GEETA BRIGADE

গীতা পড়ার মঞ্চে হিন্দু সন্তান উৎপাদনের আহ্বান

রাজ্য

রবিবার ফাঁকা ব্রিগেডের অনেকটাই।

এখন বাবা পুরোহিত ভাতা পান। সুব্রত চক্রবর্তী পান না। বেলডাঙার আমতলার বাসিন্দা এই ভূমিহীন বছর চল্লিশের গ্রামবাসীর বক্তব্য,‘‘আমাদের বাড়ির সবাই পুরোহিত। বংশ পরম্পরায় পুরোহিত আমরা। মোদী আবার সরকারে এলে পুরোহিত ভাতা ২০০০টাকা হয়ে যাবে।’’ ব্রিগেডে গীতা পাঠের সভায় আসা ধর্মপ্রাণ সুব্রত চক্রবর্তী বিজেপি-র সমর্থক। তাঁর প্রত্যাশা বলতে আর বিশেষ কিছু নেই। একশো দিনের জবকার্ড আছে। কাজ পান না। করেনও না। 
কিন্তু ক্লাস ফাইভের আরুষ মন্ডল কেন এসেছিল? সে এসেছিল তার বাবা অচিন্ত্য মন্ডলের সঙ্গে। অচিন্ত্যর বাড়ি বহরমপুর শহরে। তিনি বজরঙ দলের কর্মী। বললেন,‘‘ছেলেকে নিয়ে এসেছি আমাদের সংস্কৃতি চেনাতে। এখন থেকে হিন্দু সংস্কৃতি চিনতে হবে।’’ অচিন্ত্য এবং তাঁর নাবালক ছেলে পড়ে ছিল গোলাপি রঙের গেঞ্জি। গেঞ্জির পিছনে লেখা,‘হরে কৃষ্ণ হরে হরে/গীতা পাঠ ঘরে ঘরে।’ গেঞ্জির সামনে লেখা ইংরাজিতে একটি বাণিজ্যিক সংস্থার নাম। ব্রিগেডে গীতা পাঠের জন্য এমন বেশ কিছু বাণিজ্যিক সংগঠন টাকা দিয়েছে। তাদের বিজ্ঞাপন বয়ে বেরাচ্ছিল আরুষের মত ‘হিন্দু সংস্কৃতি’-র ধারকরা। 
আরুষের স্কুলে কী সমস্যা? আরুষের বাবা স্পষ্ট বলতে পারলেন না। স্কুলে পড়াশোনা নিয়ে তাঁর অভিযোগ আছে। কিন্তু গীতা পাঠের অনুষ্ঠানে আসার সঙ্গে স্কুলের অসুবিধার কোনও সম্পর্ক নেই, জানালেন আরুষের মামা। তিনিও বজরং দলের কর্মী। তিনিও এসেছেন বহরমপুর থেকে গীতা পাঠের অনুষ্ঠানে স্বেচ্ছাসেবক হতে। এদিনের মঞ্চ থেকে মাঠ—যাবতীয় আয়োজনের দায়িত্বে ছিল আরএসএস, বজরঙ দল, বিশ্ব হিন্দু পরিষদের কর্মীরা। 
এদিন গীতা পাঠের অনুষ্ঠানে কাজ, শিক্ষা, ফসলের দাম, বেড়ে চলা জিনিসের দাম —কিছু নিয়েই আলোচনা হয়নি। সাধু, সন্ন্যাসীরা এসেছিলেন। গীতা পাঠ হয়েছে। তবে বক্তারা অন্য কোনও সমস্যা নিয়ে বলেননি, তা নয়। সোচ্চারে ঘোষিত হয়েছে রাজনৈতিক দল, মতাদর্শ বাদ দিয়ে হিন্দু হিসাবে সংগঠিত করার কথা। সবাইকে গীতা পাঠের সময় বসে পড়তে বলা হয়েছিল ‘ঐতিহ্য মেনে।’ কিন্তু সবাই বসে পড়েননি। গীতা পাঠের আয়োজন এমন ভাবে হলে বিশৃঙ্খলা হবেই। কেউ চা খাবে, কেউ শশা, কেক, মুড়ি। কেউ জল কিনবেন, কেউ গল্প করবেন—এসব স্বাভাবিক। তাই হয়েছে। ফলে যাঁরা উপস্থিত হয়েছিলেন, তাঁরা সবাই গীতা পাঠ করেননি।
