Prabhat Patnaik

নয়া ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র তৈরির পথেই হাঁটছে মোদী সরকার: প্রভাত পট্টনায়ক

রাজ্য

ছবি: রাজু ভট্টাচার্য

অনিন্দিতা দত্ত- শিলিগুড়ি 


দেশের বর্তমান শাসক দল যে ফ্যাসিবাদী নীতি নিয়ে চলছে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। ১৯৩০ সালের ফ্যাসিবাদের যতগুলি লক্ষ্মণ ছিল, তার সবগুলিই বর্তমান শাসকের মধ্যে দেখা যাচ্ছে। হয়তো এখনও ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র হয়নি, কিন্তু ওই পথেই যাচ্ছি আমরা। ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার, সংসদীয় গণতন্ত্রের অধিকার সব কিছু ধ্বংস করাই ফ্যাসিবাদের প্রধান কাজ। মোদী সরকার সেই লক্ষ্যেই এগোচ্ছে। নয়া ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র তৈরির পথেই হাঁটছে মোদী সরকার। বুধবার শিলিগুড়ি তথ্যকেন্দ্র (দীনবন্ধু মঞ্চ)-এ এক আলোচনায় একথা বলেছেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক প্রভাত পট্টনায়েক। 
এদিন রতনলাল ব্রাক্ষ্মণ মেমোরিয়াল ট্রাস্টের উদ্যোগে রতনলাল ব্রাক্ষ্মণ স্মারক বক্তৃতা অনুষ্ঠিত হয়। এই স্মারক বক্তৃতার বিষয় ছিল ‘ধান্দার ধনতন্ত্র ও নয়া ফ্যাসিবাদ’।  এদিন শুরুতেই রতনলাল ব্রাক্ষ্মণের প্রতিকৃতিতে মালা দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয়। অনুষ্ঠানের সভাপতিত্ব করেন রতনলাল ব্রাক্ষ্মণ মেমোরিয়াল ট্রাস্টের সম্পাদক জীবেশ সরকার। রতনলাল ব্রাক্ষ্মণ স্মারক বক্তৃতা দিতে গিয়ে প্রভাত পট্টনায়েক বলেন, যাদের ত্যাগ, পরিশ্রম ও উদ্যোগে ভারতবর্ষ তথা বাংলায় কমিউনিষ্ট আন্দোলন গড়ে উঠেছিল, তাঁদের মধ্যে অন্যতম ও একজন শীর্ষ ব্যক্তিত্ব ছিলেন কমরেড রতনলাল ব্রাক্ষ্মণ। তাঁর সাথে সংক্ষিপ্ত এক সাক্ষাৎকারের সময়ের কথা তিনি আলোচনায় তুলে ধরেন। পার্টি গঠনের ক্ষেত্রে কমরেড রতনলালের ভূমিকা ইতিহাসের পাতায় উল্লেখ রয়েছে। 
এদিন প্রভাত পট্টনায়েক বলেন, ফ্যাসিবাদ ও জরুরী অবস্থার মধ্যে তফাৎ রয়েছে। ফ্যাসিবাদ শুধুই যে রাষ্ট্রের শক্তি নিয়ে দমন করে তা নয়, ফ্যাসিবাদ হলো একটা মতবাদ। ফ্যাসিবাদ লগ্নিপুঁজি এবং একচেটিয়া পুঁজির সাথে খুবই ঘনিষ্টভাবে জড়িত। সবসময় একটা ছোট সংখ্যালঘু অংশকে শত্রু,  হিসেবে দেখে ওদের বিরুদ্ধে কাজ করাই ফ্যাসিবাদের মুখ্য লক্ষ্মণ। পট্টনায়েক বলেন, আমাদের দেশে এখন ফ্যাসিবাদীরা ক্ষমতায় এসেছে। ইতালি, জার্মানি, ফ্রান্সে ইউক্রেন, ইজরায়েলেও ফ্যাসিবাদীরা ক্ষমতায় আছে। একইভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ফ্যাসিবাদী ট্রাম্প একবার ক্ষমতায় এসেছিলেন, আবার ক্ষমতায় আসার চেষ্টা করছে। এর পেছনে অনেক সমর্থন রয়েছে। পোল্যান্ডে ফ্যাসিবাদী সরকার সম্প্রতি নির্বাচনে পরাজিত হয়েছে। এই প্রসঙ্গেই হিটলার, মুসোলিনীর কথা তিনি তুলে ধরেন। 
