Post Editorial

শাসকের সুরক্ষা প্রাচীর

উত্তর সম্পাদকীয়​

 
মণীন্দ্র চক্রবর্তী

 

        
        যথাযোগ্য রাজ পারিতোষিকের বিনিময়ে, সমাজ তথা গোটা বিশ্বে ঘটে চলা বিভিন্ন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সুচতুর কায়দায় যারা নিজেদের অবস্থান এবং ইতি কর্তব্য নিরূপণ করেন, তথা শাসক শ্রেণির সপক্ষে জনমত গঠনের অভিপ্রায়ে তদনুযায়ী অভিমত ব্যক্ত করেন, প্রাতিষ্ঠানিক বুদ্ধিজীবী বলতে ইদানিং সচরাচর তাদেরকেই বোঝায়। সমাজের সুবিধাভোগী অংশের বৃত্তে প্রতিপালিত এই সাবেক বুদ্ধিজীবীদের এহেন অবস্থানেই স্পষ্ট হয় তাদের শ্রেণিগত অবস্থান এবং পরিচয়। 
        সভ্যতার ক্রমবিকাশের অন্যতম ঐতিহাসিক শর্ত হলো, প্রচলিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় সুবিধাভোগী অংশের সঙ্গে সুবিধাহীন অংশের নিরন্তর সংঘাত। এবং এই সংঘাতের পরিণতিতে গড়ে ওঠে এক ধরনের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পরিবর্তে আরেক ধরনের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। তবে এই পরিবর্তন মসৃণ পথে ঘটে না। এ পথে সুবিধাভোগী এবং সুবিধাহীনের সংঘাত অনিবার্য। প্রতিটি নতুন অর্থনৈতিক ব্যবস্থা মানুষের গড়পড়তা জীবনযাত্রার মানকে উন্নততর করে তুলতে সক্ষম হলেও, সমাজে শোষণ- বঞ্চনার অবসান ঘটাতে তা সমর্থ নয়। ফলে, শাসক ও শোষিতের এই দ্বন্দ্ব চিরায়ত। যেহেতু প্রচলিত অর্থনীতিতে শাসকের পাল্লা ভারী, তাই অপেক্ষাকৃত নতুন আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা গড়ে ওঠার সাথে সাথেই সমাজের সুবিধাভোগী শাসক শ্রেণি এই নয়া অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বুনিয়াদটিকে সুদৃঢ় করার জন্য রাজনীতি, আইন, দর্শন, শিল্প- সাহিত্যের মতো উপরিকাঠামোগুলিকে নির্মাণ করে। যার মধ্যে দিয়ে গড়ে ওঠে মানুষের অভ্যাস, ন্যায়- নীতিবোধ, অনুভূতি, অভিমত, আশা-আকাঙ্ক্ষা, আদর্শ প্রভৃতি। সুতরাং অর্থনৈতিক স্বার্থের সংঘাতের ভিত্তিতে উদ্ভূত শ্রেণি সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটলেও, কেবলমাত্র অর্থনৈতিক সংগ্রাম পরিচালনার ভিতর দিয়ে এই পরিবর্তন সাধন করা সম্ভব নয়। যে রাজনীতি, আইন, দর্শন, শিল্প- সাহিত্য ইত্যাদি উপরিকাঠামোগুলিকে নির্মাণ করে এবং যার মধ্যে দিয়ে মানুষের অভ্যাস, ন্যায়-নীতিবোধ, অনুভূতি, অভিমত, আশা-আকাঙ্ক্ষা, আদর্শ প্রভৃতি প্রকরণগুলি তার চেতনার নিয়ন্ত্রক হয়ে ওঠে, সেগুলির বিরুদ্ধেও সংগ্রাম পরিচালনা করতে হয়। 
