Post Editorial Farmers

কৃষকদের ওপরে ন্যানো ইউরিয়া চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে

জাতীয় উত্তর সম্পাদকীয়​

নিশীথ চৌধুরি
 

তথাকথিত নতুন আবিষ্কৃত একটি রাসায়নিক সার ‘ন্যানো ইউরিয়া’র নাম আলোচনায় উঠে আসছে। মৌলিক কোনও  আবিষ্কার না হলেও ইতিমধ্যেই ইন্ডিয়ান ফারমার্স ফার্টিলাইজার কো-অপারেটিভ লিমিটেড বা ‘ইফকো’ এই সংস্থার কনসালটেন্ট জনৈক রমেশ রালিয়াকে এর আবিষ্কারক বলে স্বীকৃতি দিয়ে ন্যানো ইউরিয়ার পেটেন্ট নিয়েছে। সরকার এই সারের বাণিজ্যিক ব্যবহারের অনুমোদন দিতে গিয়ে বলেছে এই সার ব্যবহারে দানা ইউরিয়ার ব্যবহার কমবে এবং দেশের আমদানি খরচ ব্যাপক হারে কমে যাবে। ‘ইফকো’র গুজরাটে অবস্থিত কারখানায় এই সার উৎপাদনের উদ্বোধন করতে গিয়ে দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলেন “ ..... ন্যানো ইউরিয়ার একটি ছোট বোতল (৫০০ মিলিলিটার) বর্তমানে কৃষকদের দ্বারা ব্যবহৃত একটি ৫০ কিলোগ্রাম ওজনের দানা ইউরিয়া ব্যাগের সমতুল্য”। ইফকো বা এই ন্যানো ইউরিয়ার আবিষ্কারক রমেশ রালিয়ার দাবি এই ন্যানো ইউরিয়াতে নাইট্রোজেন রয়েছে যা উদ্ভিদের বিকাশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান, দানার আকারে যা একটা কাগজের শিটের চেয়ে এক লক্ষ গুণ বেশি সূক্ষ্ণ। এই কারণে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র স্কেলে এই ন্যানো ইউরিয়ার উপাদানগুলি অনেক বেশি কার্যকরী হবে। 
এই দাবির সপক্ষে রয়েছে অবশ্যই নরেন্দ্র মোদী নেতৃত্বাধীন সরকার, কিন্তু বাণিজ্যিক ব্যবহারের ছাড়পত্র পাওয়ার পর জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে এই দাবির সত্যতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে বহু গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে ইতিমধ্যেই। বিগত প্রায় দু বছর ধরে ‘দি হিন্দু’ পত্রিকায় এই বিষয়ে অনেক লেখালিখি হয়েছে। সার হিসাবে অবশ্যই ন্যানো লিকুইড ইউরিয়াকে মান্যতা দেওয়া যেতেই পারে, কিন্তু মাত্র ৪ শতাংশ নাইট্রোজেন সমৃদ্ধ এই সার সম্বন্ধে অনাবশ্যক উচ্চ ধারণা প্রচারের সরকারি প্রচেষ্টা কেন, সেটাই সকলকে ভাবাচ্ছে। 
বৈজ্ঞানিক ভাবে এ কথা প্রতিষ্ঠিত যে খাদ্যশস্য বা যে কোনও উদ্ভিদের বিকাশের জন্য প্রধানতম উপাদান হল নাইট্রোজেন এবং ইউরিয়া হল সব চেয়ে বেশি নাইট্রোজেন সমৃদ্ধ রাসায়নিক সার। রাসায়নিক ভাবে প্রচলিত দানা ইউরিয়াতে থাকে ৪৬ শতাংশ নাইট্রোজেন। অর্থাৎ এখনকার ৪৫ কিলোগ্রামের এক ব্যাগ ইউরিয়ায় আছে ২০.৭ কিলোগ্রাম নাইট্রোজেন। ন্যানো ইউরিয়া বিক্রি হচ্ছে ৫০০ মিলিলিটার বা আধা লিটারের বোতলে, তাতে রয়েছে ৪ শতাংশ নাইট্রোজেন অর্থাৎ ৪৩ গ্রাম ইউরিয়া বা মাত্র ২০ গ্রাম নাইট্রোজেন। প্রধানমন্ত্রী বা ইফকোর দাবি একটি আধা লিটারের ন্যানো ইউরিয়ার বোতল ৫০ কিলোগ্রামের এক ব্যাগ ইউরিয়ার সমতূল্য। সাধারণ ভাবেই তো এই দাবি একেবারে অসার এবং অবিশ্বাস্য।