তিনি ফ্যাসিবাদ শুধু ভারতই নয়, বর্তমান সময়ে ফ্যাসিবাদ পৃথিবীব্যাপী বিস্তার লাভ করছে। কেন এমনটা হচ্ছে সেই প্রশ্নের বিভিন্ন ব্যাখ্যা পর্যায়ক্রমে তুলে ধরেছেন আলোচনায়। তিনি বলেন, এখন নতুন উদার পুঁজিবাদ একটা সঙ্কটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। একচেটিয়া পুঁজির রাজত্ব কায়েম হয়েছে। সঙ্কট একটি আতঙ্ক একচেটিয়া পুঁজির কাছে। একটি তথ্যের ভিত্তিতে জানা গেছে, অক্টোবর মাসে দেশে দশ শতাংশ বেকারি বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু সেই বিষয় নিয়ে এখন কোন আলোচনা হচ্ছে না। আলোচনা হচ্ছে অযোধ্যাতে মন্দির তৈরি নিয়ে। ফ্যাসিবাদের উদ্দেশ্য হলো মুসলমান, বাবর, মন্দির, মসজিদ নিয়ে কথা বলা। মানুষের দৃষ্টিকে ঘুরিয়ে দেওয়া। এর মধ্যে দিয়ে শ্রমিক, কৃষক সহ মানুষের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করা। নয়া তিন কৃষি বিল চালু করে কৃষকদের অধিকার কেড়ে নেবার চক্রান্তে লিপ্ত হয়েছিল মোদী সরকার। কিন্তু দিল্লির বুকে কৃষক আন্দোলনের চাপে পড়ে সেই কৃষি বিল কার্যকর করতে পারেনি সরকার। 
নতুন উদার পুঁজিবাদের সঙ্কট নিয়ে আলোচনা করে প্রভাত পট্টনায়েক বলেছেন, দেশের মানুষের আয়ের ক্ষেত্রে অসাম্য অনেক বেড়ে গেছে। কর্মসংস্থান নেই। ফরাসি ইকনমিস্ট টমাস পিকেটি’র বের করে আনা আয়করের তথ্য তিনি তুলে ধরেন। তিনি বলেন, নয়া উদার পুঁজিবাদের কারণেই অসাম্য বাড়ছে। গ্রামে কাজ নেই। গ্রামের মানুষ কাজের সন্ধানে শহরমুখো হচ্ছে। কিন্তু শহরেও কাজ নেই। একচেটিয়া পুঁজির কারণে একশ্রেণির মানুষের আয় বাড়ছে। সঙ্কটের মুখে পড়ে শ্রমিক-কৃষক সহ সাধারণ মানুষ আত্মহত্যার পথে হাঁটছে। দেশ তথা রাজ্যবাসীদের নিজেদের অধিকার ও তাদের প্রাপ্য সুবিধা দিতে হবে। টাকা আছে, কিন্তু কাছে স্কুল নেই, হাসপাতাল নেই। তাহলে শিক্ষা বা স্বাস্থ্যে উন্নতি আসতে পারে না। সবাইকে কিছু কিছু টাকা দিয়ে দিলেই দারিদ্র্য ঘুচবে না। এক্ষেত্রে খাদ্য, কাজ, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বার্ধক্য পেনশন- মৌলিক পাঁচটি অর্থনৈতিক অধিকারের দাবি জানান তিনি। ফ্যাসিবাদকে নিয়ন্ত্রণ করতে হলে নয়া উদার পুঁজিবাদী ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। কীভাবে ফ্যাসিবাদের এই সঙ্কট থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব তাও বিস্তারিতভাবে তিনি তার বক্তব্যের মধ্যে দিয়ে তুলে ধরেছেন। 

বক্তব্য রাখেন ট্রাস্টের সম্পাদক জীবেশ সরকার। এদিনের স্মারক বক্তৃতা অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন নুরুল ইসলাম। উপস্থিত ছিলেন প্রবীণ সিপিআই(এম) নেতা অশোক ভট্টাচার্য, পার্টির রাজ্য সম্পাদকমন্ডলীর সদস্য জিয়াউল আলম, দার্জিলিঙ জেলা সম্পাদক সমন পাঠক, রতনলাল ব্রাক্ষ্মণের জ্যেষ্ঠ পুত্র টিএল ব্রাক্ষ্মণ, ট্রাস্টের পক্ষে মিলন সরকার, জয় চক্রবর্তী, দিলীপ সিং, গৌতম ঘোষ, ঝরেন রায় প্রমুখ। এছাড়াও বিভিন্ন গণসংগঠনের পক্ষ থেকেও এদিন রতনলাল ব্রাক্ষ্মণের প্রতিকৃতিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয়েছে। এদিনের এই স্মারক বক্তৃতায় অসংখ্য মানুষের অংশগ্রহণে দীনবন্ধু মঞ্চ কানায় কানায় পূর্ণ ছিলো।

Comments :0

Login to leave a comment