মণ্ডা মিঠাই — নতুনপাতা
দলছুট এক পয়লা বৈশাখ
সৌরভ দত্ত
সব সন্ন্যাসী আছো?আছি।চৈত্রের পাতা ওড়াউড়ি শেষ। চলমান জীবনের আয়নায় পয়লা বৈশাখ অর্থাৎ নববর্ষ মানে হৃদয়ে হর্ষ।এ বৈশাখ যোগ্য-অযোগ্যের চাকরিহারার কান্নায় নিমজ্জিত।বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে! স্কুলের হেডমাস্টারদের কাছে দাঁতন বালা গ্রিটিংস পাঠাচ্ছে।একটা ঠকে যাওয়া বৈশাখ।আমি তো সেই ছাব্বিশ হাজারের… বলেই কেঁদে উঠলেন কেমিস্ট্রি স্যার। আমাদের স্কুলে বিশু পাগল আর পাগলা ঘন্টি বাজাবে না।ওর ছুটি হয়ে গেছে।টো টো কিনে নিয়েছে একটা।গাদিয়াড়ায় মোহনার কাছে ভাড়া খাটবে।অতীতের পৃষ্ঠাকে টেনে এনে নবতর সময়ের রোজনামচা। নিদাঘ অরণ্যে রাঙা বুলবুলি পাখির নাচ। আবার কখন নেমে আসবে কালবৈশাখী। জীবন থেকে বছরগুলো কিরকম ফুড়ুৎ হয়ে যাচ্ছে না! শৈশবের রেশ ধরে বার্ধক্যের দিকে হেঁটে চলা। সংবাদপত্রের পাতা জুড়ে জুয়েলার্সের বিজ্ঞাপন।যাত্রা পাড়ায় নতুন কি কি পালা এলো এ নিয়ে যথেষ্ট উৎসাহ থাকত তখন।বল কি নটবর!এখন ফেসবুক আর ইয়াহু মার্কা রিলস রিলিজের মহোৎসব, ফুড ব্লগিং, পডকাস্ট এর রমরমা।তার মাঝেও বৈশাখী আনন্দের আয়োজনটুকু আছে। হাফহাতা জালি গেঞ্জি পরে চলনে বসে গলদঘর্ম হয়ে দাদুর হাতপাখা তৈরি।ছুরিটার বিশেষত্ব অদ্ভুত হাতির দাঁতের বাঁট।হাতপাখায় সুনিপুণ কারুকাজ।একটু পরেই হয়ত কাশীদাসী মহাভারত নিয়ে পাশের বাড়ির মন্টুখুড়ো এসে বসবেন।ভাঙা কুঠুরির ফাঁক দিয়ে পায়রাগুলো ঝটাপট উড়তে থাকবে। দিব্যেন্দু স্যার যাবেন কলেজ স্ট্রিট এ বইপাড়ায়। পাবলিশার্স এর ঘর থেকে বৈঠকী আড্ডা শেষে ঝোলায় পুরে নেবেন নববর্ষের ক্যালেন্ডার আর মিষ্টির বাক্স।মিঠাইরা ভাবে কবে ছুটি পড়বে স্কুলে! রাঙাকাকুর সাথে ডুবসাঁতার দেবে ঝিনুক তুলবে।মন ভালো নেই অমরেশের মুম্বাই ইন্ডিয়ান্স একের পর এক ম্যাচ হারছে। স্মৃতি জড়িয়ে থাকে মানুষের সাথে। তার সাথে বসত করে শাশ্বত বাঙালিয়ানা।তার কোনো সেলফি হয় না।মা স্কুল থেকে ফেরার পথে রামের দোকান থেকে বেনীমাধব শীলের ফুল পঞ্জিকা আনবেন।আর জয়দেব বেনের দোকান থেকে পাঁজি ক্যালেন্ডার।যা সারা বছর টাঙানো থাকবে বাড়িতে। ঘুমের মধ্যে কিসব এলোমেলো ভাবছি।মা তো নেই বহুকাল!কাল তো ডাক্তার এর কাছে অ্যাপয়েন্টমেন্ট।‘এসো হে বৈশাখ…’ বেজে উঠছে মন্দিরতলায়। রঙিন সরবতের আকর্ষণে স্টেশনারি দোকানের হালখাতায় ভিড় জমাচ্ছে কচিকাঁচার দল। মাধবীলতার তলায় মেলা বসেছে ।আড়াই প্যাঁচের জিলাপি ,রঙিন জিভেগজা,টেপা পুতুল।পঞ্চানন্দের পুজো।পাশে বুড়ো দেওয়ানজির মাজার।সম্প্রীতির মেলবন্ধন। হিন্দু-মুসলিম ভাই-ভাই।পুণ্যিপুকুরে অবাক স্নান।