Post Editorial on Library

গ্রন্থাগার দিবস না গ্রন্থাগারকে বাঁচানো দিবস? গৌতম গোস্বামী

সম্পাদকীয় বিভাগ


২০ ডিসেম্বর তারিখটি গ্রন্থাগারিক, গ্রন্থাগার কর্মী এবং গ্রন্থাগারের সাথে যুক্ত মানুষদের কাছে খুবই পরিচিত একটি দিন। ১৯২৫ সালের ২০ ডিসেম্বর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সভাপতিত্বে বঙ্গীয় গ্রন্থাগার পরিষদ প্রতিষ্ঠিত হয়। সেই থেকে এই দিনটি ‘‘গ্রন্থাগার দিবস’’ হিসাবে পালিত হয়ে আসছে। 
এবছর প্রশ্ন এসেছে গ্রন্থাগার দিবস পালন করা হবে নাকি পশ্চিমবঙ্গের গ্রন্থাগারগুলোকে বাঁচানোর দিবস পালন করা হবে! আজ যে প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা চলছে তা হলো ১৯৭৯ সালে বামফ্রন্ট সরকারের আমলে যে গ্রন্থাগার আইন প্রবর্তিত হয়েছিল প্রথাবহির্ভূত শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য তার বর্তমান অবস্থা কোন পর্যায়ে দাঁড়িয়ে আছে?
একটি গ্রন্থাগারের পরিষেবা বজায় রাখতে গেলে যেবিষয়গুলির উপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব আরোপ করতে হয় তা হলো (১) বই (২) গ্রন্থাগার কর্মী (৩) পাঠক এবং (৪) সরকারের ভূমিকা। এছাড়াও আরও কিছু বিষয় আছে যেমন শিক্ষা ব্যবস্থা, অন্যান্য সংগঠন ও শিক্ষায়তনের ভূমিকা, পরিবেশ ইত্যাদি। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা প্রয়োজন পশ্চিমবঙ্গের যে কোনও ধরনের গ্রন্থাগারের সাথে সাধারণ গ্রন্থাগার ব্যবস্থা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত। ২০১১ সালের পর বর্তমান সরকার যে যে সিদ্ধান্তগুলি সাধারণ গ্রন্থাগার ব্যবস্থা সম্পর্কে নিয়েছে তা উপরে উল্লিখিত সবকটি বিষয়ের পরিপন্থী এবং যার ফলস্বরূপ পশ্চিমবঙ্গে বর্তমান গ্রন্থাগার ব্যবস্থা সম্পূর্ণভাবে বিপর্যস্ত এবং ভেঙে পড়েছে। পর্যালোচনা করার পর বর্তমান সরকার গ্রন্থাগারের উন্নতির জন্য নেওয়া সিদ্ধান্তগুলি কতটা অসফল বা ফলপ্রসূ হয়নি তা প্রমাণিত। অবশ্য সিদ্ধান্তগুলি সঠিক হবেই বা কিভাবে? কারণ গ্রন্থাগার আইন অনুযায়ী গ্রন্থাগার ব্যবস্থার উন্নতির জন্য যে কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য ‘‘রাজ্য গ্রন্থাগার পর্ষদ’দ (স্টেট লাইব্রেরি কাউন্সিল) গঠন করা হয়েছিল যেখানে সমস্ত গ্রন্থাগার সংগঠন, শিক্ষায়তন, জনপ্রতিনিধি এবং গ্রন্থাগার পরিষেবা দপ্তরের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী ছিলেন। সম্প্রতি রাজ্য গ্রন্থাগার পর্ষদ পুনর্গঠিত হয়েছে। আইনের ধারা ও উপধারা অনুযায়ী পর্ষদে