Post Editorial

গাজার শিশুদের জন্য কাঁদছি না

উত্তর সম্পাদকীয়​


দেবাশিস চক্রবর্তী

 

‘ উত্তর গাজায় গতরাতের আক্রমণে ৮ প্যালেস্তিনীয় শিশু নিহত হয়েছে, ১০ মে থেকে শিশুমৃত্যুর সংখ্যা অন্তত ৪০। এই শিশুদের বয়স ছ’মাস থেকে ১৭ বছর। অধিকাংশই ১০ বছরের নিচে। বিরাট সংখ্যক শিশু আহত হয়েছে।’ 
প্রতিবেদনের এই অংশটুকু মনোযোগ দিয়ে পড়লেই বোঝা যাচ্ছে, এ খবর গত এক মাসের নয়। নিয়মিত, রোজ এখন আমরা যা পড়ছি তার অংশ নয়। রিপোর্টটি রাষ্ট্রসঙ্ঘের শিশু কল্যাণ সংস্থা ইউনিসেফ’র। ১৫ মে, ২০২১। সবে শুরু, লাফিয়ে বেড়েছিল পরের কয়েকদিন। 
আরও একটু পিছিয়ে যাই। মিডল ইস্ট মনিটরের প্রতিবেদন: ইজরায়েলী আক্রমণে গাজায় নিহত হয়েছে ৫৪৬জন শিশু। তথ্য রাষ্ট্রসঙ্ঘের। সময় ২০১৪। 
আবারও পিছিয়ে যাই। মিডল ইস্ট মনিটরের আরেকটি প্রতিবেদন: গাজা স্ট্রিপে ইজরায়েলের ২২দিনের আক্রমণে নিহত হয়েছে ৩১৫ জন শিশু। এই তথ্য রাষ্ট্রসঙ্ঘের। এবার সময় ২০০৮। 
এ বছরের ৭ অক্টোবর থেকে ইজরায়েল গাজায় সামরিক অভিযান শুরু করার পরে (তাদের ভাষায় ‘হামাস বিরোধী অভিযান’) ১২ নভেম্বর পর্যন্ত গাজায় নিহত হয়েছে ৪৩৩৭ জন শিশু। প্যালেস্তাইনের স্বাস্থ্য মন্ত্রকের (যা হামাস চালায় না, ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক থেকে চলে) হিসাব অনুযায়ী আরও অন্তত ১৩৫০ শিশু ধ্বংসস্তূপের নিচে পড়ে আছে। তারা আর বেঁচে নেই বলেই ধরে নেওয়া হয়েছে। তাহলে, অন্তত ৫৬০০ শিশু ইতিমধ্যেই নিহত। গাজার ২২টি হাসপাতাল আক্রান্ত, সেখানে চিকিৎসাধীন শিশুরা বোমার আঘাত ছাড়াই মরে গেছে। এর মধ্যে একটি শিশু হাসপাতালও রয়েছে। সবচেয়ে বড় দুই হাসপাতাল আল-শিফা ও আল-কুদ বন্ধ হয়ে গেছে। গত সাতদিন ধরে শুধুই শিরোনাম: ‘অক্সিজেন নেই, সদ্যোজাতরা মৃত্যুমুখে’, ‘ বিদ্যুতের জোগান শেষ হওয়ায় আইসিইউ বন্ধ করে দেওয়া হলো, কেউ বাঁচবে না’, ‘তিন হাজার ক্যানসার রোগীকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে, তাদের চিকিৎসার আর কোনও সুযোগ নেই’। 
গাজার শিশুরা সংখ্যা, সংখ্যা মাত্র। শুনতে যত খারাপই লাগুক, গাজার শিশুরা সংখ্যা। প্রতিদিন ১৮০ জন শিশু মারা যাচ্ছে, এক পরিসংখ্যান, ক্রিকেটের মাঠের মতো। তবু আরেকটি পরিসংখ্যানই দেব। ২০০০-র সেপ্টেম্বর থেকে ২০২৩-এর ৬ অক্টোবর পর্যন্ত ইজরায়েলী সেনাবাহিনী অধিকৃত ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক, পূর্ব জেরুজালেম, গাজা স্ট্রিপে খুন করেছে ২১৮৭ শিশুকে। এই হিসাব ডিফেন্স ফর চিল্ড্রেন ইন প্যালেস্তাইনের স্বাধীন হিসাব। পাঠক, খেয়াল করেছেন নিশ্চয়ই এই হিসাব ৭ অক্টোবর ইজরায়েলের অভ্যন্তরে গিয়ে হামাসের আক্রমণের আগের দিন পর্যন্ত। পরবর্তী এক মাসের কিছু বেশি সময়ে গাজায় যত শিশু নিহত হয়েছেন তা ১৯৬৭ থেকে সমস্ত সংঘাত ও একতরফা ইজরায়েলী হানায় নিহতের সমগ্রের থেকেও বেশি। আমরা কোনও বিবরণে যাইনি, কোনও ব্যথাতুর শব্দ ব্যবহার করিনি, হৃদয়স্পর্শী কোনও বিশেষণ লিখিনি, আমরা সাড়ে তিনশো শব্দ পেরিয়ে এসেছি।