ডেনমার্কের কোপেনহেগেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিপার্টমেন্ট অফ প্ল্যান্ট অ্যান্ড এনভাইরনমেন্টাল সায়েন্স-এর গবেষক ম্যাক্স ফ্রাঙ্ক এবং ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সোরেন হাস্টেড ২৫ জুলাই ২০২৩ তারিখে প্রকাশিত এক ওপিনিয়ান পেপারে ন্যানো লিকুইড ইউরিয়ার বৈজ্ঞানিক সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। গবেষকরা তাদের ওপিনিয়ান পেপারে  বৈজ্ঞানিক প্রমাণের উপর ভিত্তি করে ন্যানো ইউরিয়ার গুণমান এবং বৈশিষ্ট্য সম্পর্কেও সন্দেহ উত্থাপন করেছেন এবং বিশ্বের সুপরিচিত নানাবিধ বৈজ্ঞানিক জার্নালে বিদ্যমান তথ্যাবলির সাথে  ইফকো বা ভারত সরকারের ন্যানো ইউরিয়া সম্পর্কিত দাবির তুলনা করেছেন।  
এর বহু আগে থেকেই ন্যানো ইউরিয়া সম্পর্কিত এই দাবির বিরুদ্ধে আমাদের দেশের কৃষি বিশেষজ্ঞরা তাঁদের বক্তব্য পেশ করেছেন। সেই ২০২২ সালেই চৌধুরি চরণ সিং হরিয়ানা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক এনকে তোমার বলেছেন,  এক টন গম উৎপাদন করতে লাগে ২৫ কিলো নাইট্রোজেন, এক টন চাল উৎপাদনে প্রয়োজন ২০ কেজি নাইট্রোজেন আর সমপরিমান ভুট্টা উৎপাদনের জন্য নাইট্রোজেন লাগে ৩০ কেজি। দানা ইউরিয়ার অথবা ঐ ন্যানো লিকুইড ইউরিয়ার যা মাটিতে দেওয়া হয় বা পাতায় স্প্রে করা হয় তার মধ্যে থাকা সমস্ত নাইট্রোজেন তো আর কাজে লাগে না, সর্বোচ্চ ৬০ শতাংশও যদি ব্যবহারে লাগে তা হলে ৪৯৬ কেজি গম উৎপাদন সম্ভব। আর এমন কি ন্যানো লিকুইড ইউরিয়ার ২০ গ্রাম নাইট্রোজেনের ১০০ শতাংশই যদি কাজে লাগে তা হলেও তা থেকে মাত্র ৩৬৮ গ্রাম (কিলোগ্রাম না, ঠিকই পড়ছেন ৩৬৮ গ্রাম) গম উৎপাদন সম্ভব। অধ্যাপক তোমার ‘নীতি আয়োগ’ ও ‘ন্যাশনাল আকাদেমি অফ এগ্রিকালচারাল সায়েন্স’-এর কাছে লেখা চিঠিতে স্পষ্ট ভাবে উল্লেখ করেছেন যে এই সামগ্রিক প্রচেষ্টা নিরর্থক এবং অর্থের নিছক অপব্যয়। ইফকোর এই দাবি ভিত্তিহীন এবং ভবিষ্যতে কৃষকদের জন্য তা বিপর্যয়কর হবে।  
ড. তোমারের লেখার প্রতিধ্বনিই দেখা যাচ্ছে ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ এগ্রিকালচারাল রিসার্চ-এর প্রাক্তন ডেপুটি ডিরেক্টর জেনারেল আইপি এব্রলের বক্তব্যে। তিনি বলেছেন,”ইউরিয়ার দানা জলে অত্যন্ত দ্রবণীয় এবং তা শোষিত হলে উদ্ভিদের নাইট্রোজেন গ্রহণে সাহায্য করে। কিন্তু ন্যানো ইউরিয়া অনেক ছোট হওয়ায় তা কী ভাবে নাইট্রোজেন গ্রহণের কার্যকারিতা বাড়াতে পারে তা আমার কাছে অস্পষ্ট। পাতার উপর জলে গোলা ইউরিয়া স্প্রে করার ফলে উদ্ভিদের সার গ্রহণের কার্যকারিতা বাড়ে এটা তো অর্ধ শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে জানা। তাহলে এখানে নতুনটা কী?”
কৃষকদের অভিজ্ঞতা 
‘ডাউন টু আর্থ’ নামের এক সুপরিচিত পরিবেশ ও বিজ্ঞান ম্যাগাজিনে এ বিষয়ে পর পর কিছু লেখা বেরিয়েছে। বেশ কিছু কৃষকের সাথে লেখক বিবেক মিশ্র  কথা বলেছেন। বিবেক মিশ্র সাধারণত জাতীয় গ্রিন ট্রাইব্যুনাল, নদী, বায়ু এবং জল দূষণ সম্পর্কিত খবর লিখে থাকেন। মধ্যপ্রদেশের সেহোর জেলার কৃষক প্রবীণ পারমার, হরিয়ানার সোনপত জেলার কুরাড গ্রামের কৃষক সতপাল,  সোনপতের ভাটগাঁও গ্রামের কৃষক পাওয়ান বা পবন ও  আজাদ  ফৌজি, উত্তর প্রদেশের বাগপত জেলার বালি গ্রামের কৃষক সত্যবীর ইত্যাদি নানা জনের সাথে ন্যানো ইউরিয়া ব্যবহারের অভিজ্ঞতা জানতে ওই ম্যাগাজিনের পক্ষে কথা বলে কিছু কথোপকথন তুলে ধরা হয়েছে ঐ সমস্ত লেখাগুলিতে। সকলেরই অভিজ্ঞতা অত্যন্ত খারাপ। প্রবীণ কুমার বলছেন, ২০২২ সালের নভেম্বর মাসে তিনি ন্যানো ইউরিয়া নিয়ে পরীক্ষা করেন তার  ৮ হেক্টর জমিতে গম চাষ করতে গিয়ে এবং অর্ধেক জমিতে বীজ বপনের ২০ দিনের মাথায় ৫ লিটার ন্যানো ইউরিয়া স্প্রে করেন আর বাকি জমিতে দানা ইউরিয়া দিয়ে পুরানো পদ্ধতিতে চাষ করেন। ন্যানো ইউরিয়া স্প্রে করার জন্য তাকে অতিরিক্ত ১০০০ টাকা খরচ করতে হয়। প্রচলিত ইউরিয়া ব্যবহার করা জমিতে ফসলের রং পরিবর্তন এবং পাতা গজালেও ন্যানো ইউরিয়া ব্যবহৃত জমিতে কোনও পরিবর্তন হয়নি। একই ভাবে সতপাল বলছেন ২০২২ সালের নভেম্বর মাসে তিনি গম লাগান তাঁর জমিতে যার ফলন পাওয়া যায় ২০২৩-এর এপ্রিল মাসে। গম লাগানোর ২০-২৫ দিন পরে জমিতে ন্যানো ইউরিয়া স্প্রে করেন, কিন্তু ফসলে কোনও প্রভাব না পড়ায় তাকে প্রচলিত ইউরিয়াও প্রয়োগ করতে হয়। ভাটগাঁও-এর পবন বলেন ২০২২ সালের ৪ নভেম্বর তিনি তার ২৫ বিঘা জমিতে গম লাগান। তখন দানা ইউরিয়ার সঙ্কট চলছিল এবং তিনি ৫০০ মিলি লিটারের ৫ বোতল ন্যানো ইউরিয়া  কিনতে বাধ্য হন। প্রচলিত ইউরিয়া ব্যবহার করে ১২৫ কুইন্টাল গম উৎপাদন হত, কিন্তু বিঘা প্রতি ৫ কুইন্টালের পরিবর্তে গম উৎপাদিত হল মাত্র ৩.৫  কুইন্টাল, মোট ৮৭.