কোন কোন সদস্য প্রতিনিধিত্ব করছেন আদেশনামায় তার উল্লেখ নেই। আবার বঙ্গীয় গ্রন্থাগার পরিষদের সভাপতি ও সম্পাদক, গ্রন্থাগার বিজ্ঞান ও গ্রন্থাগারে পরিষদের বিশেষজ্ঞ এরকম ৪ জন প্রতিনিধি সহ গ্রন্থাগার কর্মীদের কোনও প্রতিনিধি নেই। যা থাকাটা আবশ্যিক। ২০১১ সালের পর এখনও পর্যন্ত কোন সভা পর্ষদের তরফ থেকে ডাকা হয়েছে কিনা তা জানা নেই। তা হলে কাদের সাথে আলোচনা করে সিদ্ধান্তগুলি নেওয়া হয়? এব্যাপারে বঙ্গীয় গ্রন্থাগার পরিষদ এবং পশ্চিমবঙ্গ সাধারণের গ্রন্থাগার কর্মী সমিতি বার বার বলা সত্ত্বেও কোনও ফল হয়নি। গত ২৭-০৯-২০২২ তারিখে জনশিক্ষা প্রসার ও গ্রন্থাগার পরিষেবা বিভাগ থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় রাজ্যের ৯টি জেলায় জেলা গ্রন্থাগার আধিকারিকের অতিরিক্ত দায়িত্ব কমাতে জেলা জনশিক্ষা প্রসার আধিকারিকদের অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসাবে জেলা গ্রন্থাগার আধিকারিকের পূর্ণ দা‌য়িত্ব পালন করার নির্দেশ দেওয়া হয়। গ্রন্থাগার আইন অনুযায়ী জেলার গ্রন্থাগার সংক্রান্ত সমস্ত বিষয় দেখাশোনার জন্য জেলা গ্রন্থাগার আধিকারিকের পদ তৈরি করা হয়েছিল। অথচ যে যে জেলাগুলির ক্ষেত্রে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে সেখানে জেলা গ্রন্থাগার আধিকারিক নিয়োগ না করে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। জেলাগুলি হলো যথাক্রমে কালিম্পঙ, আলিপুরদুয়ার, জলপাইগুড়ি, দক্ষিণ দিনাজপুর, মালদা, মুর্শিদাবাদ, পূর্ব মেদিনীপুর, পুরুলিয়া এবং পশ্চিম বর্ধমান।
গত ১৬-১১-২০২২ তারিখে জনশিক্ষা প্রসার এবং গ্রন্থাগার পরিষেবা বিভাগ থেকে আর একটি আদেশনামায় বলা হয় ব্লক ডেভেলপমেন্ট অফিসে যে সকল আধিকারিক (Extension officer ) এবং মহিলা আধিকারিক (Lady Extension officer) জনশিক্ষা প্রসার বিভাগের অধীন (under Mass Education Extension Directorate) তাঁরা উক্ত ব্লকে যে সকল সাধারণ গ্রন্থাগার আছে তার তত্ত্বাবধান (supervise) করবেন অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসাবে।
বঙ্গীয় গ্রন্থাগার পরিষদ ও পশ্চিমবঙ্গ সাধারণের গ্রন্থাগার কর্মী সমিতি এই আদেশনামা প্রত্যাহারের জন্য সরকারের কাছে অনুরোধ জানিয়ে চিঠি দিয়েছেন। চিঠিতে প্রত্যাহারের কারণ হিসাবে বলা হয়েছে : (ক) জেলা গ্রন্থাগার আধিকারিক পদের নিয়োগের জন্য ন্যূনতম যোগ্যতা হিসাবে গ্রন্থাগার বিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি আবশ্যিক হওয়া প্রয়োজন (গ্রন্থাগার আইন অনুযায়ী)। কারণ বৃত্তি কুশলতা জ্ঞান গ্রন্থাগার পরিদর্শনের ক্ষেত্রে একান্ত প্রয়োজন। গ্রন্থাগার পরিদর্শনের নির্দিষ্ট ফরম্যাটে পরিদর্শনকালে গ্রন্থ সংগ্রহের বিন্যাস, পরিষেবার নানা ক্ষেত্রে গ্রন্থাগার কর্মীদের বৃত্তি কুশলতার দক্ষতা নির্ণয়ে গ্রন্থাগার ও তথ্যবিজ্ঞানের জ্ঞান না থাকলে সঠিক মূল্যায়ন করা সম্ভব নয়।
