Post Editorial Louha Kapat

লৌহ-কপাট কে ভাঙল

রাজ্য উত্তর সম্পাদকীয়​

পবিত্র সরকার


সম্প্রতি মুম্বাইয়ে তৈরি পিপ্পা বলে একটি ছবিতে নজরুলের ‘কারার ঐ লৌহ-কপাট’ গানটিকে ব্যবহার করা হয়েছে, খ্যাতনামা সঙ্গীত পরিচালক এ আর রহমানের সুরে, অবশ্যেই ভিন্ন একটি সুরে।  তাই নিয়ে সমাজমাধ্যমে তর্ক উত্তাল হয়ে উঠেছে, উভয় বাংলার থেকেই, স্বাভাবিকভাবে, মানুষেরা এই বিতর্কে অংশ নিয়েছেন। এই লেখক ব্যক্তিগতভাবে ছবিটি দেখেনি, শুনেছি এটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে একটি ছবি।  সে অবশ্য মুখবই আর হোয়াটসঅ্যাপের বন্ধুদের কল্যাণে সুরটি শুনেছে।  সুরটি তার কাছে আহা মরি মনে হয়নি।  এটা তার ব্যক্তিগত সঙ্গীত- ও রুচি- বোধের সীমাবদ্ধতা হতেই পারে।  ছবিতে তার ব্যবহারে তার এমন একটা দারুণ সঙ্গতি হয়েছে যার ফলে মূলের অসাধারণ উদ্দীপনামূলক সুরটিকে বর্জন করার একটা যুক্তি খাড়া করা যায়, এমন কথা এখনও কেউ বলেননি।  ফলে আমরা প্রথম প্রতিক্রিয়ায় এই চেষ্টার নিন্দা করেছি, পশ্চিম বাংলার গণতান্ত্রিক লেখক শিল্পী সঙ্ঘের পক্ষে, অন্যান্য অনেক মানুষও যেমন করেছেন।  আমরা মনে করেছি, ওই কাজটিতে নজরুলের অসামান্য গানটির, তার কথা আর সুরের সম্মিলিত নির্মাণ আর বলিষ্ঠ উচ্চারণের এক ধরনের অসম্মান করা হয়েছে।  
তাতে, মুখবই ইত্যাদিতে যেমন হয়, দু-ধরনের প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে।  একটা তো আমাদের পক্ষে, সেটাই ব্যাপকতর।  সেটা স্বাভাবিক ধরে নিয়ে আমরা বলব যে, এই প্রতিবাদের বিপক্ষেও প্রচুর পোস্ট আমরা দেখতে পাচ্ছি।  এতে আমরা একটু অবাক হয়েছি, কারণ নিজেরা, আমাদের অহং-এর দুর্বলতাবশত, একটা ঠিক কাজ করেছি বলে আমাদের বিশ্বাস।  কিন্তু দেখতে পেলাম যে, আমাদের এই বিশ্বাসটাকে প্রশ্ন করার প্রচুর পক্ষ তৈরি আছে।  তাঁদের মধ্যে যাঁরা আমাদের বিজ্ঞপ্তির মুদ্রণপ্রমাদ ধরেছেন তাঁদের কথা ছেড়ে দিয়ে অন্য পক্ষদের কথা বলি।  বলা বাহুল্য, তাঁদের কথারও প্রতিবাদ এবং প্রশ্ন করার মানুষের অভাব হচ্ছে না। ফলে আমাদেরও একটু ইতিবাচক উত্তেজনা তৈরি হচ্ছে—তা থেকেই এই লেখা।  প্রতিবাদ আর তার সমালোচনা আর প্রতিবাদের একটা সমাজততত্ত্ব কীভাবে তৈরি হতে পারে এ নিয়ে সমাজবিজ্ঞানীরা ভাবতে শুরু করতে পারেন।  