৫ কুইন্টাল। ন্যানো ইউরিয়া ব্যবহার করেই এই দশা। ঐ গ্রামেরই আজাদ ফৌজি তুলেছেন খরচের প্রসঙ্গ। এক জন কৃষক প্রচলিত দানা ইউরিয়া কয়েক ঘন্টায় তার জমিতে ছড়িয়ে দিতে পারে। কিন্তু ন্যানো ইউরিয়া ব্যবহার করতে তাকে ট্যাঙ্কের জন্য ভাড়া গুনতে হবে। ন্যানো ইউরিয়া ব্যবহার করতে তার খরচ বেড়ে যাচ্ছে। প্রতি বিঘাতে ২৫ লিটার জল মিশ্রিত ন্যানো ইউরিয়া স্প্রে করতে লাগছে অন্তত ৪০ টাকা। ন্যানো ইউরিয়া ব্যবহারের যে পদ্ধতি নির্দিষ্ট করে দিয়েছে উৎপাদনকারী সংস্থা তা হল-  ১ লিটার জলে ন্যূনতম ৪ মিলিলিটার ন্যানো ইউরিয়া মেলাতে হবে। একটি ৫০০ মিলিলিটারের বোতলে সর্বোচ্চ ৫ বিঘা জমি চাষ করা যাবে। প্রতি বিঘা তে স্প্রে করতে অতিরিক্ত খরচ অন্তত ৪০ টাকা। ৫০০ মিলিলিটার ন্যানো ইউরিয়া বোতলের দাম লেগেছে ২৪০ টাকা  তার সাথে স্প্রে করার খরচ যুক্ত করে মোট খরচ পড়েছে ৪৪০ টাকা, আর ৪৫ কিলোগ্রামের প্রচলিত দানা ইউরিয়া ব্যাগের দাম ২৫০ টাকা।  তাঁর কথায় ৫ বিঘা জমিতে  ন্যানো ইউরিয়া দিয়ে গম চাষ করতে তাকে খরচ করতে হয়েছিল ১১,৯২৫ টাকা। উৎপাদন হবার কথা ছিল ২৫ কুইন্টাল, হল মাত্র ১৭.৫ কুইন্টাল। প্রতি কুইন্টাল ২১০০ টাকা হিসাবে তার আয় হল ৩৬,৭৫০ টাকা, কিন্তু যদি সঠিক উৎপাদন হত তার আয় হত ৫২,৫০০ টাকা। অর্থাৎ একটি মরশুমে বা ৬ মাসে তার ক্ষতি হল ২৫,০০০ টাকা, বছরের হিসাবে ৫০,০০০ টাকা।
বাগপতের অন্য এক কৃষক সত্যবীর বলছেন তাঁকে ও অন্য কৃষকদের বাধ্য করা হচ্ছে ন্যানো ইউরিয়ার বোতল কিনতে। একই অভিজ্ঞতা হরিয়ানা, মধ্যপ্রদেশ ও উত্তর প্রদেশের কৃষকদের। কথাটা সত্যিও, কেন না রসায়ন ও সার মন্ত্রকের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির মার্চ ২০২৩-এর রিপোর্টে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য বলে লেখা হয়েছে যে ইউরিয়ার বিক্রি প্রায় অর্ধেক কমে গেছে ন্যানো ইউরিয়া ব্যবহারের জন্য। 
ন্যানো ইউরিয়ার ফিল্ড ট্রায়াল 
আশ্চর্যের বিষয় হল ন্যানো ইউরিয়ার ফিল্ড ট্রায়াল সম্বন্ধে তেমন কোনও তথ্য নেই, অথচ তড়িঘড়ি তার বাণিজ্যিক উৎপাদন ও বিপণনের জন্য সরকারি অনুমোদন দিয়ে দেওয়া হয়েছে বৈজ্ঞানিক মহলের নানা বিরোধিতা সত্ত্বেও।  ইউরিয়া  সারের দেশীয় উৎপাদন বা আমদানির উপর ভরতুকির পরিমাণ ৮০ হাজার কোটি টাকা থেকে রাশিয়া- ইউক্রেন যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে বেড়ে হয়েছে ২ লক্ষ কোটি টাকা। তা হলে কি এই কারণেই সফল ফিল্ড ট্রায়াল ছাড়াই ন্যানো ইউরিয়াকে জোর জবরদস্তি চাপিয়ে দেবার এটা একটি চক্রান্ত?
