Post editorial

অসহিষ্ণুতার সদর-অন্দর

সম্পাদকীয় বিভাগ

বছর কুড়ি আগে সহিষ্ণুতার ইতিহাস লিখতে গিয়ে বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ অধ্যাপক অশীন দাশগুপ্ত বলেছিলেন, ‘এই দেশে হিন্দু মুসলমানকে, বাঙালি হিন্দুস্থানিকে, গরিব বড়লোককে এবং নারী পুরুষকে সহ্য করে।’ অশীনবাবু আজ বেঁচে থাকলে মানতেন, তাঁর কথা শুনে ঘোড়াও হাসবে। কেননা সহিষ্ণুতা নয়, দেশের সারা অঙ্গ জুড়ে এখন অসহিষ্ণুতার দুষ্ট ক্ষত দগদগ করছে। আজ হিন্দু মুসলমানকে, বাঙালি অবাঙালিকে, গরিব বড়লোককে, নারী পুরুষকে অসহ্য মনে করে।

    মানুষ আজ এতটাই অসহিষ্ণু যে পোষ্য কুকুরকে ‘কুকুর’ বলে সম্বোধন করায় পোষ্যের মালিক বৃদ্ধ আত্মীয়কে খুন করে! চা তৈরি করেনি স্ত্রী, পিটিয়ে খুন করে শাস্তি দেয় স্বামী। তারস্বরে ডিজে বাজানোর প্রতিবাদ করায় বাঁশ দিয়ে মেরে খুন করে ক্লাবের ছেলেরা। বাড়ির দোরগোড়ায় মদ বিক্রি আর মদ্যপানের আসর বসানোর প্রতিবাদ করলে খুন করে মদ্যপবাহিনী। ছাত্ররা সরকারি মন-অপসন্দ তথ্যচিত্র দেখার চেষ্টা করলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিদ্যুৎ সংযোগ ছিন্ন করে দেয়। বিবিসি এই তথ্য চিত্র বানিয়েছিল, তাই সবক শেখাতে সরকারের আয়কর দপ্তর বিবিসি’র অফিসে হানা দেয়। ক্লাসে কথা বলার অপরাধে দোতলা থেকে  ধাক্কা মেরে নিচে ফেলে ছাত্রকে মেরে ফেলে শিক্ষিক। বাবাকে তিরিশ টুকরো করে কেটে কুয়োতে ফেলে ছেলে বলে বেশ করেছি। কথা বলতে চায়নি তরুণী, একান্ন বার আঘাত করে তাকে খুন করে যুবক! এইগুলি সদ্য অনুষ্ঠিত ঘটনা। একটু পিছনের দিকে তাকান। দেখতে পাবেন দাদরি থেকে আলোয়ার, বল্লভগড় থেকে রামগড় হয়ে গোবিন্দ পানসারে, নরেন্দ্র দাভোলকর, এমএম কালবুর্গি— অসহিষ্ণুতার কুৎসিত চিহ্নের তালিকাটি দীর্ঘ। অসহিষ্ণুতা থেকে উৎসারিত উন্মত্ত ব্যক্তিরোষ, জনরোষ, গণপ্রহার এমনকি হত্যার ঘটনা ক্রমাগত ঘটেই চলেছে।
    
  যে ঘটনাগুলি আমরা এইমাত্র স্মরণ করলাম, লক্ষ্য করে দেখবেন, সেগুলি একরৈখিক সমাপতন নয়, অসহিষ্ণুতার পারদস্তম্ভে তা বিভিন্ন তল এবং তাপমাত্রায় বাঁধা। এদের উৎসভূমি কিছুটা ব্যক্তিগত লোভ আর লাভের বীজগণিতের মধ্যে, আর বাকিটা সমষ্টির সাংস্কৃতিক চৈতন্য ও রাজনৈতিক কর্তৃত্বের পাটিগণিতে নিহিত আছে।

