Post Editorial

সেলুলয়েডের স্বপ্নময়তার কারিগর

উত্তর সম্পাদকীয়​


জয়দীপ মুখোপাধ্যায়

টালিগঞ্জের স্টুডিও পাড়া এক ঝাঁক শিল্পীর সমাহারে বিস্তৃত ও বর্ধিত হয়ে এসেছে। সিনেমার সংসার। একে একে বর্ষীয়ান প্রাজ্ঞরা চলে যাচ্ছেন। আর, সেলুলয়েডের সেই সজীব স্টুডিওর অলিন্দে আরো গভীরভাবে হারিয়ে যাচ্ছে স্মৃতির ইতিহাস।

সৌম্যেন্দু রায় চলে গেলেন। এই প্রজন্মের অনেকেই জানেন, তিনি বিশিষ্ট একজন ক্যামেরাম্যান ছিলেন, তিনি সত্যজিৎ রায়ের অনেক ছবির ক্যামেরাম্যান ছিলেন, তিনি আরো অনেক বড় পরিচালকদের সাথে সিনেম্যাটোগ্রাফার হিসেবে কাজ করেছেন ইত্যাদি। কিন্তু তাঁর সিনেমা শিল্পের কারিগরী দক্ষতা নিয়ে প্রকৃত মূল্যায়ন খুব কম জায়গাতেই দৃশ্যমান হয়েছে। সেলুলয়েডের ক্যামেরা প্রক্রিয়া এমন গভীরের, শুটিং-এর সময়ে ক্যামেরাম্যানদের দক্ষতা ও শুটিং-এ অন্যান্য ক্যামেরা সম্বন্ধীয় বিষয় গুলোর প্রতি অগাধ জ্ঞান না থাকলে সিনেমাটোগ্রাফিক দায়বদ্ধতা সফল ভাবে বিচ্ছুরিত হতে পারে না। জানতে ইচ্ছে করা দরকার, কেনই বা তিনি সু-উচ্চ ক্যামেরা কিংবদন্তি- স্রেফ ছবি তোলার কারিগর নন।

পঞ্চাশোর্ধ চলচ্চিত্রকারদের কাছে সেলুলেয়েডের সিনেমাযুগ একটা সুমধুর নস্ট্যালজিয়া। এর মাদকতা, কঠিন পথ দিয়ে এক সীমাহীন যাত্রা, শুটিং থেকে ফাইনাল প্রিন্ট অবধি প্রতিটি পরতে থাকত অনিশ্চয়তার আনন্দ, তীব্র অর্থনৈতিক সমস্যাকে অতিক্রম করে মাপা শট নেবার প্রয়াস, যার মধ্যে কুসুমাবৃত হয়ে থাকত প্রতিটি কারিগরী বিভাগের সব সদস্যদের দক্ষতা, শিল্পভাবনা ও পরিচালককে তাঁর রূপকল্পনাকে মনের মতো করে সাজিয়ে তোলার সদিচ্ছা। এক্ষেত্রে, ইউনিটের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সদস্য হিসেবে একজন দক্ষ ক্যামেরাম্যানের ভূমিকা পরিচালকের সামগ্রিক দায়িত্বের পরেই। এখন ডিজিটাল ক্যামেরার যুগে সেলুলয়েড ক্যামেরা দিয়ে ছবি তোলার সেই কঠিনতম পদ্ধতি ও শট টেকিং-এর টেকনিকে আকাশপাতাল তফাৎ ছিল। কতগুলো ছিল মূল উপপাদ্য। এখনকার ক্যামেরার মতো সেলুলয়েড ক্যামেরায় কোনও অনলাইন মনিটর থাকতো না। আশির দশকের শেষে সেলুলয়েডের ছবি প্রোডকশানের শেষ বেলায় কিছু ক্যামেরায় মনিটর সিস্টেম এসেছিল বটে, তা সচরাচর বোম্বেতে উপলব্ধ থাকার ফলে ভারতীয় সমান্তরাল  ও আঞ্চলিক ভাষায় নির্মিত ছবির সেই লড়াইয়ের দিনগুলোতে সেগুলো ব্যয়সাপেক্ষ হয়ে পড়ত। সত্যজিৎ রায়ের ইচ্ছেয় অ্যারিফ্লেক্স ৩৫ মিমি ক্যামেরা কলকাতায় আসে তাঁর ‘জলসাঘর’ সিনেমা শুটিং- এর আগে। বালিগঞ্জের লাভলক প্লেসে চলচ্চিত্রকার এবং সত্যজিৎ-বন্ধু শান্তি চৌধুরি, বিশিষ্ট ক্যামেরাম্যান সুব্রত মিত্র, দেওজীভাই, থিয়েটার রোডের ক্যানডিডা ফিল্মস, মৌলালি মোড়ে অরোরা ফিল্ম কর্পোরেশন, পরবর্তীকালে ইলেকট্রিশিয়ান ও লাইট সাপ্লায়ার কেদার সিং ইত্যাদি এমন কিছু সেলুলয়েড সিনেমার ক্যামেরা পীঠস্থান ছিল, যেখান থেকে টলি পাড়ায় ক্যামেরা সাপ্লাই হতো।