         এই সংগ্রাম যেদিন দাসকে ভূমিদাসে এবং ভূমিদাসকে মজুরি দাসে পরিণত করেছিল সেদিন থেকেই মানুষের সৃষ্ট যাবতীয় সম্পদে অল্প কিছু মানুষের ভোগদখল ও আধিপত্যের বিপরীতে সংগঠিত হয়ে আসছে মানুষের বেঁচে থাকার লড়াই। যদি আমাদের দেশের কথাই ধরি, তাহলে দেখা যাবে, দেশের প্রচলিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা আজ গভীর সঙ্কটে নিমজ্জিত। অলীক স্বপ্নের ডানায় ভর করে দেশবাসীর সামনে মনগড়া কিছু কাহিনির উপস্থাপন ছাড়া দেশের বর্তমান সরকার উদার অর্থনৈতিক কাঠামোর মধ্যে দাঁড়িয়ে এমন কোনও পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারছে না, যা জনজীবনের ন্যূনতম চাহিদা তথা সমস্যাগুলির সমাধান করতে পারে। ফলে, প্রচলিত এই অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটিয়ে নতুন অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে জনজীবনের আশু সমস্যাগুলির সমাধানের যাবতীয় সম্ভাবনা। 
      কিন্তু প্রচলিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় সুবিধাভোগী শাসক শ্রেণি এ ব্যবস্থার পরিবর্তনের বিরোধী। তার জন্য তারা জনগণের মধ্যে এমন কিছু অভ্যাস, নীতিবোধ, অনুভূতি, অভিমত, আশা- আকাঙ্ক্ষা, আদর্শ প্রভৃতি গড়ে তুলতে উদ্যোগী হয়, যাতে জনগণের মধ্যে নতুন অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার সামান্যতম আকাঙ্ক্ষার জন্ম না নিতে পারে। এবং সেই লক্ষ্যেই পরিকল্পিতভাবে জনগণের নৈতিকতার অবক্ষয় ঘটানোর যাবতীয় উদ্যোগ বাস্তবায়িত করার কাজ চলছে। 
         কাজেই, একেবারে প্রাথমিক স্তর থেকে স্নাতক স্তর অবধি পাঠ্যসূচি তথা পাঠক্রম পরিবর্তন করার জন্য বিজেপি’র এই তৎপরতা, কিংবা সংসদ ভবন উদ্বোধন থেকে চন্দ্রযানের মতো অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারের ক্ষেত্রেও ধর্মীয় রীতিনীতি এবং আচার সংহিতা পালন কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। শিক্ষাদীক্ষা, নীতিবোধ, বুদ্ধি চর্চা, শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, রাজনীতি এমনকি সামাজিক দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গিগুলিকেও যাতে প্রতিক্রিয়ার শক্তির ক্রীড়নকে পরিণত করা যায়, আরএসএস-বিজেপি প্রতিদিন সেই প্রয়াস চালাচ্ছে রাষ্ট্র ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে। 
         