Post editorial

বিজ্ঞানমনস্ক ভারত গঠনের লড়াই

জাতীয় উত্তর সম্পাদকীয়​

অরুণাভ মিশ্র

কুসংস্কার কাকে বলবো তা নিয়ে নরেন্দ্র দাভোলকারের বলা একটি ঘটনার কথা দিয়ে শুরু করি। তাঁর একাদশতম হত্যা দিবসে দাঁড়িয়ে একথা স্মরণ অন্যায় হবে না। গল্পটি এক গ্রামীণ মহিলা, তাঁর স্বামী ও তিন সন্তানকে নিয়ে। ছেলেমেয়েদের নিয়ে মেয়েটি গ্রামেই থাকে। স্বামী কাজ করে মুম্বাইতে। স্বামীকে কেউ বোঝালো, তোমার স্ত্রীর চরিত্রের দোষ আছে। স্বামী সেকথা বিশ্বাস করে বাড়িতে ফিরে প্রবল হম্বিতম্বি শুরু করল। শেষে সাফ জানিয়ে দিল, ‘তোমার চরিত্রে যদি দাগ না থাকে তবে মন্দিরে গিয়ে সবার সামনে ফুটন্ত তেলের পাত্রের তলায় থাকা মূদ্রা হাত ডুবিয়ে তুলে দেখাও! তাতে তোমার হাতে যদি কোন দাগ বা পোড়া না হয়, তবেই তুমি নিষ্কলঙ্ক প্রমাণ হবে। তখন আবার তোমাকে স্ত্রীর মর্যাদা ফিরিয়ে দেব।’ বেচারি মেয়েটি পড়ল আতান্তরে। কী করবে সে ভেবে পায় না। মেয়েটির দাদা জানতো ‘অনিসে’র কথা। মহারাষ্ট্রের এই ‘অনিস’ বা ‘অন্ধ শ্রদ্ধা নির্মূলন সমিতি‘ দাভোলকারের প্রতিষ্ঠিত সংগঠন। তার সদস্যরা যে নানা অলৌকিক ঘটনার রহস্যভেদ করে, নিজেরাই তা ঘটিয়ে দেখিয়ে দিতে পারেন, তা মেয়েটির দাদা জানতেন। তিনি মেয়েটিকে নিয়ে এলেন অনিসের দপ্তরে। অনিসের বিজ্ঞানকর্মীরা তাঁকে ফুটন্ত তেলের ভেতর থেকে পয়সা তুলে আনার কৌশল শিখিয়ে দিল। মেয়েটি সেই কৌশলে গ্রামের সমস্ত লোকের সামনে, মন্দিরে থাকা ফুটন্ত তেলের পাত্র থেকে পয়সা তুলে এনে, তার বিয়েটাকে বাঁচালো। 
গল্পটি বলে নরেন্দ্র দাভোলকার বলেন, এখানে বলুন তো, মেয়েটির চারিত্রিক বিশুদ্ধতা অবিশুদ্ধতার সঙ্গে গরম তেলে হাত পোড়া না-পোড়ার সম্পর্ক কোথায়? কিছুই নেই! কী করে গরম তেলে হাত পোড়া না-পোড়ার সঙ্গে চরিত্রের বিশুদ্ধতা-অবিশুদ্ধতার সম্পর্ক থাকতে পারে? একটার সঙ্গে অন্যটার কোনও কার্য–কারণ সম্পর্ক নেই। এইবার দাভোলকার পরিষ্কার জানান, কোনও ঘটনার সঙ্গে অন্য ঘটনার কার্য-কারণ সম্পর্ক না থাকা সত্ত্বেও যখন জোর করে তাদের মধ্যে সম্পর্ক টানা হয়, তখন ওই প্রথা বা বিশ্বাসকে আমরা কুসংস্কার হিসাবে চিহ্নিত করতে পারি। উপরের ঘটনা একটি সামাজিক কুসংস্কারের উদাহরণ। এরকম হাজারো সামাজিক কুসংস্কারের শিকার হই আমরা।
সামাজিক শুধু নয়, আছে ধর্মীয় কুসংস্কারও