(খ) জেলা জনশিক্ষা প্রসার আধিকারিকদের গ্রন্থাগার ও তথ্যবিজ্ঞানের জ্ঞান না থাকার ফলে তাঁদের পক্ষে সাধারণ গ্রন্থাগারগুলির বিভিন্ন উন্নয়নমূলক পরিকল্পনা করা ও তার মূল্যায়ন করা সম্ভব নয়। ফলে পরিকল্পনাগুলি সফলভাবে রূপায়িত হবে না।
(গ) এই আদেশনামার ফলে জেলা গ্রন্থাগার আধিকারিকদের যোগ্যতা সম্পর্কে গ্রন্থাগার আইনে যে নির্দেশিকা দেওয়া আছে তাকে অস্বীকার করা হয়েছে।
(ঘ) পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ গ্রন্থাগারের ঐতিহ্য প্রায় দুশো বছরের এবং সাধারণ গ্রন্থাগার ব্যবস্থা ভারতবর্ষের অধিকাংশ রাজ্যের কাছে দৃষ্টান্ত স্বরূপ। তাই এই সরকারি আদেশনামাটি গ্রন্থাগার আইনের পরিপন্থী এবং গ্রন্থাগার বৃত্তির পক্ষে ক্ষতিকর।
গ্রন্থাগার আইনের নির্দেশ অনুযায়ী ‘‘স্থানীয় গ্রন্থাগার কৃত্যকের (Local Library Authority)। স্থানীয় গ্রন্থাগার কৃত্যকের সদস্যরা সভা করে স্থানীয় গ্রন্থাগার ব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য সিদ্ধান্ত নেবেন। কিন্তু সাম্প্রতিক আদেশনামায় (স্মারক সংখ্যা 119/MEE/sectt. dated 21.09.2019) গ্রন্থাগার আইনের ধারা ও উপধারা অনুযায়ী অসম্পূর্ণ। ফলে অন্যান্য প্রতিনিধি-সহকর্মীদের প্রতিনিধি অনুপস্থিত।
এবার আসা যাক গ্রন্থাগারের কথায়। ১৯৭৯ সালে গ্রন্থাগার আইন প্রবর্তিত হওয়ার পর সারা রাজ্যে ২৪৭৯টি সরকার পোষিত গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। গত ১১ বছরে ১টি নতুন গ্রন্থাগার মাটি সাথি, উত্তরবঙ্গে প্রতিষ্ঠা হয়। অর্থাৎ ২৪৮০টি গ্রন্থাগারের মধ্যে ১২০০টি গ্রন্থাগার বন্ধ বা আংশিক খোলা। কিছুদিন আগে গ্রন্থাগার দপ্তরের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী বলেছিলেন অতিমারীতে ১০ লক্ষের বেশি বই নষ্ট হয়ে গেছে। অতিমারীর আগে অনেক গ্রন্থাগারে তালা পড়ে গিয়েছিল। সুতরাং অতিমারীর আগেও অনেক গ্রন্থাগারের সম্পদ নষ্ট হয়ে গেছে। এখনও গ্রন্থাগার খোলার বদলে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ফলে গ্রন্থাগারের বহু সম্পদ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এর দায় কার উপর বর্তাবে?