গাজায় কেন এত শিশুর মৃত্যু হচ্ছে? একটি সহজ উত্তর হচ্ছে, ‘কোল্যাটারাল ড্যামেজ’— হামাসকে মারতে গিয়ে গাজায় সকলকেই মারা হচ্ছে। ইজরায়েলের ব্যাখ্যা বাদ দিন, ব্রিটিশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রী টেলিভিশনে বললেন, ‘কেন ড্রেসড্রেনের যুদ্ধে ব্রিটিশ সেনারা ৩৫ হাজার লোক মারেনি? যুদ্ধে ওইরকম হয়ে যায়।’ আরেকটি জনসংখ্যাগত বিন্যাসের ব্যাখ্যা রয়েছে। গাজায় ৫০শতাংশের বেশি বাসিন্দাই ১৮ বছরের নিচে। সুতরাং বোমাবর্ষণে বাড়িঘর ধ্বংস হলে শিশুদের মৃত্যুর সম্ভাবনা বেশি। গাজা তৈরিই হয়েছে প্যালেস্তাইনের শরণার্থীদের নিয়ে। ১৯৪৮ সালে ইজরায়েল তৈরি হবার পরে প্যালেস্তাইনের লক্ষ লক্ষ মানুষকে তাঁদের নিজের ভূমি থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। প্যালেস্তাইনের ইতিহাসে যা ‘নাকবা’ বলে পরিচিত। তাঁদের একটা অংশ চলে আসেন তখন মিশরের নিয়ন্ত্রণে থাকা গাজায়। পরে ১৯৬৭-তে ইজরায়েল যুদ্ধ করে গাজা কেড়ে নেয়, সেই সময়েও নতুন করে গৃহহীনরা অনেকে চলে আসেন। বলা চলে, গোটা গাজাই এক শরণার্থী শিবির। সময় গেছে, নাকবা-প্রজন্মের সন্তান-সন্ততিরা, তাঁদের সন্তানরা গাজায় থাকেন বা এই সেদিনও থাকতেন। 
এই ব্যাখ্যাই কি যথেষ্ট? ঘটনাক্রম প্রমাণ করছে, না, যথেষ্ট নয়। ওয়েস্ট ব্যাঙ্কের দিকে তাকানো যাক। বছরের পর বছর সেখানে প্যালেস্তিনীয়দের জমি ও বাড়িঘর কেড়ে নিয়ে ইজরায়েল ‘বসতি’ বানাচ্ছে। পরিভাষায় ‘সেটলার’। সেখানে প্যালেস্তিনীয়দের প্রবেশ নিষেধ। ওয়েস্ট ব্যাঙ্ককে ভাগ করে রাখা হয়েছে দু’শোর বেশি ঘেটোয়। বুলডোজারে শুধু বাড়িই ভাঙা হচ্ছে না, শত শত প্যালেস্তিনীয়কে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে তথাকথিত প্যালেস্তাইন কর্তৃপক্ষের শাসন কি বাস্তবে চলে? যাদের দিয়ে এই ‘বসতি’ বানানো হচ্ছে, তারা সাধারণ ইহুদি নন। তারা জায়নবাদী, তারা সেনাবাহিনীর লোক। তারা জর্ডান নদী থেকে ভূমধ্যসাগর, রাফা থেকে গোলান হাইটস সবই ইজরায়েলের মানচিত্রে চায়। ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর এখনকার সরকার তৈরি হবার পরে তা দ্বিগুণ হারে বেড়েছে। গাজা এতদিন অবরুদ্ধ ছিল। তিনদিকে ইজরায়েলের তৈরি সীমান্ত, সেখানে সেনা পাহারা। প্রবেশ-প্রস্থান নিষিদ্ধ। অন্যদিকে ভূমধ্যসাগর, সেখানেও তিন মাইলের বেশি যাওয়া নিষেধ। গাজায় যখন ২৫ হাজার টন বোমা পড়ে গেছে, ১১ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন, তখন