দ্বিতীয় যে ঘটনাটির কথা বলবো তা ২০১২ সালের ১০ মার্চের। ইন্ডিয়ান র্যা শনালিস্ট অ্যা সোসিয়েশনের সভাপতি সানাল এডামারুকু সেদিন মুম্বাইয়ের শহরতলির একটি চার্চের সামনে থাকা যিশুর একটি ক্রুশবিদ্ধ মূর্তি পরীক্ষা করতে গিয়েছিলেন। শত শত ভক্ত সেই মূর্তির সামনে জড়ো হচ্ছিল প্রতিদিন। কারণ, মূর্তির ক্রুশবিদ্ধ যিশুর পা থেকে বিন্দু বিন্দু জল বেরিয়ে আসছিল। এই অলৌকিক ঘটনা দেখতেই ভিড় হছিল ভক্তদের! এডামারুকু দেখলেন এই জলের উৎস হচ্ছে, কাছেই থাকা একটি স্নানাগারের অতিরিক্ত জল বেরিয়ে আসার নালা। কৌশিক ক্রিয়া বা ক্যাপিলারী অ্যা কশনে ওই জল চলে আসছে যিশুর পায়ে। পরে একটি টিভি শো-তে এডামারুকু এটা কীভাবে হচ্ছে তা পরিষ্কার করে বুঝিয়ে দিলেন। সেইসঙ্গে চার্চের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে তিনি ভক্তদের তথা সাধারণ মানুষকে অলৌকিক ঘটনা দেখিয়ে প্রতারিত করার অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করলেন। অভিযোগ মেনে নিলেন না চার্চ কর্তৃপক্ষ। উভয়দিকে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ের পর পাদ্রিরা সানালকে ক্ষমা চাইতে বললেন। সানাল কিছুতেই রাজি হলেন না। পরে পুলিশ ‘ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত’ করার অপরাধে সানালকে ভারতীয় দণ্ডবিধির ২৯৫ ধারায় দোষী সাব্যস্ত করল।
দ্বিতীয় এই ঘটনাটি ধর্মীয় অন্ধতা বা ধর্মীয় কুসংস্কারের এক বড় উদাহরণ। যুক্তিবাদী ব্যাখ্যাও এই সংস্কারের কাছে অসহায় হয়ে যায় অনেক সময় আইনি সুরক্ষা না পেলে। 
আমাদের বাংলায়, আমাদের ভারতবর্ষে শত শত এমন ধর্মীয় কুসংস্কার রয়েছে। আছে তন্ত্র ও ডাইনি হত্যা, শিব-ষাঁড়-গণেশের দুধপান, জ্যোতিষী ভাগ্যাগণনা ও রত্নধারণ, সূর্যগ্রহণে খাওয়া ঘুম ও সূর্যালোকে বেরুনো বন্ধ, মৃত মানুষের শ্রাদ্ধাদি পারলৌকিক কাজ, বলিদান, স্বপ্নাদেশ, যোগবলে অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী সাধুর কৃপালাভ প্রভৃতি নানা কুসংস্কার। এসবের বিরুদ্ধে উপযুক্ত আইন চাই। চাই বলিষ্ঠ কুসংস্কার ও অপবিজ্ঞান বিরোধী আইন।
ভারতবর্ষের যুক্তিবাদী ঐতিহ্য
ভারতবর্ষে যুক্তিবাদী মনন বিকাশের ধারাবাহিক ইতিহাস রয়েছে। আধুনিক ভারতে এর সূচনা রামমোহনের হাতে ধরা যায়। রামমোহন তুহফাৎ ছাড়াও তাঁর ‘সহমরণ বিষয়ে প্রবর্ত্তক ও নিবর্ত্তকের সম্বাদ’ লেখায় যুক্তির ধারাবাহিক প্রয়োগে সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর যে ধারার জন্ম দেন, তা পরে বিদ্যাসাগরও অনুসরণ করেছিলেন। ধর্মীয় অনুশাসনের অনুগামী বাংলার সমাজকর্তাদের জন্য মনুস্মৃতির ধারা তুলে ধরে তিনি দেখিয়েছিলেন, পতির মৃত্যুতে সহমরণ নয়, ব্রহ্মচর্যই বিধেয়। সে যুক্তিকে তখন নস্যাৎ করা যায়নি। রামমোহনের এই যুক্তিবাদী চর্চার উত্তরসূরি ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, অক্ষয়কুমার দত্ত, মধুসূদন গুপ্ত, জ্যোতিরাও ফুলে, সাবিত্রীবাই ফুলে, রামস্বামী পেরিয়ার, রামকৃষ্ণ জি ভান্ডারকর, গণেশ জি আগারকার, শানু মহারাজ, আনি ব্যাসান্ত, রামস্বামী নাইকার, জওহরলাল নেহরু, ভীমরাও আম্বেদকর, এম