Post Editorial

শিক্ষা বিপন্ন, শিক্ষকরাও বিপন্ন

উত্তর সম্পাদকীয়​


নিলয়কুমার সাহা

আজ শিক্ষক দিবস। দার্শনিক, শিক্ষাবিদ এবং মানবতাবাদী ড. সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণের জন্মদিন। ১৯৬২ সালের ৫ সেপ্টেম্বর ড. সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণের ৭৭তম জন্মদিনটিকে তদানীন্তন ভারত সরকার শিক্ষক দিবস হিসাবে ঘোষণা করে এবং সেই থেকে সারা দেশে ৫ সেপ্টেম্বর শিক্ষক দিবস পালিত হয়। ড. রাধাকৃষ্ণণ বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্ণ স্বাধিকারের পক্ষে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজকর্মে সরকার ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের হতক্ষেপের বিরুদ্ধে আপসহীন ছিলেন। ১৯৩১ সালে ড. রাধাকৃষ্ণণ অন্ধ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পদ অলঙ্কৃত করেন এবং শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে একমাত্র মেধাকে বিবেচনার পাশাপাশি এই বিষয়টিকে সরকারি হস্তক্ষেপ থেকে মুক্ত করেছিলেন। এই পথ অনুসরণ করেই তিনি বহু বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ যেমন ভি কে আর ভি রাও, সি ভি রামন, এম ভিশ্বেশ্বরীয়াকে শিক্ষক হিসাবে শিক্ষাঙ্গনে যুক্ত করেছিলেন। ড. রাধাকৃষ্ণণ সর্বান্তকরণে বিশ্বাস করতেন দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি তখনই জ্ঞানের মন্দির হয়ে উঠবে যখন প্রতিষ্ঠানগুলিকে সম্পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন দেওয়া হবে। রাধাকৃষ্ণণ মনের স্বাধীনতা, ব্যক্তির সম্মান এবং গণতন্ত্রের উপর গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। একজন আদর্শ দার্শনিক হিসাবে তিনি বিশ্বাস করতেন বিবর্তন অন্ধ এবং যান্ত্রিক হবে না, অবশ্যই তার কিছু উদ্দেশ্য থাকবে। প্রকৃত শিক্ষাই একজন ব্যক্তিকে এই উদ্দেশ্য পূরণে সক্রিয় অংশগ্রহণে সাহায্য করে। ১৯৪৮ সালে স্বাধীন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলির উপাচার্য নিয়োগ সংক্রান্ত বিধি চূড়ান্ত করতে ড. সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণের নেতৃত্বে ‘রাধাকৃষ্ণণ কমিশন’ গঠিত হয়। এই কমিশন উপাচার্য নিয়োগের ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধিকারকেই সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছিল। ‘রাধাকৃষ্ণণ কমিশন’-এর পদাঙ্ক অনুসরণ করে ১৯৬৪ সালে ড. ডি এস কোঠারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালন ব্যবস্থা সম্পর্কে বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধিকার হবে বাহ্যিক নিয়ন্ত্রণ মুক্ত গণতান্ত্রিক প্রশাসনিক ব্যবস্থা নির্ভর এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতি ও কার্যক্রম চূড়ান্ত হবে শিক্ষার সাথে যুক্ত সকল শ্রেণির কার্যকরী অংশগ্রহণে।’’ দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে এই সকল শিক্ষাব্রতীর প্রত্যাশা আমাদের রাজ্যে বর্তমানে কতটা বিপন্ন, শিক্ষক দিবসে যে পর্যালোচনা অত্যন্ত জরুরি।  

রাজ্যের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বর্তমান অবস্থা 
২০১১ সালে রাজ্যে রাজনৈতিক পালা বদলের পর ক্ষমতাসীন তৃণমূল সরকার বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গণতান্ত্রিক পরিচালন ব্যবস্থা ভেঙে দিয়ে মনোনীত পরিচালন ব্যবস্থা কায়েম করে। বিদ্যালয় ব্যবস্থাপক সভা, মহাবিদ্যালয় পরিচালন সমিতি, বিশ্ববিদ্যালয় সিনেট, সিন্ডিকেট, কোর্ট, কাউন্সিল সব জায়গাতেই শাসক দলের অনুগামীদের একাধিপত্যে রাজ্যের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে আক্রান্ত হয়েছে গণতান্ত্রিক পরিসর, রুদ্ধ হয়েছে বিরোধী কণ্ঠস্বর এবং বিলুপ্ত হয়েছে প্রাতিষ্ঠানিক স্বাধিকার। রাজ্য প্রশাসনে স্বেচ্ছাচারিতায় ২০১৬ সালে শেষবারের মতো মহাবিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে ছাত্র নির্বাচন হওয়ার ফলে দীর্ঘ সাত বছর স্থানীয় তৃণমূল নেতৃত্বের অনুগামী ‘সম্পদ’ কর্তৃক রাজ্যের অধিকাংশ উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে অধ্যক্ষদের প্রশ্রয়ে অনৈতিকভাবে পরিচালিত হচ্ছে ছাত্র সংসদ। ভর্তি প্রক্রিয়া, বাৎসরিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, ক্রীড়া প্রতিযোগিতা, শিক্ষামূলক ভ্রমণ, প্রতিষ্ঠানের আলপিন খরিদ থেকে গৃহ নির্মাণ সর্বত্রই ‘কাটমানির’ হাতছানিতে তথাকথিত এই ‘সম্পদ’দের উচ্ছৃঙ্খল দাপাদাপিতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি তৃণমূলের দলীয় কার্যালয়ে পর্যবসিত হয়েছে। মধ্যশিক্ষা পর্ষদ, প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদেও গণতান্ত্রিক নির্বাচন হয় না। সেখানে শিক্ষক, অভিভাবকদের কথা বলার কোনও জায়গাই নেই। যে দুর্নীতি ওই সব সংস্থা থেকে প্রবাহিত হয়েছে তার অন্যতম কারণ পরিচালন ব্যবস্থাকে গণতন্ত্রহীন করে তোলা।