একথা অস্বীকার করার উপায় নেই, প্রতিটি জাতি কিংবা জনগোষ্ঠীর মধ্যেই বুর্জোয়া ব্যক্তিতান্ত্রিক সংস্কৃতিগত জোট বর্তমান। যা আপস করে চলছে মানুষের আদিমতম সত্তাগুলির সাথে। অন্যদিকে, এই মানুষের মধ্যেই বিকশিত হচ্ছে পরিবর্তনশীল বহু চিন্তা-চেতনা যা কিনা প্রকৃতির তথা সমাজ পরিবর্তনের সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ। প্রতি মুহূর্তে জগৎ প্রকৃতি যেভাবে তার গতিপ্রকৃতি পালটাচ্ছে, ঠিক তেমনি পরিবর্তন হচ্ছে মানুষেরও। এই দুইয়ের লড়াই থেকে অর্জিত মানবিক মূল্যবোধ ঐতিহাসিক কারণেই বৈপ্লবিক সত্তার নির্ণায়ক শক্তি হয়ে ওঠে। একদিকে তা গণতান্ত্রিক এবং সমাজতান্ত্রিক মূল্যবোধের পরিসরে প্রতিপালিত যাবতীয় লড়াই সংগ্রামগুলিকে শাসন শোষণের অবসানের লক্ষ্যে পরিচালিত করতে পারে। বিপরীতে, মানুষের আদিমতম সত্তা যেখানে জয়যুক্ত হয়, সেখানে সমাজে অবক্ষয় হয়ে ওঠে অবশ্যম্ভাবী। ক্ষয়িষ্ণু মূল্যবোধের সেই চর্চা প্রতিক্রিয়ার শক্তিকে উৎসাহিত করে। তাই, শাসক সর্বদা ক্ষয়িষ্ণু মূল্যবোধের চর্চাকে নিরন্তর উৎসাহিত করে চলে। এবং এক্ষেত্রে সমাজের প্রথাগত বুদ্ধিজীবীরা হয়ে ওঠেন শাসকের অন্যতম সহায়ক শক্তি। 
         তাই, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের এক সমাবর্তন অনুষ্ঠানে ১৯২৩ সালে মুসোলিনি ভাষণ দিতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘‘ফ্যাসিস্ত সরকারের প্রয়োজন একটি শাসকশ্রেণির। ...রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য আবশ্যক কর্মকর্তাদের আমি শূন্য থেকে সৃষ্টি করতে পারবো না। বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকেই তাদের ক্রমে ক্রমে গঠন করে দিতে হবে আমার জন্য। আমরা পশ্চাৎপদ ও সদ্য উপস্থিত বলেই আমাদের বুদ্ধিজীবী শ্রেণিকে শক্তিমান করে তুলতে হবে।’’
       ফ্যাসিস্ত মুসোলিনি খুব পরিষ্কারভাবেই বুঝেছিলেন, জাতি রাষ্ট্র তথা সমাজের মধ্যে মূল্যবোধের দিক থেকেই সবার আগে আধিপত্য কায়েম করতে হবে। তাহলেই স্বৈরাচারী শাসন শোষণ পাকাপোক্ত করা সম্ভব। সেই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই ফ্যাসিস্ত মুসোলিনি দেশ বিদেশের প্রথাগত বুদ্ধিজীবীদের এমনকি মধ্যপন্থার বুদ্ধিজীবীদেরও চিন্তার উপাদান দিয়ে তাদেরকে রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা, পুরস্কার প্রদান, অর্থ-বিত্ত দিয়ে শক্তিশালী করেছিলেন। এবং এই শক্তিশালী বুদ্ধিজীবীদের ক্রিয়া কর্ম দ্বারা গোটা ইতালীর জাতি গোষ্ঠীকে মোহাচ্ছন্ন করে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন। এমনকি শিক্ষা ব্যবস্থা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে এমন সব বিষয় অন্তর্ভুক্ত করে দেওয়া হয়েছিল যেখানে ধর্ম শিক্ষা, প্রযুক্তি ও কারিগরি শিক্ষার চাইতে বেশি গুরুত্ব পায়। ফলশ্রুতিতে, লাঠি, গুলি, টিয়ারগ্যাসের মতো দমন পীড়ন মূলক ব্যবস্থা গ্রহণ ব্যতিরেকেই জনগণই হয়ে উঠেছিল ফ্যাসিস্ত মুসোলিনির সবচেয়ে বড় সুরক্ষা প্রাচীর।
