‘ভারত: মোদী প্রশ্ন’ নামে ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশন বা বিবিসি প্রমাণ্য তথ্যচিত্র প্রকাশ করে। তাতে ২০০২ সালের ফেব্রুয়ারি- মার্চে গুজরাটের ভয়াবহ দাঙ্গা ও মুসলিমনিধনের শিউরে ওঠার মতো ঘটনায় তৎকালীন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ভূমিকা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন তুলে ধরা হয়। প্রামাণ্য এই চলচ্চিত্রে স্পষ্টভাবে বলা হয় এই দাঙ্গার জন্য নরেন্দ্র মোদী প্রত্যক্ষভাবে দায়ী। এই নতুন সিরিজের প্রথম অংশ বিবিসি সম্প্রচার করে। রিপোর্টের বয়ান ব্রিটিশ সরকারের উদ্যোগেই সে সময়ের তৈরি তদন্ত দলিল নির্ভর।
সংশ্লিষ্ট দৃশ্য ও ছবিও তাতে তুলে ধরা হয়। এই সরকারী অনুসন্ধান রিপোর্টের এক জায়গায় বলা হয়েছে নরেন্দ্র মোদী ও তাঁর দল দাঙ্গা বন্ধ না করার জন্য প্রত্যক্ষভাবে দায়ী । ধারাবাহিক হিংসা উত্তেজনার রিপোর্টে পরপর ঘটনায় দেখানো হয় যেখানে একটা সম্প্রদায়কে গণহত্যার মধ্য দিয়ে নির্মূলীকরণের ছাপ রয়েছে। ডকুমেন্টারির ভিডিও লিঙ্ক মুছে দিতে ভারত সরকার ইউটিউব এবং টুইটারকে নির্দেশ দেয়, ভারতে এই ডকুমেন্টারির প্রদর্শন সরকার নিষিদ্ধ করে। এই পদক্ষেপের বিরুদ্ধে বিরোধীরা তীব্র সমালোচনা করে যে স্বাধীন মতামত প্রকাশের উপরে সর্বত্র হস্তক্ষেপ করছে। বিজেপি’র সবার এক জবাব- বিবিসি সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত সংগঠন, সাংবাদিকদের নামে বা ছদ্মবেশে বিবিসি কুৎসা করছে। এই ঘটনার পরপরই সরকারের আয়কর দপ্তর বিবিসি’র দিল্লি আর মুম্বাই অফিসে তল্লাশিতে যায়। আইন অনুসারে তার নাম দেওয়া হচ্ছে আয়কর বিভাগের ‘সমীক্ষা’। ভারতের মিডিয়াগুলির উপর মোদী দিল্লির ক্ষমতায় আসার পর থেকে একইভাবে আর্থিক হেনস্তা চলছে, বিশেষত সরকারের কোনও সমালোচনা করা হলে মিডিয়াকে সরকার বরদাস্ত করবে না এই মনোভাবই বারবার প্রকাশ পেয়েছে। এর আগে নিউজক্লিক ওয়েবসাইটের ওপরও তা চলে। ২০২১ সালে মত প্রকাশের মৌলিক অধিকার শীর্ষ আদালতের রায়ে বলা হয়। যে কোনও গণতান্ত্রিক সংবিধানের মত অনুসারে সুপ্রিম কোর্টে বারবার এই অধিকার রক্ষা করে। লোকসভায় প্রদত্ত তথ্য থেকে দেখা যায় ২০১৮-২০২২ সালের মধ্যে মোট ২৯ হাজার ১৫৪টি ওয়েব পেজ সরকার আটকে দিয়েছে বা ব্লক করে রেখেছে। সরকারিভাবে তা প্রকাশ করা হয় না। সুপ্রিম কোর্টের ২০২০ সালের রায়ের বিরুদ্ধে যায় এটা। ভারত সরকারের বিভিন্ন মুখপাত্র বলেই চলেছেন এ ধরনের কুৎসামূলক ডকুমেন্টারি ভারতের সার্বভৌমত্ব ধ্বংস করতে চায়, এজন্য এই চলচ্চিত্রকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং এই ডকুমেন্টারি সম্প্রচারের পেছনে সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন মুখ দিয়ে ঘন ঘন বলানো হচ্ছে এগুলি ভারত-বিরোধী কার্যকলাপের অংশ। ২০১৪ সাল থেকে দেখা যাচ্ছে ভারতের অনেকগুলি মিডিয়ার সংস্থার উপর চাপ বাড়াতে এইভাবে নানা কায়দায় তাদের ভীত সন্ত্রস্ত করা হয়েছে। বিভিন্নভাবে সরকার বিবিসি’র দুই অফিস তল্লাশির ব্যাপারে নানা ব্যাখ্যা দিতে ব্যস্ত, কোনও মন্তব্য আয়কর দপ্তরের নেই। বিবিসি কোনও বাধা দেয়নি। বিবিসি’র এই ডকুমেন্টারিতে প্রকাশ করা হয়েছে যে তখনকার ব্রিটিশ সরকারের অনুসন্ধান-নির্ভর দলিল থেকেই বিবিসি উদ্ধৃতি দিয়েছে, বানানো নয়। আর ব্রিটিশ সরকারের সেই দলিলেই বলা হয়েছে দাঙ্গায় মোদীর ভূমিকার উপরোক্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন ।
‘দি গার্ডিয়ান’ পত্রিকা গোড়া থেকেই বলেছে ব্রিটিশ সরকার বিবিসি অফিস তল্লাশি নিয়ে মন্তব্য করতে অস্বীকার করেছে। সরকারের কাছ থেকে বিবিসি কোনও রাজনৈতিক সহায়তাও চায়নি, এই রিপোর্টে বলা হয়েছে বিবিসি ডকুমেন্টারিতে ব্রিটিশ সরকারের সেই সময়কার দলিল থেকেই উদ্ধৃতি আছে যেখানে সেই সময়কার দাঙ্গায় মুসলিমদের হত্যাকাণ্ড বন্ধ করতে না পারার জন্যই শুধু মোদীকে সরাসরি দায়ী করা নয়, এই সরকারি দলিলে বলা হয়েছে এই হিংসাত্মক ঘটনায় গণহত্যার সব ছাপই রয়েছে ।
ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে ব্রিটিশ সংসদে বিরোধী লেবার পার্টির সাংসদরা সরকারের তীব্র সমালোচনা করে আগে প্রশ্নের জবাব চান তল্লাশির ব্যাপারে ব্রিটিশ সরকারের বিরোধিতার বার্তা দেওয়ার জন্য কী কী কূটনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে যাতে ভয় সন্ত্রাস থেকে বিবিসি-কে রক্ষা করা যায়। এই বিরোধী সাংদদের বক্তব্য বিবিসি সব সময় লেবার পার্টি ও তার সাংসদদের সমালোচনা করে। বিবিসি সরকার থেকে নিরপেক্ষ। সরকারের উপর নির্ভরশীল নয়, এ কারণে শুরু থেকে এ পর্যন্ত কী কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে তার তালিকা সংসদে পেশ করতে হবে। এই অভিযোগের পর অভিযোগের কারণে সরকার যে জেরবার হয়েছে ব্রিটিশ মিডিয়া রিপোর্টে তা জানা যাচ্ছে। মিডিয়া এবং সাংসদদের প্রশ্ন দুই কিস্তির ডকুমেন্টারি যদি তৈরি না হতো তাহলে কি ভারতের কর বিভাগের এই সমীক্ষা বা তল্লাশি আদৌ হতো? তীব্র সমালোচনা ও অভিযোগের মধ্যে পড়ে ব্রিটিশ সরকার বিবিসির পক্ষে ভূমিকা নেয়,পরে ব্রিটিশ সরকার বিবিসি’র পক্ষেই বক্তব্য রাখে।
২০০২ সালের দাঙ্গা এবং বিবিসি’র তথ্যচিত্র ইত্যাদিতে বহু নতুন নতুন প্রামাণ্য তথ্য প্রকাশ, এ সম্পর্কে ভারত সরকারের বিবিসি-বিরোধী প্রতিহিংসার ভূমিকা সম্পর্কে দেশের প্রথম শ্রেণির এক ইংরেজি দৈনিকে এই ঘটনাকে তুলনা করা হয়েছে ১৯৪২ সালে হিটলারের জার্মানির। মোদী সরকারের ৯ বছরের প্রতিহিংসার বিরামহীন ঘটনার তালিকা দীর্ঘ।