যাঁরা আমাদের এই ঘটনাটির সমালোচনার বিরুদ্ধে, তাঁরা সকলে অবিশেষজ্ঞ বা যোগ্যতাহীন নন।  নানা বিষয়ে তাঁদের অনেকের মতামতের প্রতি আমরা শ্রদ্ধা পোষণ করি।  তাঁদের মধ্যে নানা দল আছে, আবার দলের মিশ্রণও আছে। কিন্তু মত বা অমতগুলিকে আমরা এই ক-টি ভাগে ভাগ করে দেখি।
প্রথম দল ও তার যুক্তি:  রহমান ‘মুসলমান’ বলে কোনও এক ‘ইসলামোফোবিয়া’ থেকে আমরা তাঁকে আক্রমণ করছি।  নজরুলকে অবশ্যই আমরা ‘মুসলমান’ বলে সেভাবে গণ্য করি না, কিন্তু তা সত্ত্বেও এই যুক্তি আমাদের কাছে হাস্যকর মনে হয়েছে।  তা হলে তাঁদের দেখানো উচিত ছিল যে স্রষ্টা মুসলমান হলেই আমরা এই ধরনের আক্রমণ করে থাকি।  আমাদের ইতিহাসে এ ধরনের কোনও ধারাবাহিক দৃষ্টান্ত তাঁরা দেখাতে পারবেন বলে মনে হয় না।  আর, আমাদের সমালোচনা রহমানের বিরুদ্ধেও নয়।  রহমানকে দিয়ে যাঁরা এই কাজ করিয়েছেন তাঁরাও দায়ী, তাতে নজরুলের বংশধরদের দায়ও হয়তো একটু থেকে যায়।  কারণ, তাঁদের এই শর্ত করা উচিত ছিল যে, নজরুলের সুর তাঁরা কোনওক্রমেই বদলাতে পারবেন না।  বলা দরকার যে, আমাদের ‘ইসলামোফোবিয়ার’ ইঙ্গিত কোনও মুসলমান বন্ধু বা তাঁদের প্রতিষ্ঠান করেননি, এ নিয়ে উদ্বিগ্ন হিন্দু বন্ধুরাই করেছেন।  
দ্বিতীয় দল ও তাঁদের যুক্তি:  (সুরের কথায় এসে পড়ল)—এটা যে নজরুলের সুর তার প্রমাণ কী ? হ্যাঁ, এ কথা ঠিকই যে, রবীন্দ্রসঙ্গীতের যেমন একটা ভালোরকমের প্রামাণিক স্বরলিপি-দস্তাবেজ তৈরি হয়েছে, নজরুলের ক্ষেত্রে তা হয়নি।  নজরুলের বেশ কিছু গানে অন্যদের সুর আছে, তা নথিবদ্ধ।  কিন্তু এ গানটি নিয়ে এ পর্যন্ত বিশেষ বিতর্ক ওঠেনি।  তবু কেউ কেউ এ প্রশ্ন তুলেছেন।  নজরুল গবেষকেরাও অবশ্য গানটির রচনার উপলক্ষ্য (দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের জেলবাস, বাসন্তী দেবীর অনুরোধ, মুজফ্‌ফর আহমদের সাক্ষ্য ইত্যাদি ) উদ্ধার করে দেখিয়েছেন যে, সব রকম সাক্ষ্যই বলে মূল সুরটা, অন্তত এই গানটির ক্ষেত্রে নজরুলের।  আমাদের মতে সুরের অন্তত অন্তর্গত সংগঠন আর বিদ্রোহের ঝাঁজও সেই সাক্ষ্য দেয়— যা নজরুলের ব্যক্তিত্বের একটা দিকের সঙ্গে সম্পূর্ণ সঙ্গতিপূর্ণ।  এই সাক্ষ্যগুলিকেও যদি তাঁরা অস্বীকার করেন তবে তাঁদের হয়তো বলতে হবে, সুরটি অন্য কে দিয়েছিলেন।  সে দায়িত্ব তাঁরা নেননি, তা নিয়ে আমাদের কোনও অভিযোগও নেই।  আর তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নিই, ধরে নেওয়ার কোনও কারণ না থাকা সত্ত্বেও, যে সুরটি নজরুলের রচনা নয়, তাহলেও আমাদের যুক্তি হল, স্বাধীনতার অনেক আগে থেকে বাঙালির ইতিহাস আর সংস্কৃতি এই সুরটিকে নজরুলের বলেই গ্রহণ আর ব্যবহার করে এসেছে, তারও একটা বৈধতা আছে।  তাকে অসম্মান করার অধিকার কারও নেই।  ধরে নিই এ সুরটা বাঙালি সংস্কৃতির ইতিহাসের সৃষ্টি।  তাতে এটা বদলানোর অধিকার এসে যায়?