        মুসোলিনির পদাঙ্ক অনুসরণ করে মোদী-মমতারাও চাইছে এ ধরনের একটি সমর্থনের প্রাচীর নির্মাণ করতে। নচেৎ, গত চার মাস ধরে মণিপুরে থানা জ্বালানো থেকে শুরু করে পুলিশের অস্ত্র লুট, শতাধিক খুন, সর্বোপরি মহিলাদের বিবস্ত্র করে ঘোরানোর মতো চরম অমানবিক ঘটনা দেখার পরেও যে গোদী মিডিয়া মুখে কুলুপ এঁটে ছিল, একবারের জন্যেও যারা মণিপুরে যাবার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করল না, তারাই এখন ইজরায়েলের বুকে হামাস হামলার নিন্দায় সরব। অথচ আশ্চর্যরকম নীরব ইজরায়েলের হামলার বিরুদ্ধে। প্রবল উৎসাহে উৎসাহিত হয়ে এদের কয়েকটি আবার তাদের প্রতিনিধি পাঠিয়ে দিয়েছেন ইজরায়েলে, গাজা স্ট্রিপে একজনও যাননি। এই অতি সক্রিয়তার কারণটি নিছক সাংবাদিকতা নয়। অবশ্যই রাজনৈতিক। 
        সেই রাজনৈতিক কারণেই, রাজ্য সরকারের অপদার্থতায় কামদুনি মামলায় ফাঁসির দণ্ডাদেশপ্রাপ্ত আসামিদের শাস্তি মকুব হতেই, তাৎপর্যপূর্ণভাবে বিজেপি পথে নেমেছে। কাঠুয়ায় নাবালিকার ধর্ষকদের মুক্তির দাবিতে মিছিল করেছিল যারা, সেই বিজেপি আজ মিছিল করছে ধর্ষকদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে! মনে রাখতে হবে, কাঠুয়ার নৃশংস ঘটনাটি ঘটেছিল উপাসনালয়ের অভ্যন্তরে। হিন্দুরা যেটিকে পবিত্রতম স্থান বলে মনে করেন। আরও লজ্জার বিষয় হলো, খোদ পূজারী যুক্ত ছিলেন সেই ধর্ষণের ঘটনায়। যেহেতু ধর্ষিতার পরিচয় ছিল সংখ্যালঘু, তাই ধর্ষিতার পক্ষ নেবার পরিবর্তে হিন্দু ধর্ষকদের বাঁচাতে উদগ্রীব হয়েছিল বিজেপি। কিন্তু কামদুনিতে ঘটেছিল ঠিক বিপরীত ঘটনা। ধর্ষিতা ছিলেন হিন্দু, ধর্ষকরা অনেকেই সংখ্যালঘু। ফলে, ধর্ষকদের শাস্তির দাবিতে বিজেপি’র তৎপরতা বেড়েছে। এবং এই একই কারণে বিজেপি হামাস হামলার ঘটনায় যতখানি মুখর, ঠিক ততটাই নীরব ইজরায়েলের হানাদারির বিরুদ্ধে। একইভাবে, নন্দীগ্রামে হাজার হাজার শিশুকে পা চিরে হত্যা করা কিংবা মহিলাদের উপর ধর্ষণ এবং তাদের স্তন কেটে নেবার মনগড়া কাহিনিকে সম্বল করে একদিন যারা রাজপথ কাঁপানো মিছিল সংগঠিত করেছিলেন, কামদুনির ঘটনায় তাঁরা আশ্চর্য রকম নীরব! নিয়োগ দুর্নীতির মতো প্রায় প্রতিদিনই শাসকদলের একটার পর একটা দুর্নীতির ঘটনা উন্মোচিত হতে দেখেও তারা হীরন্ময় নীরবতা পালন করে চলেছেন। এমনকি, রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে প্রায় প্রতিদিন মহিলাদের উপর হিংসার ঘটনা ঘটলেও রাজ্যের বুদ্ধিজীবীদের তা চোখে পড়ে না। কারণ, পর্যাপ্ত উপঢৌকন এবং শ্রেণিগত অবস্থান থেকেই তারা আজ শাসকের সুরক্ষা প্রাচীরের একটি অপরিহার্য অনুষঙ্গ হতে প্রস্তুত।

 
 

Comments :0

Login to leave a comment