সেলুলয়েড মুভি ক্যামেরায় কাঁচা ফিল্মের হাজার ফিটের রোল, যার রানিং টাইম ছিল সময়-বাঁধা ১০ থেকে ১১ মিনিট, ক্যামেরা ম্যাগাজিনে ঢুকিয়ে স্পকেট থ্রেড করে এক্সপোজের জন্য তৈরি করা হতো। আর এর পর থেকেই ক্যামেরাম্যান বা সিনেম্যাটোগ্রাফারদের শুরু হতো দক্ষতা ও সুচারু শিল্পের অগ্নি পরীক্ষা। মনিটর যেহেতু নেই, তাই ক্যামেরার আই পিস-এ ‘লুক থ্রু’ করে সাদা কালোয় দেখা ফ্রেমের অবয়ব বা দীর্ঘ কম্পোজিশানগুলোর লাইটিং, লাইট মিটার দিয়ে মেপে সম্পূর্ণ দৃশ্যটির, অর্থাৎ মাস্টার শট ও বিভাজিত আনুষঙ্গিক শটগুলোর লাইট ব্যালেন্স করতে হতো। সোর্স লাইটকে বেস করে অন্যান্য লাইটকে (যেমন হাই লাইট, ফেসলাইট, ব্যাক লাইট, জোনাল লাইট ইত্যাদি) শুধুমাত্র মেধা, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা দিয়ে ব্যালেন্স করতে হতো। শটটির প্রয়োজনীয় টেক্সচার পরিচালকের ভাবনা অনুযায়ী সাজাতে হতো ক্যামেরাম্যানকে। এবং বেশ খানিকটা কষ্টকল্পিত আন্দাজে। এর সাথে, সঠিক ছন্দে ট্রলি মুভমেন্ট, ফোকাস কন্ট্রোল ইত্যাদি সবই নির্ভর করতো সিনেম্যাটোগ্রাফারের দক্ষতার ওপর। সেই এক্সপোজড নেগেটিভ প্রসেসিং বা প্রস্ফূটনের জন্য ল্যাবরেটরিতে পাঠানোর পর সম্পাদনার উপযোগী ‘ওয়ান লাইট’ প্রিন্ট পাঠালে, ছবিটির সম্পাদনা সম্পূর্ণ করার পরে, ফাইনাল এডিটেড রাশ প্রিন্টকে আধার করে ল্যাবরেটরিতে নেগেটিভ অনুযায়ী সম্পাদনার পর ফাইনাল প্রিন্টের আগে, সেই সিনেম্যাটোগ্রাফারকে লাইট ও কালার গ্রেডিং (রঙিন ছবির জন্য)করার জন্য ল্যাবরেটরি ইনচার্জের সাথে বসে ক্যামেরাম্যানের সম্পূর্ণ মত নিয়ে ছবির ফাইনাল প্রথম প্রিন্ট (যা সেন্সর প্রিন্ট হিসেবে পরিচিত) তৈরি হতো প্রিন্ট বেরোলে সেটা ল্যাবরেটরিতে বড় প্রোজেকশনে প্রদর্শিত হওয়া ইস্তক ক্যমেরাম্যান নিজের কাজটির মূল্যায়ন নিয়ে অস্বস্তি ও টেনশনে থাকতেন। সব কিছু ঠিকঠাক থাকলে তবেই না সৌমেন্দু রায়ের মতো সু-উচ্চ শিল্পভাবনা সমন্বিত সিনেম্যাটোগ্রাফারদের মুখে হাসি চওড়া হতো!