পশ্চিমবঙ্গ গ্রন্থাগার আইন প্রবর্তিত হওয়ার আগে বহু বেসরকারি অপোষিত গ্রন্থাগার ছিল। যেগুলি মানুষের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এই সব গ্রন্থাগার বহুদিন যাবৎ মানুষকে পরিষেবা দিয়ে আসছে। এর মধ্যে অনেকগুলি গ্রন্থাগার সরকারপোষিত গ্রন্থাগারের আওতায় এসেছে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত অনেক বেসরকারি ও অপোষিত গ্রন্থাগার আছে, যেগুলি রাজ্যের সাধারণ গ্রন্থাগার ব্যবস্থায়/পরিষেবায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে আসছে। এখনও পর্যন্ত রাজ্যে মোট ২৭৭১টি বেসরকারি ও অপোষিত গ্রন্থাগার চিহ্নিত করা গেছে।
১৯৯৯-২০০০ সাল থেকে ২০১৫-২০১৬ আর্থিক বছর পর্যন্ত বেসরকারি ও অপোষিত গ্রন্থাগারগুলিকে আর্থিক অনুদান দেওয়া হবে তার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সেই অনুযায়ী গ্রন্থাগারগুলি কতদিন আগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তার উপর ভিত্তি করে অনুদান দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। যে বছরে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছে তার থেকে ১০০ বছর যা তার বেশি আগে হলে ৩০,০০০ টাকা, ৫০ বছর হলে ২৫,০০০ টাকা এবং ২৫ বছর হলে ২০,০০০ টাকা দেওয়া হতো। ২০১৫-১৬ আর্থিক বছরের এই সিদ্ধান্ত পরিবর্তিত হয়ে দাঁড়ায় :
— ১৯০৯ সালে পূর্বে স্থাপিত গ্রন্থাগার (১৯০৯ সাল ধরে) — ১৫,০০০)/- টাকা
— ১৯১০ থেকে ১৯৫৯ এর মধ্যে স্থাপিত গ্রন্থাগার (উভয় বছর ধরে) ১২,০০০/- টাকা
— ১০৬০ থেকে ২০০৫ এর মধ্যে স্থাপিত গ্রন্থাগার (উভ বছর ধরে) — ১০,০০০/- টাকা
২০১৬-১৭ আর্থিক বছরে এইরকম তিনটি ভাগ তুলে দিয়ে নতুনভাবে বলা হলো যে বছর বিজ্ঞাপন দেওয়া হবে তার থেকে তিন বছর আগে প্রতিষ্ঠিত রাজ্যের যে কোনও বেসরকারি অপোষিত গ্রন্থাগার/ক্লাব কাম লাইব্রেরি/সংখ্যালঘু সম্প্রদায় দ্বারা পরিচালিত কোনও বেসরকারি ও অপোষিত গ্রন্থাগারকে একটি হারে অর্থাৎ ২৫,০০০/- টাকা করে দেওয়া হবে। অর্থাৎ মুড়ি-মিছরির একই মূল্য। ২০১৯-২০ সালের পর থেকে এই ধরনের গ্রন্থাগারগুলো আর কোনও অনুদান পাচ্ছে না। এমনকি সরকার পোষিত গ্রন্থাগারগুলোও বই কেনার জন্য নিয়মিত অনুদান পাচ্ছে না। সাধারণ গ্রন্থাগার পরিচালনার জন্য লাইব্রেরি পরিচালিত বিধি (Notification No. 357/MEE/Sectt.dated 03.05.2017) প্রকাশিত হয়েছে। যা মনোনীত প্রতিনিধি দ্বারাই সমৃদ্ধ। মনোনীত যে কমিটি হবে, তাতে সমকাল তিনবছর সম্পর্কে বলা আছে। তিনবছর মেয়াদ বাড়ানোর কথাও বলা আছে, কিন্তু কতবার বাড়ানো হবে, তার উল্লেখ নেই। ২০১৯ সালে আর একটি প্রকল্পের কথা বলা হলো, ‘‘বই ধরো, বই পড়ো’’। প্রকল্প অনুযায়ী ১ মার্চ, ২০১৯ থেকে ৩০ এপ্রিল, ২০১৯ সময়ের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের ২৪৮০টি সরকার-পোষিত গ্রন্থাগারের জন্য ১.