এন রায়, প্রফুল্লচন্দ্র রায়, গোপারাজু রাও (গোরা), আর পি পরঞ্জাপে, সি এন আন্নাদুরাই প্রমুখ অনেকে। ফুলের জাতপাত বিরোধী সত্যশোধক সমাজ আন্দোলন সামাজিক অসাম্যের বিরুদ্ধে ও যুক্তিবাদী মন গড়ে তোলায় বড় ভূমিকা নিয়েছিল। সেই ধারায় উত্তরকালে আমরা আরজ আলী মাতুব্বর, আব্রাহাম কভুর, বি প্রেমানন্দ, নরেন্দ্র দাভোলকার, সানাল এডামারালু, নরেন্দ্র নায়েক, শঙ্কর চক্রবর্তী প্রমুখদের নাম আনতে পারি।
বিজ্ঞানমনস্কতা ও ভারত
ভারতবর্ষ তার স্বাধীনতার জন্য লড়াইয়ের সময় থেকেই, বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য, সমতা, ন্যায় বিচার, বিজ্ঞানমনস্কতা ও স্বনির্ভরতাকে স্বদেশের মূলমন্ত্র করে এসেছে। ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু এদেশে সায়েন্টিফিক টেম্পার বা বৈজ্ঞানিক মেজাজ শব্দবন্ধটির প্রসার ঘটান। এই মনন বা মেজাজ সমাজে, রাজনীতিতে, অর্থনীতির ক্ষেত্রে, এবং বৌদ্ধিক চর্চায়, সর্বত্রই দরকারি। স্বাধীনতার আগে থেকেই নেহরু বৈজ্ঞানিক মেজাজের প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরেছিলেন তাঁর ডিসকভারি অব ইন্ডিয়ার পাতায়। তারপর যখন স্বাধীন ভারত তার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নীতি ঘোষণা করল ১৯৫৩ সালে, তখন সেখানেও এর সযত্ন উল্লেখ রইলো। নেহরুর আহ্বান ছিল, একজন মুক্ত মানুষের জীবনের মূল নীতি হবে তার বিজ্ঞানমনস্কতা। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে এই মননের প্রয়োগের মধ্য দিয়েই সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া সম্ভব হবে। নেহরু যে মনেপ্রাণে এমন মানসিকতার লালনে যত্নবান ছিলেন, তা ঠিক। কিন্তু দেশের নাগরিকদের এই মননের বিকাশে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা তিনি গ্রহণ করেননি। তাঁর পরেও অন্য প্রধানমন্ত্রীদেরও এ বিষয়ে ভূমিকা নিতে দেখা যায়নি।
১৯৭৬ সালে সংবিধানে নাগরিক কর্তব্য হিসাবে বৈজ্ঞানিক মেজাজ তৈরি, অনুসন্ধিৎসা জাগিয়ে তোলা ও মানবতার প্রকাশকে উৎসাহিত করা হলেও রাষ্ট্র নিজে এব্যাপারে কোনও উদ্যোগ নিয়ে এগিয়ে এল না। সরকারি গুরুত্বপূর্ণ পদাধিকারী ও বিজ্ঞানীদের নিয়ে বিজ্ঞান মনস্কতার ঘোষণাপত্র হয়েছে এরপর ১৯৮১ সালে।  পরে তার অগ্রগতি ফিরে দেখা ও হয়েছে হিমাচলের পালামপুরে। কিন্তু সেইসব ঘোষণাপত্র ঘিরে বহু প্রশ্ন উঠেছে অতীতে। প্রথম ‘বিজ্ঞান মনস্কতার ঘোষণাপত্র’ প্রকাশের পর পরই তার প্রতিবাদে দুটি চিঠি ছাপা হলো। আশিস নন্দী মেইনস্ট্রিম পত্রিকায় তাঁর ‘মানবতাবাদের ঘোষণাপত্র’ প্রকাশ করলেন। ১৯৮২-তে ‘সোশাল সায়েন্টিস্ট’-এ ছাপা হলো রাজেন্দ্র প্রসাদের ‘দা ডিবেট অন সায়েন্টিফিক টেম্পার’। নেহরুবাদী, বিজ্ঞানের