী সরকারের আমেরিকার দোসর হওয়ার বিরোধিতাও ছিল সোচ্চারে। 
সিপিআই (এম) সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি প্যালেস্তাইন এবং ইজরায়েল সংঘাতের অতীত, এই ক্ষেত্রে রাষ্ট্রসঙ্ঘের নির্দেশিকার কথা তুলে ধরে বলেন, সেই পথেই সমাধান করতে হবে। কিভাবে ইজরায়েল প্যালেস্তাইনে হামলা চালাচ্ছে, সেখানের হাসপাতালের উপরে বোমা ফেলা হচ্ছে। শিশুদের হত্যা করা হচ্ছে হাজারে হাজারে সেই বিবরণ তুলে ধরেন। নিষ্ঠুরতার কথা বলতে বলতে তাঁর গলা ধরে আসে। তিনি বলেন, ইজরায়েলের এই বর্বরতার পক্ষে আমেরিকা সহ সম্পূর্ণ সাম্রাজ্যবাদী দুনিয়া দাঁড়িয়েছে। এইরকম বর্বরতার বিরুদ্ধেই এক সময়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, শিশুঘাতী নারীঘাতী কুৎসিত বীভৎসা পরে ধিক্কার হানিতে পারি যেন। রবীন্দ্রনাথের সেই জোরালো অবস্থানেই আমাদের এখন ফিরতে হবে ইজরায়েলের হিংসার প্রশ্নে। তিনি বলেন, মানবতাবিরোধী এই ভয়ঙ্কর বর্বরতার পক্ষে সাফাই দেওয়া হচ্ছে যে প্যালেস্তিনীয়দের বিরুদ্ধে নয় এটা হামাসের বিরুদ্ধে লড়াই। যেটা খুবই ছেঁদো যুক্তি বলে তিনি মন্তব্য করেন। সীতারাম ইয়েচুরি ভারত সরকারের আনুষ্ঠানিক অবস্থানের কথা মনে করিয়ে দিয়ে বলেছেন, কার্যক্ষেত্রে সেটা করছে না মোদী সরকার। ভারত সরকারের ঘোষিত অবস্থানের মতই পদক্ষেপ করতে হবে কেন্দ্র সরকারকে, দাবি জানিয়েছেন তিনি। 
সভায় বক্তব্য রাখতে গিয়ে কেরালার মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়ন ইজরায়েলী আগ্রাসনের ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরেন। প্যালেস্তাইনের নিরীহদের হত্যা করা হচ্ছে। মহিলা শিশুদের খুন করা হচ্ছে। ২৭ অক্টোবর পর্যন্ত হিসাব দিয়ে তিনি বলেন, ৭ হাজারের বেশি প্যালেস্তিনীয়কে হত্যা করা হয়েছে। ১৮ হাজারের বেশি জখম। ১৪ লক্ষ প্যালেস্তিনীয়কে উচ্ছেদ করা হয়েছে। মানব সম্পদের এমন ভয়াবহ ক্ষতির পরেও ভারত সরকার রাষ্ট্রসঙ্ঘের যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে অনুপস্থিত রইলো। সারা দুনিয়া থেকে এই দাবি ওঠার পরেও ভারতে সেই দাবিকে সমর্থন জানালো না। তিনি বলেন, ভারতের বামপন্থীরা চিরকাল প্যালেস্তিনীয়দের পাশে দাঁড়িয়েছে। এখনও দৃঢ়ভাবে তাদের ন্যায়সঙ্গত অধিকারের পাশে আছে এদেশের বামপন্থীরা।  
সিপিআই (এম) পলিট ব্যুরো সদস্য এবং পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম রাষ্ট্রসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদে ভোটাভুটিতে ভারত সরকারের অনুপস্থিতির প্রশ্নে বলেন, এতদিন পর্যন্ত আমাদের অবস্থান ছিল যুদ্ধের বিরুদ্ধে। কারণ যুদ্ধ কোনো সমাধান নয়। প্যালেস্তাইনে তো কোনো যুদ্ধও হচ্ছে না। সেখানে ইজরায়েল একতরফা, টার্গেটেট হামলা করছে, গণহত্যা হচ্ছে। নাহলে হাসপাতাল, চিকিৎসক, চিকিৎসা কর্মীদের উপরে হামলা করা হয়? প্রশ্ন তোলেন তিনি। মহাভারতের যুদ্ধের বর্ণনার প্রসঙ্গ উল্লেখ করে তিনি বলেন, সেই সময়েও তো যুদ্ধের কিছু নিয়ম ছিল। সূর্যাস্তের পরে যুদ্ধ হতো না। আর আজ সভ্য দুনিয়ায় কোনোরকম নিয়ম কানুন না মেনে নৃশংস বর্বর হামলা চলাচ্ছে ইজরায়েল। আর এতদিন পর্যন্ত দুনিয়াতে ভারতের যে অবস্থান ছিল, সম্মান