রোজই ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক, জেনিনেও বোমা পড়ছে। নির্বিচারে ইজরায়েলী সেনারা ঢুকে গুলি চালাচ্ছে। গাজায় একই সঙ্গে ভেঙে ফেলা হচ্ছে হাসপাতাল, বিদ্যুৎ কেন্দ্র, রাষ্ট্রসঙ্ঘের শরণার্থী শিবির, স্কুল, দোকানপাট, এক কথায় যা কিছু নিয়ে বাঁচা যায়। গাজাকে একটি বিরাট ধ্বংসস্তূপে পরিণত করা হচ্ছে যাতে গাজা আর বাসযোগ্য না থাকে। কয়েক দশক ধরে ইজরায়েলের শাসকরা যা চেয়েছেন, যা অংশত করে ফেলেছেন, এখন তাঁরা তার শেষ দৃশ্য দেখতে চাইছেন। ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক থেকে গাজা— কোথাও কোনও প্যালেস্তিনীয় থাকবে না। কেউ না, কোনও ‘ভদ্র’, কোনও ‘ইন্তিফাদা’ জাগানো মানুষ, কোনও হামাস, কোনও ফাতা, কোনও ডাক্তার, কোনও শিক্ষক, কোনও সাংবাদিক, কোনও রাষ্ট্রসঙ্ঘের কর্মী, কেউ না। ইজরায়েলের মধ্যে ‘বৃহত্তর ইজরায়েল’ গঠনের যে স্লোগান রয়েছে, যে মতাদর্শ রয়েছে তার কাছাকাছি পৌঁছে যাওয়া গেছে। গাজা ধ্বংস করে, অথবা প্রায় ধ্বংস করে মিশরের সিনাইয়ে ঠেলে দাও অবশিষ্ট শরণার্থীদের, এই পরিকল্পনা কার্যকর করতে ব্রিটেনকে মধ্যস্থ করে উদ্যোগ শুরু হয়েছে। 
শিশুহত্যা এর অনিবার্য এবং আবশ্যিক উপাদান। পুরো একটি জনগোষ্ঠীকে, যা হাজার হাজার বছরের প্রাচীন, একটি সংস্কৃতিকে নির্মূল করে দেবার অভিযান যখন চলছে, শিশুরা বাদ যাবে কেন? বাদ তো যাবেই না, বরং ভবিষ্যতে যাতে কোনও প্রতিরোধের বীজ তৈরি না হয়, তা নিশ্চিত করতে হলে সর্বোচ্চ সম্ভব শিশুকেই মারতে হবে। এটি ইজরায়েলের যুদ্ধ পরিকল্পনার অংশ, কোল্যাটারাল ক্ষয়ক্ষতি এবং ‘আহা কেন যে যুদ্ধ হয়’ বলে এই সত্য আড়াল করা যাবে না। এ বিশুদ্ধ নির্মূলীকরণ— এথনিক ক্লিন্সেলিং বলে সমাজবিজ্ঞানে পরিচিত। 
এই জন্য আমরা গাজার মৃত শিশুদের জন্য কাঁদছি না। বরং বলা যাক জায়নবাদীরা ঠিক কিরকম ভাবে। নিউ ইয়র্কার পত্রিকায় আইজ্যাক চোটিনার গত সপ্তাহেই ইজরায়েলের সেটলার আন্দোলনের এক পরিচিত নেত্রী ড্যানিয়েলা ওয়েসের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। শিউড়ে ওঠার মতো সেই সাক্ষাৎকারে প্রবীণা ওয়েস ব্যাখ্যা করেছেন কেন আরও আরও বসতি স্থাপন করা উচিত, কেন একমাত্র ইজরায়েল থাকবে, কেন প্যালেস্তিনীয়দের কোনও ভোটাধিকার থাকা উচিত নয়। সাংবাদিকের শেষ প্রশ্ন ছিল, গাজায় যে এভাবে শিশুদের মৃত্যু হচ্ছে তা দেখে আপনার কষ্ট হয় না? ওয়েস বলেছেন, ‘না, হয় না কেননা পশুজগতের তা-ই নিয়ম। আমার সন্তান আগে, পরের সন্তানের জন্য আমার কোনও মাথাব্যথা নেই।’ শুধু পাঠককে আরেকবার ‘পশুজগৎ’ শব্দটিতে চোখ রাখতে বলছি। 
