Post Editorial

সিঙ্গুরের দায় এড়াতে দুরাত্মার যুক্তি

উত্তর সম্পাদকীয়​


চন্দন দাস


‘সিঙ্গুর’-এর জন্য মমতা ব্যানার্জির তাহলে কোনও অবদান নেই! যে আন্দোলন, অনশনের দাবি তিনি এতকাল করে এসেছেন, পাঠ্যবইয়ে পর্যন্ত ঢুকিয়েছেন— সেই সব ফালতু। মিথ্যা। 
বামফ্রন্ট নয়। সিপিআই(এম) নয়। তৃণমূল বলছে। বিজেপি চুপ থেকে পক্ষে ল্যাজ নাড়াচ্ছে। 
স্মৃতি এবং নথি বড় বেয়াদব। তারা মনে করিয়ে দিচ্ছে কারখানা আটকানোর জন্য জাতীয় সড়ক আটকে বসেছিলেন মমতা ব্যানার্জি এবং তাঁর নানা রংয়ের সাঙ্গোপাঙ্গরা। সার সার গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়েছিল। মমতা ব্যানার্জি ছবি আঁকছিলেন মঞ্চে। তাঁর সেই ‘বসে থাকা’ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। বোঝাতে নেমেছে তৃণমূলই। 
সিঙ্গুরে কারখানা আটকানোর জন্য ২৬ দিন অনশন করেছিলেন তিনি, এমনটাই দাবি করেন মমতা ব্যানার্জি। যদিও সেই অনশন নিয়ে নানা বিতর্ক আছে। তাঁর ঘনিষ্ঠ ছিলেন দীপক ঘোষ। তিনি লিখিত ভাবে জানিয়েছেন যে, গোপনে ক্যাডবেরি, স্যান্ডউইচ খেয়ে অনশন করেছিলেন আজকের মুখ্যমন্ত্রী। মমতা ব্যানার্জি সেই ‘ক্যাডবেরি, স্যান্ডউইচ’ খাওয়ার বিবরণের কোনও প্রতিবাদ করেননি। 
যাই হোক, এখন তৃণমূল দাবি করছে ওই অনশন টনশনে কিছুই যায় আসেনি। কারণ— তাদের এখনকার দাবি— সিঙ্গুর থেকে কারখানা নরেন্দ্র মোদীর মুখ্যমন্ত্রিত্বের সেই সময়কালে গুজরাটের সানন্দে সরে গিয়েছিল বামফ্রন্টের জন্য। বামফ্রন্ট সরকারের প্রশাসনিক ব্যর্থতার জন্য!
তাহলে কি সেদিন পুলিশ দিয়ে সিঙ্গুর কিংবা ধর্মতলা থেকে তৃণমূল, বিজেপি এবং তাদের সহযোগীদের তুলে দেওয়া উচিত ছিল, যেভাবে এখন আন্দোলনকারী চাকরি প্রার্থীদের মারতে মারতে তুলে দেয় মমতা ব্যানার্জির প্রশাসন?
বামফ্রন্ট তা পারত। করেনি। কারণ— চায়নি আলিমুদ্দিন স্ট্রিট। চাননি বামফ্রন্ট নেতারা। চাননি সেদিনের মুখ্যমন্ত্রী। কৃষির সাফল্যের উপর ভিত্তি করে শিল্পে অগ্রগতি সমাজবিকাশের ধারার একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়। তা শুধু কর্মসংস্থানের সঙ্গেই জড়িত নয়। জড়িয়ে থাকে ভূমিসংস্কারের সুফল, পঞ্চায়েত এবং পৌরসভাগুলি ধ্বংস হবে নাকি আরও এগিয়ে যাবে— সেই প্রশ্নগুলির সঙ্গেও। তাই সেই পর্যায়ে পথ যত কাঁটা বিছানোই, যত রক্তই ঝরুক— গণতন্ত্রের পতাকা রক্ষা করতেই হবে। এটি কমিউনিস্টদের নীতি। ছিল, আছে, থাকবে।
উল্লেখযোগ্য হলো, সেদিন সিঙ্গুরে কারখানা আটকানোর পক্ষে প্রধান যুক্তি ছিল কৃষকের জমি। মমতা ব্যানার্জির স্লোগান ছিল— ‘ভাতের কারখানা ধ্বংস করে মোটর গাড়ির কারখানা/ সে হবে না, সে হবে না।’ বামফ্রন্ট কী বলেছিল, যত শিল্পের প্রস্তাব এসেছে তার জন্য রাজ্যের মোট জমির ১%-ও লাগবে না। জনগণের টাকা চুরি করে ফূর্তি করার অভিযোগে জেলে থাকা বালু মল্লিক, পার্থ চ্যাটার্জিরা সেদিন নিজেদের ‘কৃষক দরদি’ আন্দোলনের নেতা হিসাবে দাবি করে বসেছিলেন। গত বারো বছরে মমতা ব্যানার্জির পরিবারের সদস্যরা থেকে তৃণমূলের মন্ত্রী, সাংসদ, বিধায়ক, নেতারা দেদার জমি কিনেছেন। কেন? চাষ করবেন বলে? কৃষককে জমি দেবেন বলে? একটিও কারখানা তাঁরা করেছেন সেই বিপুল টাকায় কেনা জমিতে? সেদিন ‘কৃষকের জমি’ ছিল অজুহাত— আসলে লুটের রাজত্ব কায়েম ছিল উদ্দেশ্য। 
সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ ছিল সিঙ্গুরের জমি চাষযোগ্য করে ফেরাতে হবে। জমি চাষযোগ্য হয়েছে? চাষ হয় সিঙ্গুরে? বেইমানি হয়েছে সিঙ্গুরের সঙ্গে। 
সিঙ্গুরে কারখানার জন্য জমি দিয়েছিলেন ৯০%-র বেশি কৃষিজীবী। সিঙ্গুরের যুবক যুবতী, মহিলাদের একাংশ প্রশিক্ষণ পেতে শুরু করেছিলেন। এখন একদল বলতে চাইছে সিঙ্গুরে ক্ষতিপূরণের পরিমাণ যথেষ্ট ছিল না। পশ্চিমবঙ্গ শিল্প উন্নয়ন নিগমের নথি দেখুন। দেখুন সেই সময়ে তৎকালীন সরকারের দেওয়া বিজ্ঞাপন— ক্ষতিপূরণের পরিমাণ সেই সময়ে ছিল সারা দেশে নজিরবিহীন। তার বিস্তারিত বিবরণের জন্য আর একটি প্রবন্ধ লাগবে। কিন্তু মমতা ব্যানার্জি কী বলেছিলেন? তিনি কি আরও ক্ষতিপূরণ চেয়েছিলেন? বিজেপি কী বলেছিল? তারা কি বলেছিল আরও ক্ষতিপূরণ দাও। না। মমতা ব্যানার্জি বলেছিলেন যে, সিঙ্গুরে ওয়াইন শপ, সুইমিং পুল হচ্ছে। বিজেপি সেই প্রচারে তাল দিয়েছিল। আর আজ সেই মমতা ব্যানার্জি এবং তাঁর শাগরেদরা বলছেন, ওখানে শিল্পই হচ্ছিল। খুব ভালো হচ্ছিল। বামফ্রন্ট রাখতে পারেনি! 
বোঝো কাণ্ড! 
দুরাত্মার ছলের অভাব হয় না— প্রাচীন প্রবাদ। যারা নিজেদের ‘আন্দোলন’কেই গুরুত্বহীন বলে দাবি করতে পারে, তাদের নিজেদের দল, আদর্শ (যদিও তেমন কিছু তাদের নেই), এমনকি সর্বোচ্চ এবং একমাত্র নেত্রীর প্রতিও কোনও বিশ্বাস, সম্মান নেই।
এই দলটি শুধু ক্ষমতা বোঝে। ক্ষমতায় থাকলে চুরি করা যাবে, তাই। ‘স্বর্গে দাসত্ব করার চেয়ে নরকে রাজত্ব করা ভালো’ —এই দলটির নীতিকথা। 
সিঙ্গুরে কারখানা আটকানোর জন্য মমতা ব্যানার্জিদের সেদিনের নৈরাজ্যকে আজ তৃণমূল গুরুত্বহীন প্রমাণ করতে নামার আর একটি কারণ আছে। কারণ না বলে তাদের ‘দায়িত্ব’ বলাই শ্রেয়। সেই রাস্তা আটকানো, সরকারের, তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী আবেদনে সাড়া না দেওয়া, অনশনের নামে দেশে কমিউনিস্টদের সম্পর্কে মিথ্যা কথা প্রচারের সুযোগ তৈরির পিছনে আর একটি গূঢ় কারণ ছিল। সিঙ্গুরেই আর একবার দৃঢ় হয়েছিল তৃণমূল-বিজেপি’র বোঝাপড়া। সিঙ্গুরে কারখানা আটকানোর নৈরাজ্যের সমর্থনে প্রথম থেকে ছিল বিজেপি। বিজেপি’র প্রথম সারির নেতা রাজনাথ সিং এসেছিলেন মমতা ব্যানার্জির ধর্মতলায় অনশন শুরুর দিনই। প্রকাশ্যে জানিয়েছিলেন সমর্থন। যাঁকে সাদরে বুকে টেনে নিয়ে দলের উচ্চপদ দিয়েছেন বিজেপি’র ‘নাম্বার টু’ অমিত শাহ্‌, সেই শুভেন্দু অধিকারী ছিলেন সিঙ্গুরে কারখানা আটকানোর নৈরাজ্যে মমতা ব্যানার্জির প্রধান সেনাপতি। রাজ্যবাসীর কাছে বারবার এই কথা বোঝানোর চেষ্টা করেছে তৃণমূল যে, সিঙ্গুর মমতা ব্যানার্জির। নন্দীগ্রাম শুভেন্দুর। একদমই ভুল। মিথ্যা। সেই সময়ে মমতা ব্যানার্জি বারবার স্লোগান দিয়েছেন,‘তোমার নাম আমার নাম/ সিঙ্গুর ভাঙড় নন্দীগ্রাম।’ ভিয়েতনামের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কমিউনিস্টদের ঐতিহাসিক স্লোগানের নিদারুণ টুকলি ছিল সেই স্লোগান। তবু সিঙ্গুর এবং নন্দীগ্রাম একই সঙ্গে উচ্চারণ করতেন মমতা ব্যানার্জি এবং শুভেন্দু। নন্দীগ্রামে তৃণমূল-বিজেপি-মাওবাদীরা অস্ত্রের জোরে এলাকা দখল কায়েম না করলে সিঙ্গুরে মমতা ব্যানার্জির ‘আন্দোলন’ অক্সিজেন পাচ্ছিল না। বামফ্রন্ট সরকারের ধৈর্য, বারবার আলোচনার জন্য মুখ্যমন্ত্রীর চিঠি মমতা ব্যানার্জিকে চাপে ফেলে দিয়েছিল তৃণমূল এবং তাদের বাহিনীকে। শুভেন্দু এবং মাওবাদীরা সেদিন মমতা ব্যানার্জির পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। প্রকাশ্যে এবং কৌশলে।
বিজেপি কী করেছে ১৮জন সাংসদ নিয়ে? নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগে বলেছিলেন যে, সিঙ্গুরের জন্য তিনি কিছু করবেন। তিনি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর সিঙ্গুরের জমিদাতারা চিঠি দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রীকে— সিঙ্গুরে শিল্প করার আবেদন নিয়ে। সে চিঠির জবাব আজও আসেনি! বিজেপি’র নেতারাও একাধিকবার সিঙ্গুরে গিয়ে বলেছেন যে, তাঁরা এখানে কারখানার উদ্যোগ নেবেন। হয়েছে? 
এখন রাজনীতির নোংরা কৌশলের বাধ্যবাধকতায় সিঙ্গুরে কারখানা না হওয়ার ‘কৃতিত্ব’ মমতা ব্যানার্জির থেকে কেড়ে আপাতত বামফ্রন্ট সরকারের কাঁধে ফেলতে পারলে তৃণমূল-বিজেপি, মমতা-শুভেন্দু বোঝাপড়াগুলিকে কিছুটা আড়াল করার চেষ্টা করা যাবে। 
তাতে আর একটি লাভের আশা দেখছে তৃণমূল-বিজেপি। রাজ্যজুড়ে যুব, ছাত্রদের কাজের দাবিতে আন্দোলন বিপুল সাড়া ফেলেছে। সেই আন্দোলন বেশ কয়েকবছর ধরেই চলছে। গত বারো বছরে কৃষক সমাজ এবং খেতমজুরদের দুর্দশা মারাত্মক আকার নিয়েছে। চাষে লোকসান হচ্ছে। ফসলের ন্যায্য দাম মেলে না। ফড়েদের দৌরাত্ম্য। সমবায়গুলি ভেঙে পড়েছে। লক্ষ লক্ষ যুবক ভিন রাজ্যে পাড়ি দিয়েছেন কাজের খোঁজে। তাঁদের মধ্যে স্বভাবতই গ্রামবাসীরা বেশি। পশ্চিমবঙ্গের খেতমজুর, কৃষক, মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান অন্য রাজ্যে সস্তা শ্রমের বাজার হয়ে উঠেছেন। মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার আগে কৃষক সমাজের জন্য যে স্বপ্ন মমতা ব্যানার্জি দেখিয়েছিলেন, তা কিচ্ছু পূরণ হয়নি। বরং তাঁদের অবস্থা খারাপ হয়েছে। অন্যদিকে নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রী হয়ে দেশের যুবকদের কাজের