গণতন্ত্র এবং সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদ আপাত দৃষ্টিতে একরকম মনে হলেও দুয়ের মধ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য। সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামত মানেই তা গণতন্ত্রের নিদর্শন নয়। নিছক সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিয়ে গণতন্ত্রকে মাপা যায় না। সংখ্যাগরিষ্ঠতা গণতন্ত্রের মাপকাঠি ঠিকই তবে তার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে আরও অনেক ইস্যু। সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিয়ে কোনও অবস্থাতেই মানবাধিকার লঙ্ঘন করা যায় না। তেমনি সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে ধর্মীয়, ভাষিক, সাংস্কৃতিক ও জাত-বর্ণগত সংখ্যালঘুদের অধিকার কেড়ে নেওয়া যায় না। মোদী-শাহরা যে গণতন্ত্রের কথা বলে থাকেন সেটা আসলে সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদী গণতন্ত্র। এখানে মানুষের অধিকার অপেক্ষা সংখ্যার গুরুত্ব বেশি। আবার সেটা পুরোপুরি ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতবাদ। মোদীর এই ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদী গণতন্ত্রের কথা বলেন। স্বাধীনতার সংগ্রামের ঐতিহ্য প্রবাহ ধরে স্বাধীন ভারতের সংবিধান যে গণতান্ত্রিক বোধ ও কাঠামো গড়ে দিয়েছে তার থেকে মোদীদের গণতন্ত্র সম্পূর্ণ আলাদা। এটা আসলে হিন্দুত্ববাদী গণতন্ত্র। ধর্মের নামে আধিপত্যবাদ গণতন্ত্র।
হিন্দুত্ববাদীদের কাছে মানুষের পরিচয় মানুষ হিসাবে নয়, ধর্ম হিসাবে। ভারতের অধিবাসীদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ (৮০ শতাংশ) যেহেতু ধর্ম পরিচয়ে হিন্দু তাই হিন্দুত্ববাদী আরএসএস মনে করে দেশটা হিন্দুরেই। ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্র বানাবার বাসনার উৎস এখানে নিহিত। ধর্মকে রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির গণ্ডিতে বন্দি করে তারা তৈরি করেছে হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক প্রকল্প। এই প্রকল্প রূপায়ণের দায়িত্ব বিজেপি’র।
আরএসএস-বিজেপি গণতন্ত্র বলতে যা বোঝাতে চায় সেখানে সংখ্যালঘু মুসলিম এবং অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের কোনও ভূমিকা নেই। ভারতবাসী হলেও ভারতের নাগরিক হিসাবে সমানাধিকার পাবার অধিকারী নয়। তেমনি হিন্দুত্ববাদী গণতন্ত্রের চোখে নারীরাও সমানাধিকার পাবার যোগ্য নয়। আবার সামাজিক স্তর ভেদে দলিত, আদিবাসীরাও সমানাধিকারের যোগ্য নয়। দেশে বা রাষ্ট্রে একাধিপত্য কায়েম করার লক্ষ্যেই তারা হিন্দুত্ববাদকে আঁকড়ে ধরেছে সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদের প্রায়োগিক সাফল্য পাবে বলে। হিন্দুত্ববাদ এমন একটি রাজনৈতিক তত্ত্ব যার কোনও সর্বজনীনতা নেই। অর্থাৎ যেখানে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা সংখ্যাগরিষ্ঠ সেখানে এটা সচল। অন্যত্র অচল। অহিন্দু ধর্মাবলম্বীরা যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ সেখানে সংখ্যালঘু হিন্দুরা অধিকারহীন। হিন্দুত্ববাদী সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদী গণতান্ত্রিক ধরনা হিন্দুদের মধ্যেও বৈষম্য ও বিভাজন তৈরি করে দেয়। সঙ্কীর্ণ স্বার্থবাদ এর প্রধান বৈশিষ্ট্য।
হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি যদি মুসলিম সহ অন্য ধর্মাবলম্বীদের অধিকার, মর্যাদা কেড়ে নেবার চেষ্টা করে তবে তার প্রতিক্রিয়ায় অন্য ধর্মাবলম্বী অধ্যুষিত দেশে সংখ্যালঘুদের প্রতি অনুরূপ আচরণের আশঙ্কা থেকে যায়। তখন সব দেশেই ধর্মীয় বিদ্বেষ, ঘৃণা, সংঘাত বাড়তে থাকবে। মানুষের মানবিক সত্তা খণ্ডিত হয়ে যাবে ধর্মীয় সত্তায়। মানব সভ্যতার উন্নততর স্তরে বিকাশের পথ বন্ধ হয়ে যাবে। মানুষ ফিরে যাবে মধ্যযুগীয় পশ্চাৎপদ চিন্তায়। আধুনিক সভ্য সমাজের গণতান্ত্রিক ভাবনা সেটা কোনও অবস্থাতেই অনুমোদন করতে পারে না।
আরএসএস-বিজেপি হিন্দুত্ববাদী সঙ্কীর্ণতার পথ ধরে পেছনের দিকে টেনে নামাতে চাইছে বিকাশমান ভারতীয় সভ্যতাকে। হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিতে সর্বজনীন গণতন্ত্রের জায়গা নেই আছে গোষ্ঠীতন্ত্র। ধর্মকে ব্যবহার করে নির্মিত রাজনৈতিক প্রকল্প আসলে রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বে একাধিপত্য কায়েম। এটা কোনও অবস্থাতেই গ্রহণযোগ্য নয়। এমন বস্তাপচা ধ্যানধারণা ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে নিক্ষেপ করার দায় বর্তেছে সত্যিকারের গণতান্ত্রিক চেতনাসম্পন্ন মানুষের।
Comments :0