UK's New PM

স্টার্মার ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী লেবার-ঝড়ে সরলেন সুনক

আন্তর্জাতিক

টানা চোদ্দ বছর পরে ঐতিহাসিক জয়ের পথে ব্রিটেনে ক্ষমতায় ফিরল লেবার পার্টি। শাসক কনজারভেটিভ পার্টিকে সরাসরি পর্যুদস্ত করে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা দখল করলেন কিয়ের স্টার্মারের নেতৃত্বাধীন লেবাররা। শুক্রবার ফল প্রকাশের পরপরই বাকিংহাম প্রাসাদে গিয়ে রাজা তৃতীয় চার্লসের সঙ্গে দেখা করে ইস্তফা দিয়েছেন বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী টোরি নেতা ঋষি সুনক। তারপরেই প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করে ‘‘জাতীয় পুনরুজ্জীবন’’র অঙ্গীকার ঘোষণা করেছেন স্টার্মার।
বুথফেরত সমীক্ষায় সুস্পষ্ট ইঙ্গিত ছিলই। সেই পূর্বাভাস সত্যি প্রমাণ করে হাউস অব কমন্সে ‘‘চারশো পার’’ করল স্টার্মারের লেবার পার্টি। ব্রিটিশ পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষের মোট ৬৫০ আসনের মধ্যে ৪১২টিতেই জয়ী হয়েছেন লেবাররা। নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য দরকার ছিল ৩২৬ আসন। নির্বাচনী লড়াইয়ে মুখ থুবড়ে পড়ায় প্রায় ২৫০ আসন হারিয়ে টোরিদের ঝুলিতে এসেছে মাত্র ১২১টি আসন।
অন্যদিকে, এড ডেভির নেতৃত্বাধীন লিবারেল ডেমোক্র্যাট পার্টি পেয়েছে ৭১ টি আসন; গতবারের চেয়ে ৬২টি বেশি। জন সুইনির দল স্কটিশ ন্যাশনাল পার্টি ৩৮টি আসন হারিয়ে পেয়েছে মাত্র ৮টি। এছাড়াও অন্যান্য দল পেয়েছে আরও কয়েকটি আসন। নতুন সরকার গড়তে ব্রিটেনে ভোট গ্রহণ করা হয়েছিল বৃহস্পতিবার। ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড, ওয়েলস এবং উত্তর আয়ারল্যান্ডে ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় ৯৮টি রাজনৈতিক দল এবং নির্দল প্রার্থীরা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ছিলেন। 
লক্ষ্যণীয়ভাবে এর আগে পরপর সাতবার ‘ঘায়েল হয়ে’ এবারে সাংসদ হতে চলেছেন অতি-দক্ষিণপন্থী রিফর্ম-ইউকে নেতা নাইজেল ফারাজে। তাঁর সঙ্গেই এবার জয়ী হয়েছেন দলের আরও ৪ জন সদস্য। কট্টরপন্থী এই দলের জয় আগামীদিনে ব্রিটিশ রাজনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। 
বেলাগাম মূল্যবৃদ্ধি থেকে অস্বাভাবিক করের হার, ব্রেক্সিট-পরবর্তী বিপন্ন অর্থনীতি থেকে সমাজে অপরাধ বৃদ্ধির মতো নানান সমস্যায় গত কয়েক বছরে কার্যত নাভিঃশ্বাস উঠেছিল ব্রিটিশ জনজীবনে। শিল্প থেকে পরিষেবার প্রতিটি ক্ষেত্রে শ্রমজীবীদের লাগাতার ধর্মঘটে এই অসন্তোষ মুহুর্মুহু আছড়ে পড়লেও পরিস্থিতি সামলাতে চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ হয়েছে দলীয় কোন্দলে দীর্ণ কনজারভেটিভ দল ও সরকারের নেতৃত্ব। টোরি সরকারে বারবার প্রধানমন্ত্রী বদলের মতো ঘটনাতেও মানুষ তিতিবিরক্ত হয়ে পড়েছিলেন। এসবের অনিবার্য পরিণতিতেই ব্রিটেনের কুর্সিতে পালাবদল, বলছেন বিশ্লেষকরা।