বর্তমান শিক্ষা বর্ষে রাজ্যে জাতীয় শিক্ষানীতি কার্যকর হয়েছে এবং এই নীতি অনুসারে চার বছরের স্নাতক স্তরে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ব্যাপক হারে হ্রাস পেয়েছে। রাজ্য সরকার পোষিত মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলির অবস্থাও ভালো নয়। ইতিমধ্যে রাজ্য সরকার আট হাজারেরও বেশি বিদ্যালয়কে চিহ্নিত করেছে যে বিদ্যালয়গুলির শিক্ষার্থীর সংখ্যা পঞ্চাশেরও কম। শোনা যাচ্ছে ‘জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০’র নির্দেশিকা অনুসারে এই বিদ্যালয়গুলিকে নিকটবর্তী কোনও বিদ্যালয়ের সাথে জুড়ে দেওয়া হবে। এই মহান কর্মসূচি বাস্তবায়িত হলে রাজ্যের বহু বিদ্যালয়ের অস্তিত্ব বিলীন হবে কালের গর্ভে। স্বাধীন ভারতবর্ষে এই প্রথম কেন্দ্র এবং রাজ্য উভয় সরকারই সরকারি আনুকূল্যে শিক্ষা সম্প্রসারণ নীতি থেকে সরে এসে শিক্ষা সঙ্কোচনের পথকেই বেছে নিয়েছে। কোভিড-উত্তর পরিস্থিতিতে রাজ্যে বিদ্যালয়ছুট শিক্ষার্থীর সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলেছে। এই সঙ্কটের মুহূর্তে মূল সমস্যায় আলোকপাত না করে রাজ্য সরকার শিক্ষার্থীদের জন্য ঘোষণা করে চলেছে নানান প্রকল্প। এগুলি বাস্তবে রূপায়ণ হয় না। শিক্ষার প্রসার এবং মানোন্নয়নে যদি এই সব প্রকল্প সদর্থক ভূমিকা পালন করে থাকে তবে কোন যুক্তিতে ২০২৩ সালে রাজ্যের মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীর সংখ্যা এক লহমায় দু’লাখ কমে যায়? রাজ্য সরকার পোষিত প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলির অবস্থা অত্যন্ত সঙ্কটজনক। কোথাও শিক্ষার্থীর তুলনায় শিক্ষক অপ্রতুল, কোথাও বা শিক্ষার্থীর অভাবে ধুঁকছে প্রাথমিক বিদ্যালয়। এই অবস্থার সুযোগ নিয়ে রাজ্যের প্রস্তাবিত শিক্ষানীতি কেন্দ্রীয় নীতিকে মান্যতা দিয়ে রাজ্যের প্রাক-প্রাথমিক স্তরকে অঙ্গনওয়াড়ির সাথে যুক্ত করার সুপারিশ করেছে। অথচ অঙ্গওয়াড়ি কর্মসূচির অবস্থাই অত্যন্ত খারাপ, রাজ্য সরকারের কোনও মনোযোগই নেই। জাতীয় শিক্ষানীতিতে কেন্দ্রীয় সরকার শিক্ষা বিস্তারে ‘পিপি মডেল’ অর্থাৎ পাবলিক ফিলান্থ্রপিক মডেলকে উৎসাহিত করেছে। আমাদের আশঙ্কা কেন্দ্রীয় সরকার এই পরিকল্পনার মাধ্যমে শিক্ষার বেসরকারিকরণের পাশাপাশি সঙ্ঘ পরিবার পরিচালিত হাজার হাজার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে মূল ধারার শিক্ষা ব্যবস্থার সাথে যুক্ত করে শিক্ষায় গৈরিকীকরণের অ্যাজেন্ডাকে কার্যকর করবে।  
    