ন্যানো ইউরিয়া উৎপাদনের কাঁচা মাল কী, তা প্রকাশ্যে আনা হয়নি। আমরা যেমন জানি দানা ইউরিয়া উৎপাদনের জন্য লাগে অ্যামোনিয়া, কার্বন ডাই-অক্সাইড ও নাইট্রোজেন। কিন্তু ন্যানো ইউরিয়া তৈরি করতে কাঁচা মাল কি তা উৎপাদক সংস্থা ইফকো গোপন রেখেছে পেটেন্ট নেওয়া আছে এই অজুহাতে।
কৃষকরা যা বলছেন তাতে ন্যানো ইউরিয়া ব্যবহারে তাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, উৎপাদন বাড়া তো দূরের কথা কমে যাচ্ছে বহুলাংশে। আর অন্য দিকে বাণিজ্যিকীকরণের আগেকার অন্তত তিন বছরের অর্থাৎ ৬টি শস্য মরশুমের গবেষণালব্ধ ফলাফলে এর উপযোগিতা প্রমাণিত হলেই তা সরকারি ছাড়পত্র পাওয়ার নিয়ম। ন্যানো ইউরিয়ার ক্ষেত্রে সে সমস্ত তথ্য নেই। 
কৃষি বিজ্ঞান কেন্দ্রের জনৈক নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বৈজ্ঞানিক যিনি ন্যানো ইউরিয়ার ফিল্ড ট্রায়ালের সাথে যুক্ত ছিলেন ‘ডাউন টু আর্থ’-কে বলেছেন যে তিনি তাঁর নিজের জমিতে ন্যানো ইউরিয়া ব্যবহার করে কোনও ফল পাননি। আবার ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ এগ্রিকালচারাল রিসার্চের বৈজ্ঞানিকরা বলছেন, কৃষকদের কৃতজ্ঞ থাকা উচিত যে ন্যানো ইউরিয়া ফসল উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে না। বোঝা যাচ্ছে তো ব্যাপারটা? কৃষি বিজ্ঞান কেন্দ্র সোনপতের অবসরপ্রাপ্ত মুখ্য বৈজ্ঞানিক জেকে নন্দালের মতে ন্যানো ইউরিয়া কখনোই দানা ইউরিয়ার বিকল্প হতে পারে না, খুব বেশি করলে দানা ইউরিয়া যে পরিমাণে ব্যবহৃত হয় তার ১৫ থেকে ২০ শতাংশ মাত্রই থাকবে এর ব্যবহার। 
নিয়মানুযায়ী যে কোনও নতূন রাসায়নিক সারের অনুমোদন পেতে ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ এগ্রিকালচারাল রিসার্চ -এর কাছে অন্তত তিন মরশুমের তথ্য পেশ করা জরুরি। ন্যানো ইউরিয়ার ট্রায়াল সম্পর্কে প্রচারিত তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে যে দেশের ৪৩টি স্থানে ১৩টি ফসলের উপর পরীক্ষা করা হয়েছে এবং ২১টি রাজ্যে মোট চারটি ঋতুতে ৯টি ফসল পরীক্ষা করা হয়েছে। কিন্তু যে কোনও একটি নির্দিষ্ট ফসলের উপর অন্তত তিনটি ঋতুর গবেষণালব্ধ ফলাফল নেই। জানা গেছে ইফকোর কাছে একটি ফসলের কেবলমাত্র দুটি ঋতুর ফলাফল