ভোটদাতাদের এই রায় ‘‘মাথা পেতে’’ নিয়েছেন টোরি নেতা সুনক। ব্রিটেনে সবচেয়ে কম বয়সী প্রথম ভারতীয় বংশোদ্ভূত প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু মাত্র কুড়ি মাসেই তাঁর মেয়াদ ফুরিয়ে গেল। সুনকের নিজের আসন রিচমন্ডে অ্যান্ড নর্থঅ্যালার্টনে জয় এলেও এবারের লেবার-জোয়ারে কার্যত খড়কুটোর মতো ভেসে গিয়েছেন তাঁর ক্যাবিনেটের অন্তত ৮ জন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী। তাঁর নেতৃত্বে দলের বিপুল হারের জন্য সমর্থকদের কাছে দুঃখ প্রকাশ করে বিদায়ী ভাষণে সুনক এদিন বলেন, ‘‘জনগণের ক্ষোভ, হতাশা এবং আকাঙ্খার কথা আমি বুঝতে পেরেছি। শুধু প্রধানমন্ত্রীর পদ নয়, নতুন নেতা নির্বাচনের পরে কনজারভেটিভ পার্টির নেতৃত্বও ছেড়ে দেব আমি।’’
অন্যদিকে ৪৪ বছর বয়সী সুনকের ইস্তফার পরপরই প্রথামাফিক বাকিংহাম প্রাসাদে গিয়ে রাজা চার্লসের কাছ থেকে নয়া সরকার গড়ার আনুষ্ঠানিক আমন্ত্রণ গ্রহণ করেন বিজয়ী দলের নেতা ৬১ বছর বয়সী স্টার্মার। সেখান থেকে ফিরে প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন ১০ ডাউনিং স্ট্রিটের কালো দরজার সামনে দাঁড়িয়ে মানবাধিকার বিশেষজ্ঞ এই ব্যারিস্টার উদ্বেলিত জনতাকে বলেন, ‘‘দেশে আজ থেকেই পরিবর্তনের পালা শুরু। রাজনীতিকে আবার ফেরাতে হবে জনসেবায়। আমরা সকল দেশবাসীর ভালোর জন্য কাজ করছি, দেখাবে আমাদের সরকার।’’
ব্রিটেনে ২০১০ সাল থেকেই ক্ষমতার মসনদে রয়েছে টোরিরা। কিন্তু এবার যে তাদের ভরাডুবি হতে চলেছে তা কার্যত জানতেই সবাই। সেই মতো অন্তত ৮ জন মন্ত্রী সহ শাসকদলের দাপুটে সাংসদরা হেরে গিয়েছেন। রীতিমতো গণ-অসন্তোষের ঝড়ে সাংসদপদ খুইয়েছেন সুনকের পূর্বসূরি লিজ ট্রাস। তাঁর আমলের বিতর্কিত ‘মিনি বাজেট’ বিপর্যয়ের জেরে গত বছর সবচেয়ে কম সময় প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারে ছিলেন তিনি। এবারে হেরেছেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী গ্র্যান্ট শ্যাপস, হাউস অব কমন্সের নেতা পেনি মরডন্ট, শিক্ষামন্ত্রী গিলিয়ান কিগান, সংস্কৃতিমন্ত্রী লাকি ফ্রেজার, বিজ্ঞানমন্ত্রী মিশেল ডোনেলান, আইনমন্ত্রী অ্যালেক্স চাক, ‘দ্য ফাদার অব দ্য হাউস’ সম্মানপ্রাপ্ত দীর্ঘদিনের সাংসদ পিটার বটমলি, ব্রেক্সিট-পন্থী পরিচিত নেতা জ্যাকব রিস মগ প্রমুখ। স্কটল্যান্ডের কনজারভেটিভ নেতা ডগলাস রস নিজের আসনে পরাজিত হয়েছেন।
প্রসঙ্গত, ১৯৯৭ সালের ভোটে সর্বাধিক ৭ জন মন্ত্রী হেরে গিয়েছিলেন। সেবার টনি ব্লেয়ারের নেতৃত্বে বিপুল জয় পেয়ে ক্ষমতায় এসেছিল লেবার পার্টি। সেদিক থেকে মন্ত্রী-বিদায়ের রেকর্ড ভাঙল ২০২৪’র সাধারণ নির্বাচন।
তবে এই টালমাটালের মধ্যেই শাসক এবং বিরোধী উভয় দলেরই  বেশ কয়েকজন ভারতীয় বংশোদ্ভূত সাংসদ হয়েছেন। টোরি দলের হয়ে সংসদে এবার পা রাখছেন শিবানী রাজা। লেস্টার পূর্ব আসনে লন্ডনের প্রাক্তন ডেপুটি মেয়র লেবার পার্টির রাজেশ আগরওয়ালকে তিনি হারিয়ে দিয়েছেন। নিজের নিজের আসন ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছেন প্রীতি প্যাটেল, সুয়েলা ব্রেভারম্যান, ক্লেয়ার কাউন্টিনবোর মতো প্রাক্তন টোরি মন্ত্রীরা।
অন্যদিকে লেবার-পক্ষে প্রীত কাউর গিল, ট্যান ধেসির মতো ভারতীয় বংশোদ্ভূতরা নিজের আসন ধরে রেখেছেন। নতুন সাংসদ হচ্ছেন যশ আতওয়াল। ওয়েলসের প্রথম ভারতীয় বংশোদ্ভূত প্রতিনিধি হিসেবে ব্রিটিশ সংসদে প্রবেশ করছেন কণিষ্ক নারায়ণ।
ব্রিটেনের নতুন প্রধানমন্ত্রী স্টার্মারকে এদিন অভিনন্দন জানিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সহ অন্যান্য রাষ্ট্রপ্রধানরা।

Comments :0

Login to leave a comment