রাজ্যের অসহায় শিক্ষক সমাজ
এ রাজ্যের স্কুল বা কলেজের শিক্ষক-অধ্যাপকদের কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে কাজ করতে হচ্ছে। 
সারা রাজ্যের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে উশৃঙ্খল তৃণমূল বাহিনীর অনৈতিক কাজের বিরুদ্ধে যে শিক্ষক, শিক্ষাকর্মী যখনই সরব হয়েছেন, তখনই তাঁকে লাঞ্ছিত হতে হয়েছে, হতে হয়েছে আক্রান্ত। রাজ্যের পালা বদলের পরই খুন হন বিদ্যালয় শিক্ষক জিতেন নন্দী। পরবর্তী সময়ে রাজ্যের মহাবিদ্যালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকগণ ‘ছোট ছোট ছেলেদের’ আক্রমণের লক্ষ্য বস্তু হয়ে ওঠেন। রায়গঞ্জে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষকে গাছে দড়ি দিয়ে বেঁধে মার, ভাঙড় কলেজে জনৈক অধ্যাপিকাকে লক্ষ্য করে কলেজ পরিচালন সমিতির সভাপতির জলের জাগ ছুঁড়ে মারা, সমাজ মাধ্যমে কার্টুন শেয়ারের অপরাধে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বরিষ্ঠ এক অধ্যাপককে চূড়ান্ত হেনস্তার পর গ্রেপ্তার, সরকারি জুলুমের প্রতিবাদ করায় শাসক দলের ছাত্র নামধারী বহিরাগত দুষ্কৃতীদের হাতে শারীরিক নিগ্রহের শিকার হন সারা দেশের অন্যতম সুপ্রাচীন কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের একধিক বিভাগের অধ্যাপকবৃন্দ। এইসব ঘটনা ক্রমে মহামারীর রূপ নিয়েছে। 
বিশ্ববিদ্যালয়গুলির পরিচালন ব্যবস্থা হাসির খোরাক হয়ে উঠেছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে একশো শতাংশ দলীয় কর্তৃত্ব কায়েম করার লক্ষ্যে তৃণমূল সরকার রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলির আচার্য পদে রাজ্যপালকে সরিয়ে মুখ্যমন্ত্রীকে বসাতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। রাজভবন এবং নবান্নের এই কৃত্রিম লড়াইয়ের আড়ালে গভীর রাজনৈতিক সমঝোতায় রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলির পরিচালন ব্যবস্থা যখন বিপর্যস্ত ঠিক সেই সময় বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি আয়োগের নিয়ম নীতি উপেক্ষা করে রাজ্যপাল নিয়োগ করে চলেছেন অস্থায়ী উপাচার্য। কে কখন কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হচ্ছেন এবং সরে যাচ্ছেন তার হিসেব রাখাই কঠিন। সাম্প্রতিক কালে রাজ্যপাল এবং রাজ্য সরকারের দড়ি টানাটানির মধ্যে অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থায়ী উপাচার্যই নেই। এক বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজ্যপালের মনোনীত উপাচার্য বলেছেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে গিয়ে কাজ করার মতো পরিস্থিতিই নেই, তিনি বাড়িতে বসেই কাজ করবেন। 
অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলেও যে সত্য অনস্বীকার্য তাহলো, রাজ্যব্যাপী শিক্ষক নিগ্রহের ঘটনায় সরকারপন্থী এক দল শিক্ষক নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে চলেছেন। তাঁদের অনেকেই শিক্ষা এবং শিক্ষা বহির্ভূত যে কোনও বিষয়ে বৈদ্যুতিন মাধ্যমে ‘বিশেষজ্ঞ’ হিসাবে চৌত্রিশ বছরের উদাহরণ টেনে এনে বর্তমান সময়ের নানান কেলেঙ্কারিকে ধামাচাপা দিতে মরিয়া হয়ে ওঠেন। আজ শিক্ষক দিবসে সেই সকল ‘মহাজনদের’ কাছে বিনীত প্রশ্ন– আপনারা কোন সময়ে কাকে কত ‘প্রণামী’ দিয়ে, কোন নেতার ‘চিরকুট’এর জোরে কর্ম জীবনে প্রবেশ করেছিলেন? পশ্চিমবঙ্গে নজিরবিহীন নিয়োগ দুর্নীতি সম্পর্কে কেন আপনারা নীরব? একবার ভেবে দেখতে অনুরোধ করি সেই সব ‘সর্বজ্ঞ’কে যদি নিজের ঘরের মেধাবী সন্তানকে হকের চাকরি চুরি যাওয়ার বিরুদ্ধে প্রায় দু’বছর মহানগরীর রাজপথে বসে ন্যায় বিচারের আশায় বিনিদ্র রজনী কাটাতে হতো, কী করতেন তাঁরা?
    
 

Comments :0

Login to leave a comment