কে বলেননি এই ‘অ্যানিম্যাল’ ? গত একমাসে ইজরায়েলের রাষ্ট্রপতি বলেছেন, প্রতিরক্ষা মন্ত্রী বলেছেন, অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা মন্ত্রী বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী একটু অন্য ভাষায় বলেছেন। রাষ্ট্রসঙ্ঘে ইজরায়েলের প্রতিনিধি নিরাপত্তা পরিষদে বলেছেন, ‘গাজায় সকলেই হামাস। হাসপাতাল হামাস, ডাক্তাররা হামাস, অ্যাম্বুল্যান্স চালকরা হামাস, রাষ্ট্রসঙ্ঘের কর্মীরা হামাস।’ সরল অঙ্ক, শিশুরাও হামাস। যারা জন্মের শংসাপত্র পাবার আগে মৃত্যুর শংসাপত্র পেয়েছে, তারাও হামাস। যারা ইনকিউবেটরে মরে গেল, তারা হামাস। যেহেতু তারা সকলেই, আবালবৃদ্ধবনিতা হামাস, তাই তাদের বিরুদ্ধে ক্লাস্টার বোমা ব্যবহার করা যায়, সাদা ফসফরাস, আগুনে বোমা ব্যবহার করা যায়। এমনকি পরমাণু বোমার বিকল্পও ভেবে রাখা আছে, তা বলে দেওয়া হয়েছে। 
আরও মারাত্মক হলো শুধু ইজরায়েলের রাষ্ট্রনেতারা এই ধারণা পোষণ করছেন এমন নয়। শুধু প্যালেস্তিনীয়রাই নয়, আরবদেরই এক হিংস্র, অস্বাভাবিক, মানবেতর এবং বেঁচে থাকার অধিকারী নয় বলে মতাদর্শ ইজরায়েলের সমাজের গভীরে প্রোথিত করা হয়েছে। ইজরায়েলের মধ্যেও এই আগ্রাসনের বিরুদ্ধে গলা তুলেছেন অসমসাহসী কিছু মানুষ, ইজরায়েলের কমিউনিস্ট ও বামপন্থীরা, ধর্মপ্রাণ ইহুদিরাও কেউ কেউ। কিন্তু সমাজের বৃহত্তম অংশের মধ্যে চরম ঘৃণার এই বোধ সক্রিয়। অপরায়নের গণ্ডি পেরিয়ে তা শত্রু সংজ্ঞায় পরিণত হয়েছে, এখন হত্যালিপ্সু এক বোধহীন সমাজ তৈরি হয়েছে। ইজরায়েল দেশের মধ্যেই এক দীর্ঘ যুদ্ধ চালিয়েছে, সাংস্কৃতিক যুদ্ধ, ইতিহাস বিকৃতির যুদ্ধ, মানবমনের দখল নেওয়ার যুদ্ধ। সেই যুদ্ধে আপাতত ইজরায়েলের শাসকদের জয় তাদের গাজা নিশ্চিহ্নের যুদ্ধে শক্তি জুগিয়েছে। 
পাঠক, বাচ্চাদের জন্য না কেঁদে আমরা এগারশো শব্দ অতিক্রম করেছি। 
ইজরায়েলকে দেখছি আমরা। শুধু ইজরায়েলকে দেখছি? তাদের যে যুদ্ধবিমান রোজ গাজায় বোমা ফেলছে তা দিয়েছে কে? কে দিয়েছে অত্যাধুনিক এবং সবচেয়ে শক্তিশালী বোমাগুলি? কে দিয়েছে হাসপাতাল ঘিরে ফেলা ট্যাঙ্ক? অতীতের কথা বাদ দিন শুধু গত দশ বছরে ৩৬০০ কোটি ডলারের অস্ত্র ইজরায়েলকে দিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। সাতদিন আগে জরুরি ভিত্তিতে মার্কিন কংগ্রেসে পাস করিয়ে নেওয়া হয়েছে আরও ১০৬০ কোটি ডলারের অস্ত্র সহায়তার বিল। প্রয়োজনে আরও দেবার জন্য কংগ্রেসের অনুমতি লাগবে না, এমন শর্তও রয়েছে। মার্কিন সামরিক সরঞ্জাম উৎপাদনকারী সংস্থাগুলিতে ওভারটাইম চলছে। হু হু করে ইজরায়েলের জন্য অস্ত্র বানানো হচ্ছে। বরাতের একাংশ সরবরাহ বাকি ছিল, বোয়িং তার পূর্ণ সক্ষমতা ব্যবহার করছে। ‘হামাস অতিরিক্ত চাহিদা তৈরি করেছে’, জেনারেল ডায়নামিকসের লগ্নীকারীরা জানিয়েছে। ‘রেথনের পরিকল্পনার সঙ্গে খাপে খাপে মিলে যাচ্ছে’, তাদের লগ্নীকারী সংস্থার বিশ্লেষণ। আন্তর্জাতিক লগ্নী পুঁজির যে অংশ সামরিক শিল্প বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত তারা আনন্দে মশগুল। গাজায় যতক্ষণ শিশুরা বেঁচে থাকবে, ততক্ষণ তাদের তৈরি অস্ত্রের প্রয়োজন হবে, ততক্ষণ তাদের মুনাফা অস্বাভাবিক হারে বাড়বে। 