৫ কোটি সদস্য জোগার করতে হবে। অথচ এই সময়ের মধ্যে কার্যত ৬৫০টির বেশি গ্রন্থাগার বন্ধ হয়ে গেছে। কর্মীসংখ্যা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, প্রত্যেক গ্রন্থাগার কর্মীকে দুটি/তিনটি গ্রন্থাগার সামলাতে হচ্ছে ‍ এবং এর সঙ্গে আছে বছরে ৫২টি অনুষ্ঠান সংগঠিত করা (সরকারি নির্দেশ অনুযায়ী) পরোক্ষভাবে গ্রন্থাগারকর্মীদের ওপর চাপ সৃষ্টি করা। এই পরিকল্পনা কার্যত বাতিল হয়ে যায়। অন্যভাবে বলা যেতে পারে বাস্তবায়িত হয়নি। কারণ  পরিকাঠামোর অভাব। সেই প্রকল্পের কথা আবার নতুনভাবে অন্য মোড়কে কার্যকর করার চেষ্টা চলছে।
বামফ্রন্ট সরকারের আমলে একটি আদেশনামা হয়েছিল, ২০১০ সালে (মেমো নম্বর ৫৭৩/এল এস তারিখ, ০৯.০৪.২০১০) বিনা চাঁদার গ্রন্থাগার ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য। সেই আদেশনামাকে বাতিল করে গত ১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ তারিখে বর্তমান সরকারের জনশিক্ষা প্রসার এবং গ্রন্থাগার পরিষেবা বিভাগ থেকে একটি আদেশনামা প্রকাশিত হয়। নতুন আদেশনামা অনুযায়ী ১ মার্চ, ২০১৯ তারিখ থেকে বিনা চাঁদার গ্রন্থাগার ব্যবস্থা চালু হবে। এই ব্যবস্থা কার্যকর করতে নতুন সদস্যপদ প্রদান করার কথা বলা হয়েছে। সেখানে গ্লোবাল সদস্যপদের কথাও বলা হয়েছে। এর সাথে পুরানো সদস্যদের বলা হলো নতুনভাবে সদস্যপদ নিতে হবে। কারণ নতুন ফরমে পুরানো সদস্যদের ব্যাপারে কোনও কিছু উল্লেখ নেই। গ্লোবাল সদস্যপদ দেওয়া হবে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের—যেমন সাংসদ, বিধায়ক, জেলা পরিষদের সদস্য, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, লেখক বুদ্ধিজীবী প্রভৃতি। বুদ্ধিজীবীদের আওতায় বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক/শিক্ষিকারা এবং গ্রন্থাগারিক ও অন্যান্য  পেশার ব্যক্তিরা পড়েন কিনা জানা নেই। নতুন সদস্যপদ  নেওয়ার শর্তাবলীর মধ্যে একটি শর্ত হলো ‘‘সতর্কতামূলক জমা ৫০০ (পাঁচশত টাকা), বিলম্ব জরিমানা মূল্য ২ (দুই টাকা) প্রতিদিন না বই নেওয়ার ক্ষেত্রে এই শর্ত বাধা হয়ে না দাঁড়ায়? অর্থাৎ বিনা চাঁদার গ্রন্থাগার ব্যবস্থা সত্যই কি প্রবর্তিত হলো?  গ্রন্থাগারে আগে একটি তহবিল থাকতো, যাকে বলে ‘‘অনি‍‌শ্চিত ব্যয় নির্বাহের জন্য নির্দিষ্ট তহবিল (Contigency fund)’’ সেই তহবিল থেকে গ্রন্থাগারের অনেককিছু ব্যয় নির্বাহ করা হতো। যেমন ইলেকট্রিক বিল, গ্রন্থাগারে ব্যবহৃত বিভিন্ন দ্রব্যাদি কেনা ইত্যাদি এবং এই তহবিল তৈরি হতো সদস্যদের চাঁদা থেকে। নিঃশুল্ক গ্রন্থাগার ব্যবস্থা চালু হওয়ার ফলে ঐ তহবিলের অস্তিত্ব থাকছে না। আবার এর জন্য কোনও অর্থও বরাদ্দ করা নেই। তাহলে গ্রন্থাগারের এই ধরনের ব্যয় নির্বাহ হবে কীভাবে? তার সঠিক উত্তর পাওয়া যাচ্ছে না।