উড়ে আসছে কয়েকমন বাতাসা। আইসক্রিম কাকু কুলফি তুলতে ব্যস্ত।তালপাতায় ঘুগনি তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করছে গোপুদা। তখনকার দিনে গ্রামাফোনে রামকুমার চ্যাটুজ্জের টপ্পার পুরাতনী রেকর্ড চালিয়ে দেওয়ার রেওয়াজ ছিল। নতুন জামা, বাটিকের চোস্তা-পাঞ্জাবি আর মিনির জন্য স্কার্ট। ঠাকুমা বোকাভাঁড় ভেঙে দু-পাঁচটাকা দিত চড়কপোতায় চড়কের মেলা দেখার জন্য।ছোটমামা ইজিচেয়ারে শুয়ে নতুন সোভিয়েত দেশ, বসুমতী, নন্দনের আকর্ষণে মশগুল।ভোম্বলদা রোজকার মতো গণশক্তির নতুন পাতায় ডুবে আছে।আর চায়ের কাপে চুমুক লাগাচ্ছে।ক্যাওড়া পাড়ার ধীরেন তালকোয়া কেটে স্কুল মাঠে বিক্রি করতে বসেছে। দমদমের বাবুমামা আর কোন্নগরের বুলুকাকুরা জলভরা সন্দেশ নিয়ে এল।দু-চারটে সাবাড়ও হয়ে গেল দিদিমার অজান্তেই।দিদিমা তখন পানের বাটা গোছাতে ব্যস্ত। এদিকে রান্নাঘরে কাঠের জালে বাটা মশলায় রান্না চলছে ।খিড়কি পুকুর থেকে জাল দিয়ে ধরা বাটা মাছ ভাজা,মৌরলা মাছের ঝোল। ডাঁটা চচ্চড়ি।আমের চাটনি,দই,মিষ্টি।এসব ছিল সেকেলে খাবার এখন রেস্তোঁরায় কব্জি ডুবিয়ে ভুঁড়িভোজ।থালি সিস্টেম চালু। বাঙালির পকেট খালি।স্যান্ডুইচ-পকোড়া-ডাবচিংড়ি-
ভেটকি ভাপ-হাণ্ডিচিকেন হরেকরকম পদ।দাদা আপনার তো কোলেস্টেরল বেশি।এল.ডি.এল বেশি । ফ্যাটি লিভার,পাইলোরি ব্যাকটেরিয়া,ই.কোলাই সব গিজগিজ করছে।মেপেজুপে খান মশাই। এইমাত্র ক্যাফেটেরিয়া থেকে বেরিয়ে সোজা খালাসিটোলা গেল শক্তিদা।চৈত্র সেল থেকে বেরিয়ে প্যারামাউন্টে দাঁড়িয়ে দিব্যি জুস খাচ্ছে সুমিতা আন্টি। স্নান সেরে পাট ভাঙা নতুন জামা পরে বসুঝারায় জল দান।আমলা পিসি আর দিদা যাবে প্রতিষ্ঠা করা অক্ষয় বটের গোড়ায় জল ঢালতে।আজ বৈকালি চালু ।বারকোশ কাঁধে কখনো রক্ষাকারী তলা কখনো মুখুজ্জে বাড়ি চলেছে প্রভাত বোষ্টম। কতরকম ফলমূল।মাসির বাড়ি শিবের গাজন।চলনের কুকুরটার জিভ দিয়ে ক্রমাগত লালা পড়ছে।কাহারদের ‘পালকি চলে!পালকি চলে’ ডাক হারিয়ে গেছে।সারা দুপুর অপেক্ষা করেও মিনি একটাও আইসক্রিমওলার হাঁক পাচ্ছে না।মিশো থেকে সঞ্জয়দার বৌকে কি যেন একটা পার্সেল দিয়ে গেল। তরমুজ কিনে ফিরছিল বেচারা হাবুলটা। রাস্তায় পড়ে ফেটে চৌচির হয়ে গেল।রাস্তাটা চলে গেছে বহুদুর।ফজলি আমের গাছটা অজ্ঞাত কারণে নেই।লেবু তলায় খেলামদলির ঘর। মেজো মামার তুলির টানে ফুটে উঠছে মহাকাল চোখ। ঘাটের কথা, পথের কথা।‘পথিক! তুমি পথ হারাইয়াছ?’ ভাঙা মঞ্চটা সারাই হচ্ছে আবার কি ‘রক্তকরবী’ হবে। নন্দিনী!জাদু কাঠির ছোঁয়ায় পাল্টে যাবে সব। গোধূলি বেলায় দূরে গান বাজছে–‘আমার ভাঙা পথের রাঙা ধুলায় পড়েছে কার পায়ের চিহ্ন!’
Comments :0