সামাজিক ভূমিকা বিষয়ে মন্তব্যহীন, যান্ত্রিক, পশ্চিমী, সামাজিক চর্চার ফসল নয় প্রভৃতি সমালোচনা হলো এই ঘোষণাপত্রের। তাছাড়া পরিস্থিতির বদলও ঘটেছে তারপর। মুক্তবাজার, বিশ্বায়ন ও ব্যক্তি মালিকানার প্রসার ঘটেছে। সোভিয়েতের পতনে বিশ্ব একমুখী হয়ে বিশ্বশান্তির বিপদ আর যুদ্ধের আবহ বাড়িয়ে দিয়েছে। সামাজিক ক্ষেত্রের এই পরিবর্তনগুলো স্বাভাবিকভাবে বিজ্ঞান, যার জন্ম ও বিকাশ সমাজের গর্ভে, তার ভেতরে প্রভাব ফেলেছে। ঘোষণাপত্রে তার প্রতিফলন দেখা গেল না। ফলে, বিজ্ঞানমনস্কতার প্রসার থেকে ভারতবর্ষ দূরেই থেকে গেল। 
সরকার নানা সময়ে নানা শিক্ষা কমিশন গড়ে শিক্ষা নিয়ে নানা সুপারিশ পেয়েছে। কিন্তু বিজ্ঞান শিক্ষাকে কীভাবে বিজ্ঞান মনস্কতা জায়নের পরিপূরক হিসাবে পাঠ পরিকল্পনায় রাখা যায়, তার চেষ্টা একবারও দেখা যায়নি। বিজ্ঞান মনস্কতা গড়ে তোলার পক্ষে সক্রিয় রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের অভাব ছিল স্পষ্ট। তা সত্ত্বেও এটা ঠিক, সরকারের কাছ থেকে বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণ ও বিজ্ঞান মনস্কতা বিকাশের কাজে কখনো সরাসরি বাধার পাহাড় তুলে ধরা হয়নি।

অপবিজ্ঞানে উৎসাহ জোগানোর কাল

২০১৪ সালের পর থেকে এক ভিন্ন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে দেশ চলেছে। রাষ্ট্রিক উদ্যোগে অপবিজ্ঞানের প্রচার চলছে। পৌরাণিক কাহিনি ও ধর্মশাস্ত্রের কথাকে বৈজ্ঞানিক সত্যের মর্যাদা দেওয়া হচ্ছে। স্বাধীন মতপ্রকাশ, আলোচনা-সমালোচনা, বিতর্ক এবং দ্বিমত পোষণ করার মতো বৈজ্ঞানিক কর্মকাণ্ডকে দেশদ্রোহিতা বলে চিহ্নিত করা হচ্ছে। শিক্ষানীতিতে সাম্প্রদায়িকতা ও একদেশদর্শিতার কালিমা আনা হচ্ছে। সেখানে মৌলিক গবেষণাকে করা হচ্ছে সুনিয়ন্ত্রিত। প্রাচীন ভারতীয় জ্ঞান ভাণ্ডারের নামে জ্যোতিষ শাস্ত্র ও বৈদিক গণিতকে পাঠ্য তালিকায় আনা হচ্ছে। ছোটদের পাঠ্যসূচি থেকে সচেতনভাবে বাদ দেওয়া হচ্ছে ডারউইন ও বিবর্তনবাদ এবং পর্যায় সারণি। প্রাণের সৃষ্টি, জীব ও মানুষের সৃষ্টির ইতিহাস জানার জন্য ডারউইন ও তাঁর তত্ত্বের কথা জানা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তেমনি সমধর্মী মৌলদের শ্রেণিবদ্ধকরণে পর্যায়সারণিকে পথপ্রদর্শক বলা যায়। অথচ তাদের শিক্ষার আঙিনা থেকে সরিয়ে দিয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের যৌক্তিক চিন্তার ভিত্তিকে দুর্বল করে মৌলিক বিজ্ঞান শিক্ষার ভিত্তিকেই ধ্বংস করে দেওয়ার দুরভিসন্ধি কষা হচ্ছে। এই  ‘বৃহৎ ব্যবসায়িক- সাম্প্রদায়িক- অপবৈজ্ঞানিক চক্রের’ দুরভিসন্ধিকে পরাস্ত করতে হবে। সেকুলার মুক্তবুদ্ধি নিয়ে যুক্তিবাদী ভাবনার প্রসার ঘটাতে