Flash Flood in Sikkim

বৃষ্টিতে বিপর্যস্ত সিকিমে মৃত ১৪, নিখোঁজ শতাধিক

জাতীয় রাজ্য জেলা

Flash Flood in Sikkim ছবি ও ভিডিও- দীপশুভ্র সান্যাল।

অনিন্দিতা দত্ত


হড়পা বান ও মেঘভাঙা বৃষ্টিতে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে সিকিম। জানা যাচ্ছে, এখনও পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা প্রায় ১৪। মৃতদের মধ্যে ১০ জন সাধারন নাগরিক। এদের মধ্যে তিনটি দেহ জলের তোড়ে ভেসে সিকিম থেকে উত্তরবঙ্গে চলে গেছে। প্রায় শতাধিক নিখোঁজ রয়েছেন। নিখোঁজদের তালিকায় রয়েছে ২২জন সেনাজওয়ানও। সিংটামের বারদাং এলাকা থেকে নিখোঁজ ২৩ জন সেনা জওয়ানদের মধ্যে একজনকে বুধবার বিকেলের পরেই স্থিতিশীল অবস্থাতে উদ্ধার করা সম্ভব হলেও, ৪৮ঘন্টা হতে চললেও বাকিদের এখনও কোন খোঁজ নেই। উদ্ধার হওয়া সেনা জওয়ান সেনা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। নতুন করে বৃষ্টি না নামলে শুক্রবারও নিখোঁজ সেনা জওয়াদের খোঁজে তল্লাশি চলবে। নিখোঁজ সেনা জওয়াদের খোঁজে তল্লাশি জারি থাকবে এমনটাই জানানো হয়েছে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সূত্রে জানানো হয়েছে। 