শুধু পুঁজির লাভালাভের প্রশ্নই নয়, রাজনৈতিক-সামরিক আধিপত্যের প্রশ্ন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, জার্মানি বাউন্ডারির বাইরে বেরিয়ে ইজরায়েলের হয়ে গলা ফাটাচ্ছে। ইজরায়েলের লবজ তাদের ধরতাই হয়ে দাঁড়িয়েছে। ‘যুদ্ধবিরতি’ হলেই হামাসকে শ্বাস নিতে দেওয়া হবে— দুনিয়াজুড়ে এই তত্ত্ব প্রতিষ্ঠায় পশ্চিমী নেতারা, সংবাদমাধ্যম ঝাঁপিয়ে পড়েছে। ইজরায়েলী সেনাদের ‘শয্যাসঙ্গী’ (মাপ করবেন, এমবেডেড শব্দটি আমাদের আবিষ্কার নয়) হয়ে মার্কিন-ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যমের একটানা প্রচার চলছে—ওরা সবাই হামাস। মার্কিন রণতরীর বহর দাঁড়িয়ে গাজা ঘেঁষে, মার্কিন বিমান ইতিমধ্যেই ইরাক ও সিরিয়ায় বোমা ফেলেছে। মার্কিন রাষ্ট্রপতি থেকে লাইন দিয়ে তাদের মিত্র দেশের প্রধানরা তেল আভিভে গিয়ে নেতানিয়াহুর সঙ্গে ছবি তুলে এসেছেন। মার্কিন সেন্ট্রাল কম্যান্ডের প্রধান ইজরায়েলে, সিআইএ প্রধান ইজরায়েলে। মার্কিন বিদেশ সচিব অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন নিদ্রাহীন রাত কাটাচ্ছেন কোনও না কোনও আরব দেশে, যাতে তারা নিষ্ক্রিয় থাকে। ৭ অক্টোবরের ঘটনা সাম্রাজ্যবাদকে খোলস ছেড়ে ফেলতে বাধ্য করেছে। ইজরায়েল নয়, সাম্রাজ্যবাদ গাজায় আঘাত করছে। 
ইউরোপ, আমেরিকা সহ বিশ্বজুড়ে রাস্তায় নেমে গেছেন মানুষ। এত মানুষের চলমান মিছিল অনেক দিন দেখেনি পৃথিবী। তাঁদের কণ্ঠে কণ্ঠে গাজার শিশুদের নাম উচ্চারিত হচ্ছে। কিন্তু সেইসঙ্গেই উচ্চারিত হচ্ছে ভিয়েতনামের কথা, ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়ার কথা, বর্ণবিদ্বেষের বিরুদ্ধে কথা, এমনকি ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের কথা, আয়ের প্রবল বৈষম্যের কথা। প্রায় বিস্মৃত হতে থাকা প্যালেস্তাইন ঢুকে পড়েছে মার্কিন সংসদে, ব্রিটিশ পার্লামেন্টে, ফুটবলের গ্যালারিতে, দেওয়ালে দেওয়ালে। গাজার মৃত শিশুরা ঢুকে পড়েছে রেল স্টেশনে, বন্দরে দাঁড়ানো জাহাজে, উঠে পড়েছে রোমান স্থাপত্যে, শুয়ে পড়েছে দুনিয়া কাঁপানো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণে। 
রাষ্ট্রসঙ্ঘের মহাসচিব আন্তিনিও গুতেরেস বলেছেন, ‘গাজা শিশুদের সমাধিক্ষেত্র’। হয়তো তা-ই। কিন্তু গাজার শিশুদের তো ডানা রয়েছে।   
 

Comments :0

Login to leave a comment