গুজরাটে ২০০১ সালে আরএসএস প্রচারক হিসাবে পরিচিত মোদীকে মুখ্যমন্ত্রীর আসনে বসিয়ে দেওয়া, অমিত শাহ সহ সঙ্গে একটা গোষ্ঠী দিয়ে শাসন, অনেক সহজে ক্ষমতায় আসার পর ২০০২ সালের দাঙ্গা, আদালতে মামলার পর মামলা, উপযুক্ত ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করতে শীর্ষ আদালতের সীমাহীন ব্যর্থতা, তদন্ত টিমগুলির চূড়ান্ত অসহায়তা ও ব্যর্থতা স্পষ্ট। তৎকালীন দাঙ্গা সম্পর্কিত সত্য ঘটনা ফাঁস করে দিতে কিছু অফিসারের দেখা যায় সাহসিক ভূমিকা যার জন্য তারা তখন থেকে এখন পর্যন্ত প্রতিহিংসা ও শাস্তি ভোগ করে যাচ্ছেন। এখনও গুজরাট কাণ্ডের গভীর ক্ষত ভারতের সামাজিক রাজনৈতিক ও আইনগত অধ্যায়ে জ্বলজ্বল করছে। করতেও থাকবে। এই কলঙ্কিত অধ্যায় কখনো মুছবে না। সুপ্রিম কোর্ট তৎকালীন ও বর্তমান মোদী সরকারকে স্পর্শ যখন করেনি বা করতে পারেনি তখন মহা উল্লাসের মধ্যে ছিল সঙ্ঘ পরিবার, মোদী ও শাসক দলের নেতারা, দাঙ্গায় জড়িত সঙ্ঘ পরিবারের সংগঠনগুলি, এমনকি এই দাঙ্গার একটি নারকীয় ঘটনার সুবিচার চাইতে গিয়ে অভিযোগকারিণীকে আদালতের কাছে চরম হেনস্তা হতে হয়েছে এবং কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর অভিযোগকারিণী তিস্তা শীতলাবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধকালীন পরিস্থিতির মতো তৎপরতায় ব্যবস্থা গ্রহণ মনে করিয়ে দেয় ইতিহাসে ক্ষমা নেই এই অপরাধীদের। এরকম নিশ্চিন্ত দেশ শাসনের মধ্যে বিবিসি’র ব্রিটিশ সরকারের তদন্ত ভিত্তিক চলচ্চিত্র দলিল সব এলোমেলো করে দেয়। দেশ-বিদেশে হিন্দুত্বের প্রথম পরীক্ষাগার ‘গুজরাট ২০০২’ কবরস্থ হয়নি, বরং চিনিয়ে দিচ্ছে হিন্দুত্বের আসল চেহারা। ২৭ বছর গুজরাটে বিজেপি শাসন করছে ধর্মীয় মেরুকরণের হাতিয়ারকে অবলম্বন করে। সবে আরও একবার বিধানসভা নির্বাচনে জয়ী হয়েছে বিজেপি। এই নির্বাচনী প্রচারে মোদী এবং শাহ ধর্মীয় মেরুকরণের কৌশল নিয়ে আঁকড়ে পড়েছিলেন। ২০২২সালের ২৫ নভেম্বর এক নির্বাচনের জনসভায় অমিত শাহ বুক বাজিয়ে বলেছিলেন ২০০২ সালে ওদের (অর্থাৎ মুসলিমদের) উচিত শিক্ষা দেওয়ার পর মোদীর গুজরাটে বিজেপি চিরস্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠিত করেছে। আরও কয়েকটি সভায় এরকম উক্তি নানাভাবে ব্যক্ত করেছেন অমিত শাহ । মোদীও একই প্রচার করেছিলেন। নির্বাচন কমিশনের কাছে তথ্য প্রমাণ সহ অনেকগুলি অভিযোগ যায় এবং তাতে নির্বাচন কমিশনের পরিকল্পিত বধিরতা ভাঙা যায়নি।
কিন্তু মোদী-শাহ'র ২০০২ সালের দাঙ্গা সম্পর্কিত এসব উক্তি বিবিসি’র ডকুমেন্টারিতে ব্রিটিশ সরকারের তদন্ত রিপোর্টের অভিযোগকে সুপ্রতিষ্ঠা করছে। নয় কী! ভারতের গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ শক্তি যেখানে প্রতিরোধে ব্যর্থ, এক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্ট যেখানে ন্যায়বিচার দিতে অক্ষম, তখন বিবিসি’র প্রামাণ্য ডকুমেন্টারি এই সকল নানা মুখগুলিকে আয়নার সামনে ফুটিয়ে তুলেছে এমন সময় যখন ধর্মনিরপেক্ষতা, গোটা ভারতীয় সাধারণতন্ত্র এবং সংবিধান হিন্দুত্বের শক্তির কাছে ভয়াবহ বিপদের সম্মুখীন।
Post editorial on BBC
বিবিসি নিয়ে সরকারের প্রতিহিংসায় সামনে এল গুজরাটই
×
Comments :0