   অসহিষ্ণুতা থেকে উৎসারিত সাম্প্রতিক সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী-হিংসার পিছনে দু’টি প্রধান কারণ চিহ্নিত করা যায়। প্রথমটি ইতিহাস নির্দেশিত, যা একটি সর্বভারতীয় সাবেকি মেটা-ন্যারেটিভের খণ্ডাংশ। বিশ শতকের চারের দশকে ‘হাই পলিটিক্স’-এর আতপ্ত সাম্প্রদায়িক অস্থিরতা আর দেশবরেণ্য নেতাদের স্বাধীনতা-উত্তর ক্ষমতা লাভের লোভকে কেন্দ্র করে যে কেজো তৎপরতা লক্ষ্য করা গিয়েছিল তা দেশের অনেক শুভ সম্ভাবনাকে অকেজো করে দিয়েছিল। ইতিহাসবিদরা বলেন, দেশভাগ সাধারণ হিন্দুরা চায়নি, সাধারণ মুসলমানও চায়নি। তবুও দেশভাগ হলো, কেননা দেশের দশের ভালোমন্দ দেখাশোনার ইজারা নিয়েছিলেন যে নেতারা, তাঁরা  তা চেয়েছিলেন। মুসলিম নেতারা সাধারণ মুসলমানদের বুঝিয়েছিলেন, দেশ স্বাধীন হলে ইংরেজি শিক্ষার দৌড়ে প্রাগ্রসর হিন্দুরা সব সরকারি চাকরি দখল করে নেবে। হিন্দুপ্রধান কংগ্রেসী নেতারা সাধারণ হিন্দুদের বোঝালেন, দেশটা আদতে হিন্দুস্থান, সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের আদি বাসভূমি। তাই মুসলমানদের এখানে কোনও স্থান নেই।

   স্বাধীনতা যত আসন্ন হচ্ছিল, ততই এই ধরনের কুটিল সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্পও বিস্তারিত হচ্ছিল। স্বাধীনতার আগে হলো দেশভাগ। একটা স্মৃতিকে হিন্দুমননে নানাভাবে জারিত করে জাগিয়ে রাখা হলো: মুসলমানদের আলাদা ঘর দিতে গিয়ে আস্ত বাড়িটাকেই ভাঙতে হয়েছে। দু’টো নয়, দেশটাকে তিন-টুকরো করতে হলো: তোমাদের যখন জায়গা দেওয়াই হয়েছে ভিন্ন ভূখণ্ডে, তা হলে আর এখানে কেন! এই মেটা-ন্যারেটিভের অন্তর্গত হয়ে আছে অনেক খণ্ডিত গল্পাংশ, যে গল্পে আমরা মহেশ আর গফুরদের দেখা পাই। কিন্তু এই মেটা-ন্যারেটিভের বিপ্রতীপে আরও একটি সাধারণধর্মী আটপৌরে গল্পাংশ ছিল, যেটি এদেশের প্রোটো-হিস্ট্রির অন্তর্গত, যেখানে দুই-গোষ্ঠীর সম্প্রীতির আলেখ্য আমরা পাঠ করি। কিন্তু রাজনৈতিক লাভের লোভে লালায়িত দেশনায়করা সেই সনাতন সত্যটিকে আড়াল করে দাঁড়ালেন। তাঁদের ‘লার্জার-দ্যান-লাইফ’ উপস্থিতি ইতিহাসকেও অস্বীকার করল। সম্প্রদায়ের ইতিহাসলালিত সহিষ্ণুতা নয়, অসহিষ্ণুতাকেই উসকানি দিয়ে জাগিয়ে রাখা হলো।

 দ্বিতীয় কারণটিকে আমরা তিনটি দৃষ্টিকোণ থেকে লক্ষ্য করতে পারি। প্রথমত, সাম্প্রতিক কালে এক ধরনের রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্ম হয়েছে, যেখানে হিংসাকে অন্যতম রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। উন্মত্ত জনতা স্রেফ পারিবারিক সম্মান কিংবা গোরক্ষায় এতটা নির্মম হবে, এমনটা ভাবা অমানবিক। এর পিছনে একটি ধর্মগোষ্ঠীর সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার সংকল্প আছে, যে ন্যায়, ইতিহাস এযাবৎ ব্যাহত করে রেখেছিল বলে মনে করা হচ্ছে। বাঁকা ইতিহাসকে সোজা করতে হত্যায় এদের হাত কাঁপে না। এদের শাস্তিও হয় না। ফলে তা পরবর্তী হিংসায় প্ররোচনা দেয়। প্রতিবাদের এই কৃৎকৌশলটি একবার সামাজিক বৈধতা পেয়ে গেলে রাজনৈতিক তাত্ত্বিক অবস্থানের ব্যাপারটি গৌণ হয়ে পড়ে। এটা একটা দল করার হক পেলে, অন্য দলকেও ছাড় দিতে হয়। তখন ডান-বাম-মধ্য বিভাজন করা মুশকিল হয়ে পড়ে। দ্বিতীয়ত, ইদানীং রাজনৈতিক সংস্কৃতি সামাজিক ন্যায়বিচারেরও দুর্বৃত্তায়ন ঘটিয়েছে। ন্যায়বিচার এখন ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের তাৎক্ষণিক বিচারব্যবস্থায় পর্যবসিত হয়েছে। পুলিশকে দোষ দেওয়া সহজ। কিন্তু উচ্চপদস্থ পুলিশকর্তাদের পদোন্নতি যত দিন ক্ষমতাসীন দলের অঙ্গুলিহেলনে চলবে, তত দিন এ ব্যবস্থার পরিবর্তন হবে না। তৃতীয়ত, কেন্দ্রীয় সশস্ত্র পুলিশ যে হারে বেড়েছে, স্থানীয় থানা স্তরে সে ভাবে বাড়েনি। অথচ গ্রাম বা শহরে লুম্পেনদের ঠেকাতে থানায় পুলিশি ব্যবস্থায় আরও বেশি শক্তি বাড়ানোর প্রয়োজন ছিল।