অমসৃণ জমি, অনিশ্চিত ভবিষ্যত ও তীব্র অর্থনৈতিক কষ্ট প্রকৃতই হার মানতো সিনেমার প্রতি গভীর আবেগ, ভালোবাসা ও দায়বদ্ধতার কাছে। আর এখান থেকেই এক যুগের শেষে আমরা পাই সৌমেন্দু রায়ের মতো ক্ষণজন্মা প্রবাদপুরুষকে।

শুধুমাত্র লেন্স, লাইটিং, কম্পোজিশন বা ক্যামেরা হ্যান্ডলিংই নয়, একজন সিনেম্যাটোগ্রাফারকে সিনেমার ফ্রেমের প্রতিটি বিন্যাসকে মাথায় রাখতে হতো, যেটাকে আমরা ‘misse en cine’ বা ‘সেটিং দ্য স্টেজ’ বলে থাকি। অর্থাৎ শিল্প নির্দেশক কিভাবে তাঁর সেট সাজাচ্ছেন, শব্দযন্ত্রী কোথায় তাঁর বুম প্লেস করছেন, অভিনেতা অভিনেত্রীদের মেক আপের সাথে তাঁদের ফেস লাইটের তারতম্য নির্ধারণ, অভিনেতাদের মুভমেন্ট ফলো করে সেই অনুযায়ী ক্যামেরা মুভমেন্ট ঠিক করা, ফ্রেম অনুযায়ী লাইট সাজানোর জন্য সুদক্ষ ইলেকট্রিশিয়ান ও ট্রলি সেটিংকে নির্দেশ দেওয়া– এককথায় পরিচালকের অন্তর্ভাবনাকে সম্পূর্ণরূপে আত্মস্থ করে তবে সৌমেন্দুবাবু তাঁর শট নিতেন। এখানেও তিনি টালিগঞ্জের চিরাচরিত পরম্পরার সূত্র ধরে শেখা (যা তিনি পেয়েছিলেন রামানন্দ সেনগুপ্ত ও সুব্রত মিত্রের কাছ থেকে) অভিজ্ঞতাপ্রসূত উপলব্ধিগুলোকে সঙ্গে নিয়ে অত্যন্ত যত্ন করেই ফ্রেম সাজাতেন এবং ক্যামেরা রোল করতেন।

