DA MAMATA

ডিএ ‘একস্ট্রা’ ৪ শতাংশ ঘোষণা, তবু বকেয়া ৩৬%

রাজ্য

 

বেতনের বাইরে ডিএ রাজ্যের সরকারি কর্মচারীদের ‘অতিরিক্ত’ জানিয়ে ৪ শতাংশ মহার্ঘভাতা ঘোষণা করলেন মুখ্যমন্ত্রী!
বৃহস্পতিবার পার্কস্ট্রিটে বড়দিনের উৎসব উদ্বোধন করতে গিয়ে আগামী ২০২৪ সালের জন্য রাজ্যের কোষাগার থেকে বেতন প্রাপক কর্মচারী, শিক্ষকদের ডিএ’র ঘোষণা করেন মমতা ব্যানার্জি। সেই অনুষ্ঠানেই কর্মচারীদের উদ্দেশ্যে মমতা ব্যানার্জি বলেছেন, ‘‘২০১১ থেকে ১৯ সাল পর্যন্ত কম টাকা দেওয়া হয়নি। আমাদের রাজ্যে পে কমিশন আছে। এটা (ডিএ) আমরা এক্সট্রা (অতিরিক্ত) দিই।’’
এদিন মুখ্যমন্ত্রী যে ৪ শতাংশ ডিএ ঘোষণা করেছেন তা কার্যকরী হবে আগামী বছরের জানুয়ারি থেকে। কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারীদের এখন ৪৬ শতাংশ হারে মহার্ঘভাতা পান। এরাজ্যে ষষ্ঠ বেতন কমিশন চালু হওয়ার পর থেকে এদিনের ঘোষণার পর রাজ্যের কর্মচারীদের ডিএ প্রাপ্তির হার দাঁড়ালো ১০ শতাংশ। ফলে কেন্দ্রীয় হারে ডিএ থেকে রাজ্যের কর্মচারীদের বকেয়া থেকে গেল ৩৬ শতাংশ। কিন্তু ৪ শতাংশ ডিএ দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী রাজ্যের কর্মচারীদের উদ্দেশ্যে এদিন বলেছেন, ‘‘আমাদের কর্মচারীরা দিনরাত পরিশ্রম করে তাদের ভালো ভেবে ৪ শতাংশ ডিএ বাড়ানো হলো। বড়দিনের গিফট। একটু মিষ্টিমুখ, একটু মিষ্টি হাসি, একটু সুখনিদ্রা।’’
বকেয়া ডিএ’র দাবি নিয়ে নবান্নে অবস্থান করার জন্য এদিনই কলকাতা হাইকোর্ট থেকে রায় আদায় করেছে সংগ্রামী যৌথ মঞ্চ। রাজ্য প্রশাসনের সদর দপ্তরে শুক্রবার থেকে টানা তিনদিন সংগ্রামী যৌথ মঞ্চকে অবস্থান করার অনুমতি দিয়েছেন বিচারপতি রাজশেখর মান্থা। মঞ্চের আইনজীবী বিক্রম ব্যানার্জি আদালতে বলেছেন, ‘‘১৪৪ ধারা জারি করা এলাকা রাজভবনের সামনে যদি অভিষেক ব্যানার্জি ধরনায় বসতে পারেন, তাহলে এখানে আপত্তি কেন?’’
ফলে বকেয়া ৩৬ শতাংশ ডিএ, ৬ লক্ষ শূন্যপদে স্বচ্ছতার সঙ্গে নিয়োগ ও অস্থায়ী কর্মচারীদের স্থায়ীকরণের দাবি নিয়ে নবান্নের লাগোয়া এলাকাতে আগামী শুক্রবার থেকে অবস্থান শুরু করতে চলেছেন সংগ্রামী যৌথ মঞ্চ।
বকেয়া ডিএ’র দাবিতে গত ৪ ডিসেম্বর থেকে টানা ৪৮ ঘণ্টার অবস্থান বিক্ষোভ করেছিলেন রাজ্য কোষাগার থেকে বেতন প্রাপক কর্মচারীদের যৌথ কমিটি। তাদের তরফ থেকে রাজ্য কো-অর্ডিনেশন কমিটির সাধারণ সম্পাদক বিশ্বজিৎ গুপ্ত চৌধুরি জানান, ‘‘৪৮ ঘণ্টা অবস্থানের পর সরকারের টনক নড়েছে। তবে ৪ শতাংশ ডিএ দেওয়ার পরও ৩৬ শতাংশ বকেয়া। আর মুখ্যমন্ত্রী বলছেন, বড়দিনের গিফট! আমাদের লড়াই চলবে। একইসঙ্গে চুক্তিভিত্তিক কর্মী ও অস্থায়ী কর্মীদেরও বেতন বাড়াতে হবে।’’
গত ২৯ নভেম্বর রাজ্যে বিধানসভায় মন্ত্রী ও বিধায়কদের বেতন ও ভাতা বৃদ্ধির বিল পেশের আলোচনাতেও মুখ্যমন্ত্রী স্বতঃপ্রণোদিতভাবে তাঁর বক্তৃতায় টেনে এনে ছিলেন কর্মচারীদের ডিএ’র প্রসঙ্গকে। সেদিনও তিনি জানিয়েছিলেন, ডিএ দেওয়া বাধ্যতামূলক নয়। এদিনও তাঁর মুখ থেকে সেই কথারই আবার প্রতিধ্বনি শোনা গেছে। তিনি বলেছেন, ‘‘ডিএ বাধ্যতামূলক নয়। এটা অপশন। তা সত্ত্বেও আমরা ডিএ দিয়ে যাই।’’