তৃতীয় দল ও তাঁদের যুক্তি:  বন্দেমাতরম্ নিয়ে বা রবীন্দ্রসঙ্গীত নিয়ে যখন এই স্বাধীনতা নেওয়া হয় তখন আমরা প্রতিবাদ করি না কেন ?  এতে আমাদের নানা রকমের প্রশ্ন জাগে।  প্রথমত, প্রতিবাদ করি না, বা করিনি, এটা তাঁরা কীভাবে জানলেন ?  শুধু কি ফেসবুকই প্রতিবাদের জায়গা ?  আর দ্বিতীয়ত, এগুলি কি আদৌ তুলনীয় ?  বন্দেমাতরমের সুর বঙ্কিমচন্দ্র কী দিয়েছিলেন তা টিকে নেই, রবীন্দ্রনাথের দেশ রাগের সুরটি আমরা প্রায়শই শুনি। কিন্তু একটা গানে যদি রচয়িতা নিজে সুর না দিয়ে থাকেন বা তাঁর সেই সুর বেঁচে না থাকে, তাতে অন্যরা সুর দিতে পারেন, এটা আমাদের কেন, পৃথিবীর নানা সংস্কৃতিই স্বীকার করে নিয়েছে।  দেবজিত বন্দ্যোপাধ্যায় গবেষণা করে দেখিয়েছেন যে, বন্দেমাতরমের সম্ভবত ১০৫টির মতো সুর তৈরি হয়েছে।  সেগুলির গুণাগুণ বা অন্যান্য মহিমা অনুযায়ী জনপ্রিয় হয়েছে বা আড়ালে চলে গেছে।  কেউ কেউ বলেছেন যে, রহমান ‘বন্দেমাতরম্’ নিয়েও ছেলেখেলা করেছেন।  আমরা তা মনে করি না।  তাঁর ‘মা তুঝে সেলাম’ শীর্ষক চমৎকার গানটিতে তিনি ‘বন্দেমাতরম্’ কথাটিকে ব্যবহার করেছেন মাত্র, আর কিছু নয়।  যেমন করেছেন রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘একসূত্রে বাঁধিয়াছি’ গানে, বা হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, ‘জাগৃতি’ নামে হিন্দি ছবিতে, ‘আও বচ্চেঁ তুমে দিখাও ঘাঁটী হিন্দুস্তানকী’ গানে।  কিন্তু এখানে রহমান পুরো গানটিকেই ব্যবহার করেছেন। 
রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে নানা বিতর্কের বিষয়ে আমরা নানা জায়গায় লিখেছি।  সেখানও দেখব যে, সভাসমিতিতে অভিকরণে যত স্বাধীনতা নেওয়া হয়, তার চেয়ে অনেক কম হয় সিডি-ক্যাসেটে।  সেটা যখন হয়েছে, তখন জনমত তাকে প্রত্যাখ্যান করেছে, এটাই সচরাচর দেখা গেছে।  
অন্যদের বেলায় ‘প্রতিবাদ হয়নি’ (ভুল বা অসম্পূর্ণ তথ্য) বলে নতুন প্রতিবাদযোগ্য ঘটনাতেও চুপ করে থাকতে হবে, এই যুক্তির অর্থ আমাদের কাছে স্পষ্ট নয়।  কে কখন প্রতিবাদযোগ্য ঘটনায় প্রতিবাদ করবে তার কি কোনও সংবিধান রচিত হয়েছে।  এটা কি একটা ‘প্রিসিডেন্স’ তৈরি করার ব্যাপার— যেমন আজকাল দেখানও হয় যে, ‘ওরাও চুরি করেছিল, কম কম করে হলেও, তাই আমরা আজকাল আরও বেশি বেশি করে চুরি করছি !’ প্রিসিডেন্ট থাকলেই অনুমোদন ? 
চতুর্থ একটা দলের যুক্তি হল, শিল্পের প্রয়োজনে স্বাধীনতা নেওয়া হয়নি তো ?  আমাদের প্রশ্ন, শিল্পের প্রয়োজনটা কী ? হ্যাঁ, সত্যজিৎ ফিল্মে রবীন্দ্রসঙ্গীতের অসাধারণ ব্যবহারের পাশাপাশি, ‘চারুলতা’য় যেমন ‘চিনি গো চিনি তোমারে’তে কিশোরকুমারকে দিয়ে হারমোনাইজেশন করিয়েছেন সৌমিত্রর গলায়।  সেটাকে ওই চরিত্রের উচ্ছ্বাস প্রকাশের একটা সংগত প্রকাশ বলাই যায়, তাকে আমাদের অস্বাভাবিক মনে হয়নি।  আমাদের সঙ্গে অনেকের মত নাও মিলতে পারে।  কিন্তু ‘পিপ্পা’র ক্ষেত্রে ভিন্ন সুরের ব্যবহারে শিল্পের কোনও উৎকর্ষ ঘটেছে কি ?  আমি দেখিনি বলে এই প্রশ্ন করছি, যাঁরা দেখেছেন তাঁদের কাছে।  যদি তাঁরা বলেন যে, হ্যাঁ, গান আর ছবি দুয়েরই দারুণ উৎকর্ষ ঘটেছে, তা হলে আমরা প্রতিবাদ প্রত্যাহারের কথা ভাবতেই পারি।  
এই সব নানা ধরনের সমালোচনার মধ্যে আমরা কাজটা ঠিক করেছি কি না তাই নিয়ে, একটু ঘাবড়ে যেতে যেতেও, মনে করছি, ঠিকই করেছি।

Comments :0

Login to leave a comment