সত্যজিৎ রায়ের মতো কালজয়ী পরিচালকদের সাথে কাজের দীর্ঘসূত্রতায় প্রাপ্তির আধার টইটম্বুর হয়। শিল্পসত্তা জাগ্রত হয়। অনেক সৃষ্টি মেলে ধরার সুযোগ পান পাশে থেকে কাজ করার কুশীলবেরা। ‘অপরাজিত’ ছবিতে ক্যামেরাম্যন সুব্রত মিত্রের বাউন্স লাইটের সফল প্রয়োগ আজ এক আন্তর্জাতিক দৃষ্টান্ত। অনেক পরে, সত্যজিৎবাবু যখন অরণ্যের দিনরাত্রি করলেন, সিনেম্যাটোগ্রাফার হিসেবে সৌমেন্দুবাবু অনেক দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন। প্রথম টাইটেল দৃশ্যে চলমান মোটরযানের ভেতরে ক্যামেরা চলছে। বাইরের জঙ্গল প্রকৃতি সরে সরে যাচ্ছে। আর অদ্ভূতভাবে চলমান গাড়ির মধ্যে বসে থাকা চরিত্রগুলোর সংলাপসহ ক্লোজ আপগুলো সেই বাউন্সলাইটেই নিলেন সৌমেন্দুবাবু এবং সুস্থিরভাবে, যার প্রতিটা ইন্টার-কাট-এ বাইরের আলোর সাথে ভেতরের আলো ব্যালেন্স করলেন, এক্সপোজারটা এত সনিপুণভাবে কন্ট্রোল করলেন, যেখানে বাইরের প্রকৃতিও বার্ন আউট করলো না, আর চরিত্রগুলোর মুখগুলোও ঠিকঠাক আলোকপ্রাপ্ত হলো। ঐ ছবিতেই, কোয়েল নদীর পাড়ে সৌমিত্র ও শর্মিলাকে মিড লং কম্পোজিটে রেখে দীর্ঘ ট্রলিতে মুভমেন্ট ফলো করা অবস্থায় ডিপ ফোকাস (অর্থাৎ, আগে পরে দুটো চরিত্রই সমান ফোকাস প্রাপ্ত) এবং পেছনের নদীতট, আদিবাসী দলের চলাচল এগুলোর মধ্যেও ‘ডেপ্থ অব ফিল্ড’ বজায় রাখা – নিঃসন্দেহে সৌমেন্দুবাবুর বিশেষত্ব। ‘জন অরণ্য’ ছবিতে পরীক্ষা হলের দৃশ্যে পরীক্ষককে বেশ কিছুক্ষণ হোল্ডে রেখে জুম আউট করে অসামান্য কম্পোজড লং শট করে বিভাজিত প্রতিটি শটে সমানভাবে আলোকসম্পাত আর কম্পোজিশান মুভমেন্টগুলো সুন্দরভাবে উপস্থাপনা করেছিলেন। ‘গুপি গায়েন বাঘা বায়েন’-এর ভূতের নাচের দৃশ্য, যেখানে সেলুলয়েডের নেগেটিভ ইম্প্রেশান ও ল্যাবরেটরি অপটিক্যালের কাজ ছিল, সেখানেও মাস্টার শটে বেস ফটোগ্রাফিতে কিছু নতুনত্ব আনার চেষ্টা করেছিলেন সৌমেন্দুবাবু। ‘সোনার কেল্লা’ বা ‘শতরঞ্জ কি খিলাড়ী’-তে রাত্রিকালীন দৃশ্যগুলোতে কোডাক হাইস্পিড র’ স্টক ব্যবহার করেছিলেন সফলভাবে। ‘সদগতি’ সিনেমায় ধূসর দেহাতি প্রান্তর বোঝাতে গিয়ে ফিল্মে একটা আন্ডারটোন নিয়ে এসেছিলেন সৌমেন্দু রায়, যাতে ছবির টেক্সচারটাই বদলে যায়।

তাঁর কাজগুলো আর্কাইভড হয়ে রইল ভবিষ্যতের শিক্ষার্থীদের জন্য। সিনে ল্যাবরেটরির যে তীব্র টক গন্ধ এক শতাব্দী ধরে চলচ্চিত্রকারদের মাতাল করেছিল, যে আবেগ আর রোম্যানটিসিজমের বাহু আবিষ্টে চলচ্চিত্রকারেরা আলিঙ্গন করেছিলেন সেলুলয়েডের স্বপ্নময়তাকে, সেই সব কুশীলবরা এক এক করে চলে যাচ্ছেন। আমাদের জন্য রেখে যাচ্ছেন কিছু স্মৃতি, কিছু অনুভূতি। আর অনেক অনেক ‘না বলা কথা’।
 

Comments :0

Login to leave a comment