ছিল তাকে জলাঞ্জলি দিয়ে ভারত সরকার রাষ্ট্রসঙ্ঘে গিয়ে অবস্থান নিতে পারলো না যুদ্ধবিরতির পক্ষে। আমেরিকার চাপ আর ইজরায়েলের সঙ্গে বন্ধুত্বের কারণেই মোদী সরকার এই অবস্থান নিচ্ছে বলে তিনি অভিযোগ করেন। বিজেপি’কে তীব্র কটাক্ষ করে তিনি বলেন, হোয়াটসঅ্যাপে এরা বলে বেড়াচ্ছে ইউক্রেন যুদ্ধের সমাধান করছেন মোদী। দুনিয়ার সব সমস্যার সমাধান নাকি নাগপুর থেকে হচ্ছে! আর প্যালেস্তাইনে ইজরায়েলের হামলা রুখতে যুদ্ধবিরোধী অবস্থান নিতে পারলো না ভারত। 
পাশাপাশি প্যালেস্তাইনে ইজরায়েলের হামলাকে ঘিরে সোশাল মিডিয়াকে যেভাবে ব্যবহার করে হিন্দুত্ববাদীরা মুসলিম বিরোধী জিগির তুলছে তার কড়া সমালোচনা করেন সেলিম। তিনি বলেন, এই প্রশ্নেও হিন্দু-মুসলমান করা হচ্ছে। প্যালেস্তাইনে কি হিন্দু আছে? দুনিয়াজুড়ে লুট অব্যাহত রাখতে ধর্মকে ব্যবহার করা হয়, এখানেও তাই হচ্ছে। গত পনেরোদিন ধরে জিনিসের দাম বৃদ্ধি, বেকারির হার বৃদ্ধি এইসব বাদ দিয়ে সোশাল মিডিয়ায় ইজরায়েলের সমর্থনে ধুয়ো তোলা হচ্ছে। সেলিম ব্যাখ্যা করে বলেন, ইহুদি ধর্ম আর জায়োনিজমে পার্থক্য আছে, যেমন হিন্দু ধর্ম আর হিন্দুদের মধ্যে ফারাক আছে। এটা ধর্মযুদ্ধ নয়, ইজরায়েল যে হামলা চালাচ্ছে তার সঙ্গে ধর্মের কোনও সম্পর্ক নেই। দুনিয়ার বহু জায়গায় হাজার হাজার ইহুদিও ইজরায়েলের হামলার বিরোধিতা করে পথে নেমেছে। আর মোদী সরকারের রাষ্ট্রসঙ্ঘে গিয়ে পা টলে গেল। ভারতের সভ্যতা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, সংবিধান মোদী সরকারের এই অবস্থানের অনুমতি দেয় না। 
মানিক সরকার বলেন, রাষ্ট্রসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদে ১৪০টা দেশ যুদ্ধবিরতির পক্ষে মত দিল। প্যালেস্তাইনের মানুষকে রক্ষার পক্ষে মত দিল। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ সহ কিছু দেশ বিরোধিতা করলো। সেখানে ভারত সরকারের অবস্থান লজ্জাজনক, বিস্ময়কর। এই সিদ্ধান্ত বিজেপি নেতৃত্বাধীন সরকারের, যার পিছনে আরএসএস’র মতো ফ্যাসিস্ত শক্তি আছে। কিন্তু এই সিদ্ধান্ত ভারতের জনতার নয়। ভারতের মানুষ সরকারের এই সিদ্ধান্ত মানেন না। স্বাধীনতার সময় থেকে ভারতের মানুষ যে স্বাধীনতা, শান্তি এবং গণতন্ত্রের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। আমরা বামপন্থীরা মোদী সরকারের এই অবস্থানকে খারিজ করছি এবং তীব্র নিন্দা করছি। দেশের বিভিন্ন অংশের মানুষ ইজরায়েলের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্যালেস্তিনীয় জনগণের অধিকারের পক্ষে মানুষ পথে নামছে। আমরা এই প্রতিবাদকে এগিয়ে নিয়ে যাব। তিনি আরও বেশি সংখ্যায় জনগণকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। 
প্রতিবাদ সভায় বৃন্দা কারাত মোদী সরকারের অবস্থানের কড়া সমালোচনা করে বলেন, আমেরিকার অধস্তন সঙ্গীর মতো আচরণ করছে কেন্দ্র সরকার। সরকারের মনে রাখা প্রয়োজন ভারত সরকারের এই সিদ্ধান্তকে কোনোভাবেই দেশের মানুষ সমর্থন করে না। হামাসের অজুহাত দিয়ে ইজরায়েল প্যালেস্তাইনের জনগণের উপরে হামলা করছে। এটা একটা নির্লজ্জ মিথ্যাচার। আর ভারত সরকার সেই মিথ্যার শরিক হয়েছে।  
 

Comments :0

Login to leave a comment