এদিকে দেহ না মিললেও ধ্বংসস্তূপ থেকে সেনা জওয়ানের পোষাকও উদ্ধার করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার তিস্তার জল কিছুটা নামতেই তিস্তা নদীর জলের তান্ডবে ধ্বংসের চিহ্ন চারিদিকে পরিষ্কারভাবে নজরে আসছে। একে একে দেহগুলি উদ্ধার হতে শুরু করেছে। এদিন ময়নাগুড়ি থেকে ৮টি দেহ উদ্ধার করা হয়েছে। ফুলবাড়ি ক্যানেলের জলেও এক মহিলার দেহ ভাসতে দেখা গেছে। উদ্ধার হওয়া এই দেহগুলির মধ্যে সেনা জওয়ানদের দেহ থাকতে পারে বলেও অনুমান করা হচ্ছে। সেনাবাহিনীর ত্রিশক্তি কোরের পক্ষ থেকে নিখোঁজ জওয়ানদের খোঁজে তিস্তা নদী বক্ষে জোরদার তল্লাশি চালানো হচ্ছে। এদিন সিকিমে ভয়ঙ্কর তিস্তার জলস্তর নেমে যেতেই চারিদিক কাঁদায় পড়ে থাকা সেনাবাহিনীর একাধিক গাড়িগুলিও উদ্ধার করা হয়েছে। পাশাপাশি প্রাকৃতিক দূর্যোগে বিপর্যস্ত উত্তর সিকিমের লাচেন, লাচুং, চুংথাং এলাকায় টেলিফোন ব্যবস্থা, চিকিৎসা পরিষেবা ও যোগাযোগ ব্যবস্থাকে স্বাভাবিক করার লক্ষ্যেও দ্রুত গতিতে কাজ শুরু করা হয়েছে। সূত্রের খবর, দূর্গত মানুষদের সাহায্যার্থে সিকিম রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে ২২টি ত্রাণ শিবির খোলা হয়েছে। শিবিরগুলিতে প্রায় দুই সহস্রাধিক মানুষকে ইতোমধ্যেই সরিয়ে আনা হয়েছে। মঙ্গলবার গভীর রাত থেকেই প্রবল প্রাকৃতিক দূর্যোগের কবলে পড়ে সিকিম। উত্তর সিকিমের চুংথাং এলাকায় দক্ষিণ লোনাক হ্রদ থেকে জল উপছে বাঁধ ভেঙে গিয়ে প্রবল জলচ্ছ্বাস ঘটে পাহাড়ী তিস্তা নদীতে। সিংটামে উড়ে যায় সেনা ক্যাম্প। তিস্তার জলস্তরে এক লাফে বেড়ে যায় ১৫ থেকে ২০ ফুট। প্রাকৃতিক দূর্যোগে সিকিমে ১৪টি সেতু ভেঙে পড়েছে।
একদিকে তিস্তা বাজার আর আরেকদিকে কালিম্পঙ। গোটা রাস্তার পাশ দিয়ে বয়ে গেছে তিস্তা নদী। মঙ্গলবার রাত থেকে প্রবল বর্ষণে বিধ্বংসী রূপ নেয় পাহাড়ী তিস্তা। বৃষ্টির পরিমাণ কমার সাথে সাথে তিস্তা নদীর জলস্তর খানিকটা নেমে গেলেও সেই রাতের আতঙ্ক থেকে বেরিয়ে আসতে পারেননি তিস্তা বাজার এলাকার বাসিন্দারা। অচেনা নগরীতে পরিণত হয়েছে তিস্তা বাজার এলাকা। কারণ এখনও তিস্তার তীরবর্তী দেওগ্রাম এলাকায় একের পর এক বাড়িঘর ধসে যাচ্ছে নদীবক্ষে। জাতীয় সড়ক ধুয়ে মুছে সাফ হয়েছে। বুধবারই দেওগ্রামের অধিকাংশ বাড়ি দোকানপাট নদীগর্ভে তলিয়ে গিয়েছিলো। যতটুকু অবশিষ্ট ছিলো সেটুকুও এদিন একটু একটু করে ধসে গেছে। চোখের সামনে বাড়ি ঘর দোকানপাট সব নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলেও করার কিছুই নেই। তিস্তাবাজার এলাকার কয়েকশত মানুষের মাথায় হাত পড়েছে। মাল্লি এলাকায় নীচ থেকে মাটি সরে গিয়ে বিপজ্জনক অবস্থায় ঝুলছে বেশ কিছু বাড়ি ঘর। জল নামলেই দ্বিতল বাড়ি ঘরেও জমে রয়েছে পলিমাটি। যেকোন মূহুর্ত্বেই নদীগর্ভে তলিয়ে যাবার সম্ভাবনা রয়েছে। ঘরছাড়া অবস্থায় রয়েছেন কালিম্পঙের মাল্লির বেশ কিছু পরিবার। সেই পরিবারগুলিকেও নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। মাল্লি বাজারেও রাস্তা ধসে গেছে। আশ্রয়হীন মানুষ তাদের চোখের জল ধরে রাখতে পারছেন না। সকলেরই চোখে মুখে আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট। জানা গেছে, তিস্তা বাজার এলাকার প্রায় ৭০টি বসতবাড়ির মধ্যে বহু বাড়ি তলিয়ে গেছে তিস্তায়। ছোট যানবাহনগুলির কোন দেখাই নেই। পড়ুয়াদের বইপত্র সবই ভাসিয়ে নিয়ে গেছে তিস্তা। চারিদিকে হাহাকার অবস্থা। পরিস্থিতির ওপর সতর্ক দৃষ্টি রাখা হয়েছে। 


হাওয়া অফিস সূত্রে শুক্রবার পর্যন্ত উত্তর সিকিমে ফের ভারি বৃষ্টির পূর্বাভাস দেওয়া রয়েছে। এমনকি উত্তরবঙ্গের দার্জিলিঙ, কালিম্পঙ সহ একাধিক জেলায় ভারি বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে। ফলে বাড়ছে দুশ্চিন্তা ও উদ্বেগ।
জলস্তর নেমে যাওয়ায় শুরু হওয়া উদ্ধার কাজ চলাকালীন তিস্তার জলে ভেসে যাওয়া বেশ কয়েকটি সেনা ট্রাকের হদিশ মিলেছে। উদ্ধারের চেষ্টা চলছে। সেই ট্রাকগুলিতে সেনা জওয়ানের দেহ রয়েছে কিনা সেবিষয়টিও দেখা হচ্ছে। যুদ্ধকালীন তৎপরতায় মেরামতের পর ১০ নম্বর জাতীয় সড়কের একপাশের রাস্তা খুলে দেওয়া হয়েছে বৃহস্পতিবার সকালে। একমুখী রাস্তা খুলে যাওয়ায় আপাতত মঙপু, তাগদা, তিস্তাভ্যালি ও সিটং’র বাসিন্দারা শিলিগুড়িতে যাতায়াত করতে পারছেন। সিকিমের হড়পা বানে তিস্তা নদীর জলের তোড়ে ভেসে গেছে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ রাস্তা। ফলে সবদিক থেকেই সিকিমের সাথে যোগাযোগ এই মূহুর্ত্বে বন্ধ রয়েছে। রাস্তা মেরামত করে কবে নাগাদ যোগাযোগ ব্যবস্থা স্বাভাবিক হবে সেবিষয়েও চরম অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।  