রয়েছে। তাও যথেষ্ট ত্রুটিপূর্ণ কেন না দুটি ঋতু মানে এক বছর ধরে, আগের বছর প্রদত্ত ইউরিয়া বা অন্য সারের জন্য জমিতে যে পরিমাণে নাইট্রোজেন থেকে যায় তাই কার্যত যথেষ্ট। এবং এর জন্য উৎপাদনে তেমন কিছু তারতম্য হয় না। সেই কারণে এবং বিভিন্ন বছরে আবহাওয়ার বিভিন্ন পরিবর্তিত অবস্থায় প্রয়োগের ফলাফল পাওয়ার জন্যই তিন বছর ধরে ফিল্ড ট্রায়ালের বৈজ্ঞানিক প্রয়োজনীয়তা।
ইফকো ন্যানো ইউরিয়া সম্বন্ধীয় রিসার্চ শুরু করে ২০১৭ সালে, পরীক্ষাগারে তার প্রয়োগ শুরু হয় ২০১৮ সালে এবং ফিল্ড ট্রায়াল শুরু করা হয় ২০১৯ সালের রবি মরশুমে। ন্যানো ইউরিয়ার কথা বিজ্ঞাপিত হয় ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১ তারিখে, তার বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু করে দেওয়া হয় ২০২১ সালের জুন মাসে ইফকোর কলোল, গান্ধীনগর, গুজরাট প্ল্যান্টে , অনলাইন বিক্রি শুরু হয় জুলাই ২০২১ আর বাণিজ্যিক উৎপাদন ঘোষিত হয় ১ আগস্ট ২০২১ তারিখে। অর্থাৎ সাকুল্যে ২০১৯ সালের রবি শস্য অর্থাৎ শীতকাল থেকে বাণিজ্যিক উৎপাদন ও বিপণনের সময় বা ১ জুলাই ২০২১ পর্যন্ত রবি ও খরিফ মিলিয়ে পাওয়া গিয়েছিল মোট ৪টি মরশুম। তা হলে ফিল্ড ট্রায়ালটা সম্পন্ন না করেই কী ভাবে এমন একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল নরেন্দ্র মোদীর সরকার? সবটাই কি তা হলে দেশের খাদ্য নিরাপত্তাকে বিপন্ন করে অসৎ  উপায়ে ইউরিয়া সারে ভরতুকির পরিমাণ কমানোর উদ্দেশ্যে ? ন্যানো ইউরিয়ার পর ইফকো আবার নিয়ে আসতে চলেছে ন্যানো ডিএপি সার। ডিএপি-ও অন্যতম আর একটি সার যার আমদানির পরিমাণ অনেক বেশি এবং আমদানিতে ভরতুকির পরিমাণও অনেক বেশি। ন্যানো ডিএপি-র ফিল্ড ট্রায়াল নাকি চলছে এবং সেটাও আগামী ভবিষ্যতে একই উপায়ে কৃষকদের ঊপর চাপিয়ে দেবার ব্যবস্থা হবে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তের কৃষকরা ন্যানো ফার্টিলাইজার ব্যবহারে অনীহা প্রকাশ করছেন, দেশি বিদেশি কৃষি বিজ্ঞানীরা সন্দেহ প্রকাশ করছেন অথচ সরকার জোর করে কেন চাপিয়ে দিতে চাইছে এই অপরীক্ষিত সারের ব্যবহার সেটা পর্যালোচনার সাথে সাথে সামগ্রিক প্রতিরোধ গড়ে তোলাটাও জরুরি।

Comments :0

Login to leave a comment