Editorial

ইতিহাসের রাজনীতি

সম্পাদকীয় বিভাগ

Editorial


আর হচ্ছে, হবে ব‍‌লে ভাষ্যের পর ভাষ্য নয়।  মোদীর নেতৃত্বে কেন্দ্রের আরএসএস-বি‍‌জে‍‌পি সরকার পুরাণ ও প্রচলিত কাহিনির উপর ভিত্তি করে হিন্দুত্বের মোড়কে সজ্জিত কল্পিত ইতিহাস রচনার কাজ শুরু করে দিয়েছে। আরএসএস’র  পরিকল্পনা অনুযায়ী ভারতের ইতিহাসের পুনর্নির্মাণ করে তাকে হিন্দুত্বের আধারে পরিবেশন করার কাজ‍‌ শুরু হয়েছিল মোদী ক্ষমতায় আসার পর থেকেই। তারজন্য ইতিহাস গবেষণার শীর্ষপদের বসানো হয় হিন্দুত্ববাদের প্রতি আত্মসমর্পিত এক ব্যক্তিকে।‍ তেমনি উচ্চশিক্ষার অঙ্গণকে হিন্দুত্ববাদের অনুকূলে সাজিয়ে তুলতে ইউজিসি’র মাথায় বসানো হয় আরএসএস ঘনিষ্ট লোককে। 

 

 

উচ্চশিক্ষা থে‍কে যুক্তিবাদী চিন্তা ও বিজ্ঞানভিত্তিক চর্চাকে অপসারণের জন্য পাঠ্যসূচি থেকে শুরু করে শিক্ষার ধরনধারণ সবই বদলে ফেলা হচ্ছে। পালটে দেওয়া হচ্ছে গবেষণা পদ্ধতি। পূর্ব নির্ধারিত সিদ্ধান্তকে অবৈজ্ঞানিক গবেষণা স্বীকৃতি ‍ দেবার কৌশলী শর্তে ছাড়পত্র পাচ্ছে গবেষণার কাজ। বিদ্যালয় স্তরেও পাঠ্যসূচিত অগ্রাধিকার পাচ্ছে পুরাণের গল্প ও কল্পিত কাহিনি। সেগুলিকেই সত্য বলে শিশুদের শেখানো হচ্ছে।

 

 


ইতিহাস সম্পর্কে সঙ্ঘ পরিবারের অভিজ্ঞান হলো ঘটনা বাস্তবে যাই ঘটে থাকুক হিন্দু পুরাণ, মহাকাব্য বা প্রচলিত কাহিনিতে যা বিবৃত সেটাই ইতিহাস। উগ্র জাতীয়‌তাবাদ ও কট্টর ধর্মান্ধতাই সঙ্ঘ পরিবারের ‍ ইতিহাসের ভিত্তি। এই  ভিত্তির উপর যেহেতু আধুনিক বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণায় সত্য ইতিহাস রচনা করা যায় না তাই তারা  যুক্তি ও বিজ্ঞান নির্ভর ইতিহাস গবেষণাকে সরকারিভাবে বর্জন করতে মরিয়া। আরএসএস’র কাঙ্ক্ষিত ভারতের হিন্দুত্ববাদী ‘গৌরবে’র ইতিহাস রচনা তাই একান্তভাবেই তথ্য প্রমাণহীন যুক্তির নিক্তিতে না করা মনগড়া ইতিহাস। এমন ইতিহাস রচনাতেই জোর দিচ্ছেন মোদী শাহ’রা। 

 

হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির স্বার্থে মূলত মুসলিম বিরোধী ঘটনাগুলিকে নিজেদের মনের মাধুরী মিশিয়ে  গৌরবোজ্জ্বল করে সাজাতে   চাইছে। তেমনি  ইতিহাস গবেষণার বিশ্ব স্বীকৃতি আধুনিক যুক্তি নির্ভর ও বিজ্ঞানভিত্তিক প্রথা ও পদ্ধতিকে বিদেশিদের-ব্রিটিশদের ষড়যন্ত্র বলে চালিয়ে মানুষকে বোকা বানানোর চেষ্টা হচ্ছে। ইতিহাস প্রসঙ্গে আজ যারা ব্রিটিশদের বিরোধিতা করছে তারাই পরাধীন ভারতে ছিল ব্রিটিশদের এক নম্বরের দালাল। ব্রিটিশদের তাড়িয়ে দেশ স্বাধীন করার লড়াইয়ে তাদের কোনও ভূমিকা ছিল না। তখন দেশপ্রেম ব্রিটিশদের কাছে বন্ধক রাখা ছিল। দেশ স্বাধীন হবার পর খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এসে তারা দেশপ্রেমের বুলি আওড়াচ্ছেন।

 

 

 


সপ্তদশ শতকে অহম রাজার সেনাপতি লচিত বরফুকণের ৪০০তম জন্মদিবস ঘটা করে পালন করছে মোদী সরকার। দি‍‌ল্লিতে হয়েছে বিশাল আয়োজন। বরফুকণকে ভারতের হিন্দু গৌরবের ‍শিরোমণি হিসাবে তুলে ধরে নতুন ইতিহাস রচনার পক্ষে জোরালো সওয়াল করেছেন ‍ মোদী এবং শাহ। আবেগ তাড়িত ভাষণে বলা হয়েছে সরাইঘাটের যুদ্ধে যদি মুঘলদের  আটকানো না যেত তাহলে গোটা দক্ষিণ পূর্ব এশিয়াই মুঘলদের অধীনে চলে যেত। বরফুকন সম্পর্কে যেসব কাহিনি উল্লেখ করে মোদী-শাহরা তার যে বীরগাঁথা রচনা করেছেন বাস্তবে সেটা ইতিহাস গবেষণায় উত্তীর্ণ সত্য নয়। আধুনিক ইতিহাস গবেষণা এই সত্যই উদ্‌ঘাটন করেছে যে অহমরা আদৌ ভারতের ভূমি সন্তান বা আদি বাসিন্দা নয়। 

 

ইতিহাস বলছে ৭১২ সালেই মহম্মদ বিন কাসেম ভারতে শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। সুলতান মামুদ ভারতে আসেন ১১ শতকে। ১২০৬ সালে সুলতানি সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা হয়ে গেছে। অহম (বর্তমান আসাম) সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা চীনের ইউনান থেকে প্রথম ভারতে আসেন ১২২৮ সালে। তাহলে হিন্দুত্ববাদীদের বিচারে মুসলিমরা বিদেশি হলেও অহমরাও তো বিদেশি হয়ে যায়। অহম রাজার সেনাপতি বরফুকন যুদ্ধ করেছিলেন মুঘল সেনাপতি রাজপুত রাম সিংহ’র বিরুদ্ধে। সেই যুদ্ধে মুঘল বাহিনীতে ছিল মূলত ছিল বাংলার সেনা এবং কোচ তীরন্দাজরা। তাহলে কি রাজপুত, বাংলার মানুষ ও কোচরা ভারতের গৌরবের অধিকারী নয়? ইতিহাস যদি পূর্ব নির্ধারিত সিদ্ধান্ত হয় তাহলে গোঁজামিলে সোজা করার জন্য মিথ্যার আশ্রয় নিতেই হয় এবং তালগোল পাকাতেই হয়।
 

Comments :0

Login to leave a comment