১৯৭৯ সালে গ্রন্থাগার আইন প্রবর্তিত হওয়ার পর ২৪৮০টি সরকার-পোষিত গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এইসকল গ্রন্থাগারের মাধ্যমে মানুষকে পরিষেবা দেওয়ার জন্য  ৫৫২০টি পদের সৃষ্টি হয়। গত ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০২২ তারিখ পর্যন্ত যে তথ্য পাওয়া যায়, তাতে দেখা যায় ১২০০টি গ্রন্থাগার বন্ধ হয়ে গেছে এবং ৪১৭৭টি পদে  কোনও কর্মী নেই। অর্থাৎ ১৩৪৩ জন গ্রন্থাগার কর্মী বর্তমানে কর্মরত। তেমনি ১৩টি সরকারি গ্রন্থাগারে মোট ১৬২টি পদের মধ্যে ৯২টি শূন্যপদ। অর্থাৎ ৭০ জন কর্মরত। এছাড়া জেলা গ্রন্থাগার আধিকারিক দপ্তর, বিকাশভবনে অধিকর্তা, গ্রন্থাগার পরিষেবা দপ্তরেও ব্যাপক পদে কোনো কর্মী‍‌ নেই। ব্যাপক কর্মীসংখ্যা কমে যাওয়ার ফলে গ্রন্থাগার পরিষেবা ব্যাহত হচ্ছে। একজন গ্রন্থাগার কর্মীর ওপর ২/৩টি গ্রন্থাগারের দায়িত্ব দেওয়ার ফলে কোনও গ্রন্থাগার সপ্তাহে প্রত্যেকদিন খোলা থাকছে না। যার ফলে পাঠক সংখ্যা কমে যাচ্ছে। গ্রন্থাগার দপ্তরে কর্মীসংখ্যা  কমে যাওয়ার ফলে পেনশন, অন্যান্য গ্রন্থাগার কর্মী সংক্রান্ত কাজ ব্যাহত হচ্ছে। যেসকল গ্রন্থাগার ও তথ্যবিজ্ঞানের ছাত্র-ছাত্রী বিভিন্ন  বিশ্ববিদ্যালয় এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে পাশ করে বেরোচ্ছে, তাঁদেরকেও নিয়োগ না করার ফলে গ্রন্থাগারবৃত্তির সঙ্কট দেখা যাচ্ছে। গত ২৩.১১.২০১৭ তারিখে সরকারি নির্দেশ অনুযায়ী ১৮৪টি পদে অবসরপ্রাপ্ত গ্রন্থাগারিকদের চুক্তির ভিত্তিতে নিয়োগের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল।
সাহায্যপ্রাপ্ত গ্রন্থাগারগুলি থেকে অবসর নেওয়া কর্মীদের তালিকা নির্দিষ্ট প্রোফর্মায় তৈরি করে ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২২ তারিখের মধ্যে গ্রন্থাগার দপ্তরে  পাঠাতে বলা হয়েছে। অবসরপ্রাপ্তদের নিয়োগের জন্যই যে তালিকা করা হচ্ছে, তাও এই নির্দেশনামায় উল্লেখ আছে। যেখানে চার হাজারেরও বেশি শূন্যপদ, একজন গ্রন্থাগারিক কে ২/৩টি গ্রন্থাগারের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিতে হচ্ছে, গ্রন্থ ও তথ্যবিজ্ঞানের ছাত্রছাত্রী নিয়োগের জন্য বসে আছে, সেখানে অবসরপ্রাপ্ত গ্রন্থাগারিককে্  পুনর্নিয়োগ কতটা অবাস্তব তা সহজেই অনুমেয়। এরাজ্যে সাধারণ গ্রন্থাগার ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখতে হলে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তুলুন। রাজ্যের শিক্ষাব্যবস্থার ভিত শক্ত  করতে সমস্ত ধরনের গ্রন্থাগারে কর্মী নিয়োগ করে গ্রন্থাগার খোলার ব্যবস্থা করুন। ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন ছাড়া এর কোনও বিকল্প ‍ নেই। বই পড়ুন, বই পড়ান, গ্রন্থাগারে আসুন, গ্রন্থাগার বাঁচান।

 

Comments :0

Login to leave a comment