 এই লুম্পেনগোষ্ঠীকে সদ্যোজাত মনে করার কোনও কারণ নেই। সঞ্জয় গান্ধীর নাসবন্দি প্রকল্পে যারা জুতসই লুম্পেনত্বের সুযোগ পেয়েছিল, তারাই এখন গোমাতা আর হিন্দু ভারতমাতাকে রক্ষা করতে লুম্পেনগিরিকে কাজে লাগাচ্ছে। আবার ভারত হিন্দুরাষ্ট্র— এমন কথা মোদীর সাঙ্গোপাঙ্গরাই প্রথম বলছেন এমন নয়। প্রয়োজনে মুসলিম-তোষণ বিজেপি’র একক অ্যাজেন্ডা— এমনও নয়। রাজীব গান্ধী এবং শাহবানু মামলার রায় স্মরণ করুন। অনেক পুরানো কথা মনে পড়বে। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হয় না। কিন্তু একেবারেই হয় না এমন নয়।

  এ তো গেল রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতার উপাখ্যান যা সমষ্টির বৃত্ত থেকে দুর্বৃত্তায়নের বৃত্তান্তের দিকে ধেয়ে চলেছে। এর পাশাপাশি সমান্তরাল চলেছে ব্যক্তিগত অসহিষ্ণুতা যার মূল অনেকটাই সমষ্টিগত লোভ আর লাভের চোরাবালি থেকে উৎসারিত। আজ কেউই সাধারণ জীবন যাপনের কথা ভাবে না। আমরা ইদানীং সাধারণত্বের উদ্‌যাপন করতে ভুলে গেছি। আধুনিক জীবনযাপনে হরেক রকমের প্রযুক্তি আমাদের সুখ আর আরামের অভাবনীয় দিগন্ত খুলে দিচ্ছে। সে সব সুখের ইন্ধনে ঘৃতাহূতি দিতে অর্থ লাগে। সে সব প্রযুক্তির জন্য মূল্য দিতে হয়। আর মূল্য মেটাতে আমরা অবৈধ বৈভব অর্জনের জন্য একচক্ষু হরিণের মতো ছুটে চলেছি। সরকারি চাকরি, বিশেষত শিক্ষকতা পাওয়ার শর্টকাট হিসেবে লাখ লাখ টাকা ঘুষ দেওয়া এখন বৈধতা পেয়ে গেছে। যারা ঘুষ নিল, তাদের আমরা দোষ দিই। কিন্তু ঘুষ যারা দিল, তারা তো আরও বেশি অপরাধী। শিক্ষকতা আর পাঁচটা কাজের মতো স্রেফ একটা চাকরি নয়। শিক্ষকতা একটা ব্রত, আর সে ব্রত উদ্‌যাপনে যে সময়, সুশিক্ষা ও যোগ্যতা জরুরি, সেটুকু অর্জন করার সহিষ্ণুতাও এদের নেই। ভেবে দেখুন, এইসব অশিক্ষিত লোভী মানুষগুলি যদি একবার স্কুলে শিক্ষকপদে বহাল হতেন, তাহলে আগামী কতগুলি প্রজন্মের ছেলেমেয়ে ক্রমবর্ধমান অশিক্ষা-কুশিক্ষার শিকার হতো! এদের অবসরের সঙ্গে সঙ্গেই অশিক্ষার বৃত্তটি সম্পূর্ণ হতো না। এরা রেখে যেতেন দীর্ঘমেয়াদী একটি  পৌনঃপুনিকতায় পঙ্গু অর্ধশিক্ষিত প্রজন্ম। আদালতের হস্তক্ষেপে তা যে রোধ করা গেছে এটাই আপাতত স্বস্তির কথা।

লেখক প্রাক্তন অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়।

 

Comments :0

Login to leave a comment