আসলে কর্মসূচীটি গীতা পাঠের ছিলও না। এর আগে দেশ রামকে নিয়ে রাজনীতি দেখেছে। এবার পালা গীতার। লোকসভা নির্বাচনের আগে গীতা পাঠের মঞ্চে হিন্দু মেরুকরণই ছিল এই কর্মসূচীর লক্ষ্য। তা স্প্ট হয়েছে গীতা পাঠ শেষে ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের ট্রাস্টি স্বামী প্রদীপ্তানন্দর কথায়। তিনি বলেছেন,‘‘১৯৪৭-এ ধর্মনিরপেক্ষতার নামে ধর্মহীনতাকে প্রশ্রয় দেওয়া হয়েছে। তুষ্টিকরণ প্রশ্রয় পেয়েছে।’’ তাঁর পরামর্শ,‘‘যাদের সামর্থ্য আছে আর একটি সন্তান উৎপাদন করে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠতা বজায় রাখতেই হবে।’’ তাঁর আরও বার্তা,‘‘যদি আমাদের মন্দির, সাধু, সন্তদের সমালোচনা করে কেউ তাহলে টেনে জিভ ছিঁড়ে ফেলতে হবে।’’ তিনি একটি আশ্চর্যজনক কথা বলেছেন,‘‘সিপিএম, তৃণমূল, বিজেপি, আরএসপি কিছু থাকবে না, হিন্দুরা সংখ্যাগরিষ্ঠ না থাকলে।’’ তাহলে তৃণমূলের দুর্নীতি, চুরি কোনও বিষয়ই নয়? হিন্দু হলে মাফ?
গীতা পাঠের এমন আয়োজন রাজ্যে এই প্রথম। সনাতন সংস্কৃতি পরিষদ, মতিলাল ভারত তীর্থ সেবা মিশন আশ্রম এবং অখিল ভারতীয় সংস্কৃতি পরিষদ এই গীতা পাঠের উদ্যোক্তা ছিল। এই সভাতে আসার কথা ছিল প্রধানমন্ত্রীর। তিনি আসেননি। তবে ব্রিগেডে চারটি ধর্মীয় সংগঠন আয়োজিত গীতা পাঠের অনুষ্ঠানে তিনি একটি ছাপানো বার্তা পাঠিয়েছেন সরকারি প্যাডে। সেখানে নরেন্দ্র মোদীর আহ্বান,‘‘২০৪৭ পর্যন্ত সুযোগ আছে শক্তিশালী, উন্নত, সমন্বিত ভারত গড়ে তোলার।’’ দেশকে ‘শক্তিশালী, উন্নত এবং সমন্বিত’ হয়ে ওঠার সময়কাল, তার আগেও নয়, পরেও নয়, আগামী ২৪ বছর কেন বলে প্রধানমন্ত্রী মনে করেছেন, তার ব্যাখ্যা তাঁর বার্তায় নেই। অন্তত ২০৪৭ পর্যন্ত বিজেপি সরকারে থাকবে বলেই মোদী মনে করছেন? 
এদিন রাজ্যে বিজেপি-র সাংসদ, বিধায়করা ছিলেন ব্রিগেডে। ছিলেন বিজেপি-র নানা স্তরের নেতারা। ব্রিগেড মাঠজুড়ে হয়নি অনুষ্ঠান। বাঁশ দিয়ে ঘিরে দেওয়া হয়েছিল কিছুটা। সেখানেই বসার আয়োজন করা হয়েছিল। আরএসএস-র দাবি, এদিন লক্ষাধিক মানুষ এসেছিলেন। তবে ব্রিগেড সমাবেশ দেখতে অভ্যস্ত যাঁরা, তাঁদের অনেকেরই দৃঢ় ধারণা, অত লোক হয়নি।

Comments :0

Login to leave a comment