ভারী বর্ষণে উত্তর সিকিমের চুংথামে লোনাক হ্রদে জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের ড্যাম্প বিস্ফোরনের বিপত্তি প্রসঙ্গে হিমালয়ান নেচার অ্যান্ড অ্যাডভেঞ্চার ফাউন্ডেশন (ন্যাফ)’র কো অর্ডিনেটর অনিমেষ বসু বলেন, দীর্ঘদিন ধরেই বিজ্ঞানী থেকে শুরু করে পরিবেশবিদ সহ বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কার মধ্যে ছিলো প্রায় ৫ হাজার ২০০মিটার উচ্চতায় থাকা হিমবাহ পুষ্ট জলের লোনাক হ্রদ স্ফীত হতে হতে যে কোনদিন বিস্ফোরণের মতো ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটতে পারে। ক্যাপাসিটির বাইরে গিয়ে গত মঙ্গলবার রাতে সেই আশঙ্কা সত্যিক হয়েছে। ফলে বিপুল জলরাশি, বালি, বড় বড় পাথর বয়ে নিয়ে প্রায় ১৫ ফুট উচ্চতা থেকে নেমে এসে চুঙথামের কাছে এনএইচসি’র হাইড্রোলিক প্রজেক্ট জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের বাঁধে এসে ধাক্কা মারায় বাঁধটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। হু হু করে প্রবল বেগে বয়ে চলে তিস্তানদী। তিস্তার জলে তছনছ হয়ে যায় গোটা উত্তর সিকিম। তার জেরেই উত্তর সিকিমে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। তিনি বলেন, প্রাকৃতিক হ্রদ হলেও, এই বিস্ফোরণের জন্য দায়ি আমরাই। হাজার হাজার বছর ধরে একটি হিমবাহ আবহাওয়ার পরিবর্তনে, উষ্ণায়নের কারণে গলতে শুরু করেছে। ফলে হিমবাহ পুষ্ট লোনাক হ্রদও স্ফীত হতে থাকে। হিমবাহ পুষ্ট হ্রদ গুলো স্ফীত হয়ে বড় বড় হড়পা বান আনছে। হিমাচল, উত্তরাখন্ডে হয়েছে। সিকিমেও ছোট বড় বেশ কিছু হড়পা বান হলেও এই হড়পা বান অন্যতম। অবৈজ্ঞানিকভাবে তিস্তা নদীর ওপর অসংখ্য জলবিদ্যুৎ প্রকল্প তৈরী করা হয়েছে। হিমালয়ের এই অঞ্চল নব্য হিমালয় হিসেবে পরিচিত। হিমালয়ের সবচাইতে শেষে গঠিত এই অত্যন্ত ভঙ্গুর। কালিঝোরা থেকে উত্তর সিকিম পর্যন্ত অসংখ্য জলবিদ্যুৎ প্রকল্প রয়েছে। পরিবেশগত বিষয়গুলির তোয়াক্কা না করে এতো বড় বড় হাইড্রেল প্রজেক্ট তৈরী করা হয়েছে। আগামীদিনে এই সব জলবিদ্যুৎ প্রকল্পগুলির অবস্থা কি হবে সেবিষয়ে আশঙ্কার সৃষ্টি হয়েছে। চুংথামে প্রলয়ঙ্কর প্লাবনের দ্বারা এগুলোর কোথাও ফাটল ধরেছে কিনা বা আগামী বড় প্লাবনের সম্ভবনা রয়েছে কিনা সেই বিষয়গুলিও অবিলম্বে খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। উত্তর সিকিমের এই বিপর্যয়ে সেবক—রঙপো রেলপথ বড় প্রশ্ন চিহ্নের মুখে পড়েছে। মানুষ ও পরিবেশের স্বার্থে অবিলম্বে বিশেষজ্ঞদের দ্বারা খতিয়ে দেখে এগুলি চালু করা প্রয়োজন। 


 

Comments :0

Login to leave a comment