যা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তার কোনটি হয়নি। বছরে ২ কোটি চাকরি— মোদী দেননি। দেশে ম্যানুফ্যাকচারিং ক্ষেত্রের দুর্দশা। ফলে কাজ হয়নি সেখানেও। গত দশ বছরে, বিজেপি’র শাসনে বিধ্বস্ত কাজের ক্ষেত্র, শিল্প। এই পরিস্থিতিতে ছাত্র, যুবদের কাজের দাবিতে আন্দোলনের পাশে স্বাভাবিকভাবেই গ্রামের এবং শহরের বিপুল অংশের মানুষের মানুষকে সমর্থনের চিরাগ হাতে দেখা যাচ্ছে।
দেশে এবং পশ্চিমবঙ্গে সরকার বদল অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছে। মোদী কিংবা মমতা ব্যানার্জি সম্পর্কে মিডিয়ার গড়ে তোলা যাবতীয় ফানুস চুপসে নালায় পড়েছে। এই ক্ষেত্রে কাজের দাবি এই গুণগত পরিবর্তনের অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ অনুঘটক হয়ে উঠেছে।
ফলে পশ্চিমবঙ্গের ৪২টি লোকসভা এবং ২৯৪টি বিধানসভা আসনের জন্য ফের ‘সিঙ্গুর’ প্রসঙ্গ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। আর সেক্ষেত্রে আজকের বিধ্বস্ত পশ্চিমবঙ্গকে নেতৃত্ব দিতে বেরিয়ে আসা ছাত্র, যুবদের হাতে বামপন্থার নিশান চিন্তায় ফেলেছে তৃণমূল এবং বিজেপি-কে। সিঙ্গুর থেকে কারখানা বিদায়ের দায় তাই সেই বামফ্রন্টের কাঁধে চাপিয়ে দেওয়ার কৌশল নিয়েছে তারা। তাতে তৃণমূল, বিজেপি এবং দুই দলে থাকা দুই দলের এজেন্টরা নিস্তার পাওয়ার আশা দেখছে।
আর একটি রাজনৈতিক সমীকরণ আমাদের মনে রাখতে হবে। ২০০৭-০৮-এই পশ্চিমবঙ্গে কমিউনিস্ট সহ বামপন্থীদের বড় অংশ মারাত্মক আক্রমণের মুখোমুখি হয়েছিল। ওই সময়েই ভারতের রাজনীতিকে আরও দক্ষিণপন্থার দিকে, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের অনুকূলে নিয়ে যাওয়ার কাজে গতি আনা হয়েছিল। বামফ্রন্ট পরিচালিত পশ্চিমবঙ্গ থেকে কারখানা মোদীর গুজরাটে পাঠানোর জন্য দেশের বহুজাতিকরা কতটা তৃণমূল এবং বিজেপি’র হয়ে কাজ করেছিল ‘সিঙ্গুর’-কে কেন্দ্র করে কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে দেশজোড়া অপপ্রচার চালাতে তা আগামী দিনে আরও স্পষ্ট হবে। কিন্তু কেন নির্বাচনী বন্ডের নামে গোপনে প্রচুর টাকা তৃণমূল পায়, কেন সারদা চিটফান্ড মানুষের থেকে তোলা বিপুল টাকা মমতা ব্যানার্জির ছবি কিনতে, তাঁর হয়ে প্রচারের জন্য একাধিক খবরের কাগজ চালু করতে খরচ করে— এমন অনেকগুলি প্রশ্ন সেই সিঙ্গুর থেকে কারখানা তুলে গুজরাটে পাঠানোর ‘আন্দোলন’-র দিনগুলিতেই উঠতে শুরু করেছিল। বারো বছর পরে,এখন সেই প্রশ্নগুলি নানা রূপে হাটে বাজারে, দোকানে, বাড়িতে চলছে।
‘সিঙ্গুর’ শুধু সিঙ্গুর নয়— বামপন্থী শক্তিকে দুর্বল করে দেশকে আরএসএস, বিজেপি-কর্পোরেট চক্রের দিকে ঠেলে দেওয়ার উপলক্ষ্য।
এবার কাজের হাহাকার এবং কর্মসংস্থানের দাবিতে বামপন্থীদের লাগাতার আন্দোলন ‘সিঙ্গুর’ থেকে পিছু হটাচ্ছে মমতা ব্যানার্জি, বিজেপি-কে।

Comments :0

Login to leave a comment