মোদী সরকারের তৈরি করা নতুন নিয়ম অনুযায়ী সরকারের অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রীর পছন্দের দুই আমলাকে নির্বাচন কমিশনার হিসাবে নিয়োগ করার পর থেকে নির্বাচন কমিশনের কাজকর্ম নিয়ে অবিশ্বাস, সন্দেহ এবং অসন্তোষের পাল্লা ক্রমাগত ভারী হয়ে যাচ্ছে। নাগরিক সমাজের চোখে নির্বাচন কমিশন সাংবিধানিক দায়িত্ব ও কর্তব্য নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করছে বলে ধরা পড়ছে না। এমনকি কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়েও গুরুতর প্রশ্ন উঠছে নানা মহল থেকে। বিরোধী দলসমূহের পক্ষ থেকে অভিযোগ জানা হলেও তৎপরতার সঙ্গে পদক্ষেপ গ্রহণের কোনও ঘটনা ঘটছে না। সব ক্ষেত্রেই সীমাহীন নিষ্ক্রিয়তা ও নীরবতা। অনেক বিষয়ে গুরুতর প্রশ্ন থাকলে কমিশন থেকে জবাব মিলছে না। পাওয়া যাচ্ছে না কোনও ব্যাখ্যাও। অর্থাৎ কমিশন বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দায় এড়িয়ে যাচ্ছে। এটা কি কোনও গোপন সত্য বা ষড়যন্ত্রকে আড়াল করার কৌশল?
যে কোনও নির্বাচনে বিরোধী পক্ষের তরফেই সাধারণভাবে অভিযোগ জমা পড়ে বেশি। এবারও তার অন্যথা হচ্ছে না। তাৎপর্যপূর্ণভাবে এবার শাসক দলের তরফে অভিযোগ নেই বললেই চলে। তার দুটো কারণ থাকতে পারে। প্রথমত, বিরোধীরা আদর্শ আচরণ বিধি অনুসরণ করছে বলেই তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করার সুযোগ পাচ্ছে না শাসক দল। দ্বিতীয়ত, নির্বাচন কমিশনের কাজে তারা তৃপ্ত ও সন্তুষ্ট বলেই অভিযোগ করার কোনও প্রয়োজনবোধ করছে না। অর্থাৎ ধরে নেওয়া যায় শাসক দলের প্রত্যাশা মতই নির্বাচন কমিশন কাজ করে যাচ্ছে।
আর একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা হলো নির্বাচন কমিশনে জমা পড়া অভিযোগের সংখ্যায় ও গুরুত্বে অতীতের যে কোনও নির্বাচনকে ছাড়িয়ে গেছে। তেমনি নিষ্ক্রিয়তায় ও নীরবতার নিরিখেও এবার কমিশন সর্বকালীন রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। শাসক দলের নেতারা, বিশেষ করে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী প্রতিদিন যেভাবে আদর্শ আচরণবিধির গুষ্টির তুষ্টি করে চলেছেন তা কমিশন দেখেও দেখে না, শুনেও শোনে না। অভিযোগ এলে সেগুলি পড়ে দেখা হয় কিনা সন্দেহ। প্রতিদিন ধর্ম, জাতপাতকে কেন্দ্র করে বিষাক্ত ভাষণ দিচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী। ঘৃণা ও বিদ্বেষকে উসকে দিয়ে সমাজে বিভাজন সৃষ্টি করছেন। কমিশন অধঃস্তন কর্মীদের মতো নীরবে হজম করে যাচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রী মনে করছেন তিনি সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। যা খুশি করার এবং বলার অধিকার তাঁর আছে। কমিশনও সম্ভবত সেই মনোভাবকেই স্বীকৃতি দিচ্ছে। তাই প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে তারা কোনও ব্যবস্থা নিতে রাজি নয়।
এবার আর একটি নজিরবিহীন লুকোচুরি খেলা শুরু করা হয়েছে ভোট পড়ার হার নিয়ে। অতীতে কোনোদিন এমন রহস্যে মোড়া আচরণ কমিশন করেনি। সাত পর্বে ভোট হচ্ছে। একটি করে পর্বের ভোট গ্রহণের পর সেদিনই রাতে ভোট পড়ার প্রাথমিক হার বা সংখ্যা কমিশনের তরফে সরকারিভাবে ঘোষণা করা হয়। এটা বরাবরের নিয়ম, এবারও হয়েছে। কিন্তু সন্দেহ দানা বাঁধছে চূড়ান্ত তথ্য জানানোর থেকে অস্বাভাবিক বিলম্বের কারণে। তাছাড়া তার চেয়ে বড় রহস্য ঘনীভূত হচ্ছে প্রাথমিক ও চূড়ান্ত তথ্যের মধ্যে অস্বাভাবিক বেশি ব্যবধানে। সাধারণত ভোট গ্রহণের দু’-একদিনের মধ্যে চূড়ান্ত ভোটের হার প্রকাশ করে কমিশন। এবার চার পাঁচদিন থেকে ১১ দিন পর চূড়ান্ত হার প্রকাশ করা হচ্ছে। কেন এমন হচ্ছে তা হাজার বার প্রশ্ন করা হলেও কমিশন কোনও ব্যাখ্যা দেয়নি। তাছাড়া প্রাথমিক ও চূড়ান্তের মধ্যে আসমান জমিন পার্থক্যেরও কোনও সদুত্তর দিতে পারেনি কমিশন। প্রতি বুথের প্রিসাইডিং অফিসারের দেওয়া ভোট পড়ার সংখ্যা যোগ করে মোট প্রদত্ত ভোটের সংখ্যা হয়। আজকের ডিজিটাল যুগের এটা তো কয়েক ঘণ্টার মামলা। ছয় সাতদিন ধরে তাহলে কমিশন তথ্য আড়াল করে রাখছে কেন? সেখানে জল মেশানোর কোনও ফন্দি ফিকির নেই তো? শাসক দলের পক্ষে ভোটের ফল পরিবর্তনের জন্য বাড়তে ভোট মজুত করে রাখার আগাম ব্যবস্থা নয় তো? স্বচ্ছতা না থাকলে, সঙ্গত প্রশ্নের সঙ্গত উত্তর না মিললে, যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা না পেলে মানুষের মনে সন্দেহ জাগবেই। সেই সন্দেহের নিরসন করার দায় কমিশনের।
Editorial
কমিশনকে ঘিরে ঘোরতর সন্দেহ
×
Comments :0