হবে। বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণে সক্রিয় ভূমিকায় অবতীর্ণ মানুষগুলোর হত্যাকারীদের বিচার করে শাস্তির দাবিতে সোচ্চার হতে হবে। সর্বোপরি রাষ্ট্রকে বিজ্ঞান মনস্কতা বিকাশে উপযোগী উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। মতপ্রকাশে বাধাহীনতা, দ্বিমত হওয়ার স্বাধীনতা, অন্ধ বিশ্বাসের বদলে পরীক্ষা ও যাচাই, অনুসন্ধিৎসু মন ও জিজ্ঞাসু প্রকৃতিকে লালন করা আমাদের প্রত্যেকের অধিকার। অপবিজ্ঞানের ভ্রুকুটির সামনে মুক্তবুদ্ধি ও যুক্তিবাদের সংস্কৃতি আগামী দিনে আমাদের পথ দেখাবে— এ আমাদের দৃঢ় প্রত্যয়। 
এর বিরুদ্ধে আন্দোলন হবে, আইনও চাই
আর এই প্রত্যয়কে পোক্ত ভিতের ওপর দাঁড় করাতে চাই আমাদের পশ্চিমবাংলায় কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাস বিরোধী আইন। এমন আইন মহারাষ্ট্রে হয়েছে দাভোলকারের মৃত্যুর পর। আইনের নির্দিষ্ট ধারাগুলো আজও স্পষ্ট করে তৈরি না হলেও গত দশ বছরে দু' হাজারের বেশি কেস হয়েছে এই আইনের প্রয়োগে। অনেকের শাস্তিও হয়েছে। কর্নাটকেও কুসংস্কার বিরোধী আইন হয়েছে। কিন্তু সেখানে আইনের প্রয়োগের ক্ষেত্রে ঘাটতি আছে। অবিলম্বে আমাদের রাজ্যে কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাস বিরোধী আইন চাই। এমন আইন চাই সারা দেশে। ডাইনি প্রথার অনাচার, জ্যোতিষবিদ্যার বুজরুকি, সৃষ্টিবাদের অন্ধতা, বৈদিক গণিতের ভ্রান্ত ভাবনা, তন্ত্র মন্ত্রের অসারতা, অলৌকিকতার ভণ্ডামি, প্রাচীন জ্ঞান-গরিমার অবৈজ্ঞানিক দাবি, যারা ছড়াতে চাইছেন তাদের ধারাবাহিক প্রচারে যেমন মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন করতে হবে, তেমনি আইনি পথেও এই কুকাজ থেকে বিরতও করতে হবে। মনে রাখা ভালো, সামাজিক কারণে অন্ধ বিশ্বাস ও কুসংস্কারের শিকার অসহায় সাধারণ মানুষকে শাস্তি দেওয়ার জন্য কখনোই এমন আইন চাইছি না আমরা। ভণ্ড ও প্রতারকদের সামাজিক অনাচারের মৃগয়াক্ষেত্র হওয়া থেকে প্রতিকারের হাতিয়ার হতে পারে এই আইন।
লড়াই জারি ছিল, আজও আছে
আজ বিজ্ঞানমনস্কতা ও যুক্তিবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে দেশের সরকার ও তার পৃষ্ঠপোষক হিন্দুত্ববাদী শক্তি। কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস, অযৌক্তিকতা, পশ্চাৎপদতা, অবৈজ্ঞানিক ধারণা প্রভৃতি, যা ভারতীয় সমাজে বিদ্যমান ছিল তাকে আরও উৎসাহিত এবং উদ্দীপিত করতে আসরে নেমেছে তারা। আমরা জানি, ‘চিরপ্রচলিত সংস্কার মানব হৃদয়ে এরূপ প্রবল আধিপত্য বিস্তার করিয়া থাকে যে কোনোরূপ নতুন স্বাধীন চিন্তা সহজে উহার মধ্যে স্ফূর্তি পায় না’(নব্য রসায়নী বিদ্যা, প্রফুলচন্দ্র)। আবার ‘ব্রাহ্মণ্য আধিপত্য কুসংস্কারের এক বৃহৎ অধ্যায়।