মুখ্যমন্ত্রীর এই বক্তব্যকে উড়িয়ে দিয়েছেন এরাজ্যের কর্মচারীরা। মুখ্যমন্ত্রী ডিএ কে বাধ্যতামূলক নয় বললেও কলকাতা হাইকোর্টের একাধিক রায়ে ডিএ নিয়ে পর্যুদস্ত হতে হয়েছে রাজ্য সরকারকে। ২০১৮ সালে ৩১ আগস্ট কলকাতা হাইকোর্টের ডিভিসন বেঞ্চ ডিএ কর্মচারীদের ‘ন্যায়সঙ্গত অধিকার’ বলে রায় দিয়েছিল। তারপরেও মামলা চলছে। শেষ পর্যন্ত গত ২০২২ সালের ২০ মে কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি হরিশ ট্যান্ডনের ডিভিসন বেঞ্চ ন্যায়সঙ্গত অধিকারের সঙ্গে রায় দেয়, ‘‘ডিএ কর্মচারীদের ন্যায়সঙ্গত আইনি মৌলিক অধিকার।’’ হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে রাজ্য সরকার সুপ্রিম কোর্টে গেছে। কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট মামলায় কোনও স্থগিতাদেশ দেয়নি। এমনকি কলকাতা হাইকোর্টেও রাজ্যের বিরুদ্ধে ডিএ নিয়ে আদালত অবমাননার মামলা পেন্ডিং আছে।
আসলে ক্ষমতায় আসার পর থেকে এরাজ্যের সরকারি কোষাগার থেকে বেতন প্রাপক কর্মচারীদের নায্য ডিএ’র অধিকার নিয়ে সীমাহীন বঞ্চনার পাশপাশি খোদ মুখ্যমন্ত্রী বিভ্রান্তি ছড়িয়ে গেছেন। যেমন এরাজ্যে ষষ্ঠ বেতন কমিশন চালু হওয়ার পর থেকে তার ন্যা শনাল এফেক্ট শুরু হয়েছিল ১ জুলাই ২০১৬ সাল থেকে। তার আগে পঞ্চম বেতন কমিশনের ১২৫ শতাংশ ডিএ ১ জানুয়ারি ২০১৬ সালে সংযুক্ত করে দেওয়া হয়ে যায়। কিন্তু ষষ্ঠ বেতন কমিশন চালু হওয়ার পর রাজ্যের সরকারি কর্মচারীদের কেন্দ্রীয় হার অনুযায়ী ১৫ কিস্তিতে ডিএ পাওনা। কিন্তু রাজ্য সরকার মাত্র তিন কিস্তিতে ১০ শতাংশ ডিএ দিয়েছে। ফলে ১২ কিস্তি ডিএ বকেয়া। যে বকেয়া ৩৬ শতাংশ। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী এই সহজ সত্যকে বিভ্রান্তির মোড়কে এদিন বলেন, ‘‘আমাদের পে কমিশন আছে। আমরা এক্সট্রা দিই। কেন্দ্রের পে কমিশন নেই। ওরা তাই ডিএ দেয়।’’ 
মুখ্যমন্ত্রীর এই বক্তব্যকে ধিক্কার জানিয়ে কনফেডারেশন অব স্টেট গর্ভনমেন্ট এমপ্লয়িজ ফেডারেশনের সভাপতি শ্যামল মিত্র বলেছেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রীর ৪ শতাংশ ডিএ তে ওনার কিছু স্তাবক সন্তুষ্ট হতে পারে। কিন্তু কর্মচারীরা মানবে না। এআইসিপিআই অনুযায়ী ডিএ’র দাবিতে আদালতে যেমন লড়াই হচ্ছে, তেমনই রাস্তার লড়াইও চলবে।’’ সংগ্রামী যৌথ মঞ্চের আহ্বায়ক ভাস্কর ঘোষ জানান, ‘‘৪০ শতাংশের ৪টা পেলাম। শূন্যটা কোথায় গেল? নবান্নের সামনে আমাদের তিনদিনের অবস্থান চলবে।’’ 
রাজ্যের ত্রিস্তর পঞ্চায়েত কর্মচারী সংগঠনের যৌথ কমিটির সাধারণ সম্পাদক সন্দীপ রায় জানিয়েছেন, ‘‘এই রাজ্য সরকার যখন মন্ত্রীসভার সদস্যদের বেতন বৃদ্ধি করেন তখন কোনও শতাংশ মানে না। আজ ৪ শতাংশ ঘোষণার পরও ৩৬ শতাংশ বাকি। গত পঞ্চায়েত ভোটের আগে পঞ্চায়েত কর্মচারীদের হেলথ স্কিমের ঘোষণা কোন চোরাবালিতে আটকে গেল?’’ নিখিলবঙ্গ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ধ্রুব শেখর মণ্ডলও এদিন মুখ্যমন্ত্রীর মাত্র ৪ শতাংশ ডিএ ঘোষণার সিদ্ধান্তকে ধিক্কার জানিয়েছেন।
 

Comments :0

Login to leave a comment