… হিন্দুর যাহা কিছু তাহাই শ্রেষ্ঠ, হিন্দু ভিন্ন সকল জাতি ম্লেচ্ছ ও বর্বর, তাহাদের নিকট আমাদের কিছুই শিখিবার নাই, এই প্রকার সংস্কার সকল যেদিন আমাদের জাতীয় চরিত্রে প্রবল অধিকার স্থাপন করিল, সেইদিন হইতে আমাদের উন্নতির মার্গ কণ্টকিত হইল’ (বাঙালির মস্তিস্ক ও তার অপব্যবহার, প্রফুলচন্দ্র)। প্রফুলচন্দ্রের এইসব চেতাবনী বহু আগে থেকে থাকলেও ‘কাকস্য পরিবেদনা’। 
ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুরাষ্ট্র তৈরি ও ভারতকে বিশ্বগুরু দেখানোর বাসনায় যথেচ্ছ অবৈজ্ঞানিক ভাষ্য ছড়িয়ে যাওয়া আজকে সঙ্ঘ পরিবারের অন্যতম কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেজন্য মুসলিম-ঘৃণা ও বর্ণবাদের প্রসার দেখে চলছি আমরা। সঙ্ঘের মতে মুসলমান ও খ্রিস্টানরা এদেশি নয়, কারণ তাদের মাতৃভূমি পিতৃভূমি এদেশ নয়, তারা বহিরাগত। আবার তাদের পুণ্যভূমিও এদেশে নয়, মক্কা- মদিনা বা জেরুজালেম। কিন্তু তারা ভুলে যায় হিন্দুরা নিজেরাই বহিরাগত। বৈদিক জনগোষ্ঠী, হিন্দুরা যার উত্তরাধিকার, তারাও তো বহিরাগত! সেই কালিমা নিজেদের গায়ে লাগতে দেবে না বলে হরপ্পা সভ্যতাই প্রাচীন বৈদিক সভ্যতা আর আর্যরা এদেশীয়, এমন প্রচার চলে সঙ্ঘীদের তরফে। কোনও প্রতিষ্ঠিত ঐতিহাসিকই একথা মানেন না, কারণ এর পেছনে বিন্দুমাত্র বৈজ্ঞানিক যুক্তি প্রমাণ নেই। তাতে অবশ্য সঙ্ঘীদের কি বয়ে যায়! লেনিন বলেছিলেন, সামাজিক স্বার্থের প্রশ্ন থাকলে জ্যামিতির স্বতঃসিদ্ধগুলো নিয়েও লোকে বিতর্ক করবে। এখানে তো জড়িয়ে তাদের মুখ্য রাজনৈতিক প্রকল্পের স্বার্থ!
প্রতি বছর বিজ্ঞান কগ্রেসের মঞ্চ থেকে দেশের সরকারের অঙ্গুলিহেলনে এমন সব কর্মকাণ্ড চলছে যে ভেঙ্কটরামন রামকৃষ্ণন ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসকে ‘সার্কাস’ বলেছেন। ২০১৯ সালে প্রায় একহাজার বিজ্ঞানীকে প্রতিবাদী হয়ে মন্তব্য করতে হয়েছিল, ‘প্রাচীন সাহিত্যকে ঘটনা বা প্রমাণ ভেবে চলাটা অনৈতিক, কেননা সেগুলো কোনও বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের মধ্যে দিয়ে যায়নি।’ এগুলো যে ‘সামগ্রিকভাবে অবৈজ্ঞানিক’ তা বলতেও তাঁরা দ্বিধা করেননি। আর সম্প্রতি ডারউইনবাদ সিলেবাস থেকে বাদ দেওয়ার প্রতিবাদে ভারতের তিনটি বিজ্ঞান আকাদেমির সদস্যরা একযোগে বলেছেন, ‘এটি হবে একটি পশ্চাৎমুখী পদক্ষেপ’। তাই বলা যায় লড়াই জারি আছে। আর সেই লড়াইকে আরও বলিষ্ঠ করে তুলতে বিজ্ঞানমনস্কতা নিয়ে আরো ব্যাপক কর্মসূচি নেবে বিজ্ঞান সংগঠনগুলি। তৈরি করবে সময়োপযোগী নতুন বিজ্ঞানমনস্কতার ঘোষণাপত্র। বিজ্ঞানমনস্ক ভারত গড়ার লড়াইকে বিন্দুমাত্র দুর্বল হতে দেওয়া যাবে না। এই  হোক আমাদের আজকের অঙ্গীকার।

Comments :0

Login to leave a comment