TMC strong room

এবার রাতের অন্ধকারে তৃণমূলের হানা স্ট্রং রুমে, প্রতিরোধ মানুষের

রাজ্য পঞ্চায়েত ২০২৩

ভোট লুট করেও কি নিশ্চিন্তে থাকতে পারছে না শাসক তৃণমূল? ভোটের দিন প্রতিরোধের মেজাজে ভোট লুট রুখে দিয়ে রাজ্যের একাধিক প্রান্তে মানুষ যেভাবে রাত পর্যন্ত ভোটের লাইনে দাঁড়িয়ে থেকেছেন, তাতেই কি শঙ্কিত মমতা ব্যানার্জির দল?
গণনার আগের দুই রাতে একাধিক জায়গায় স্ট্রং রুমে শাসক তৃণমূলের দাপাদাপিতে সেই সন্দেহই প্রবল হচ্ছে। একইসঙ্গে মালদহের মোথাবাড়ি থেকে পূর্ব মেদিনীপুরের তমলুক, হাওড়ার উলুবেড়িয়া, ডোমজুড়ে যেভাবে মধ্যরাতেই স্ট্রং রুমে তৃণমূলীরা জড়ো হয়েছে শুনে মানুষ রাস্তায় নেমে আসেন, তা রীতি মতো তাৎপর্যপূর্ণ। মাঝরাত পর্যন্ত রাস্তায় বসে মানুষজন। যে প্রতিরোধের মেজাজে ৮ জুলাই ভোটে নেমেছিলন বামফ্রন্ট-কংগ্রেস-আইএসএফ’র কর্মী,-সমর্থকরা সেই মেজাজেই গণনাকেন্দ্র পাহারা দেওয়া চলছে। মোথাবাড়ি থেকে তমলুক— ক্ষুব্ধ জনগণের বিক্ষোভের মুখে পড়ে মারও খেতে হয় শাসক দলের নেতা-কর্মীদের। তাঁদের গাড়িও ভাঙচুর হয়। 
ঘটনা পরম্পরাই স্পষ্ট করছে, শাসক তৃণমূলকে কোনওভাবেই একতরফা দখলদারির সুযোগ দিতে নারাজ গ্রামীণ জনগণের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ। 
রবিবার গভীর রাতে মালদহের মোথাবাড়িতে স্ট্রং রুমের সামনে মন্ত্রী সাবিনা ইয়াসমিনকে দেখে বিরোধীরা ব্যালট বাক্স লুটের আশঙ্কা করে। গোটা রাত বিরোধী দলের নেতা-কর্মীরা স্ট্রং রুমের সামনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকেন। ভাঙচুর হয় কালিয়াচক-২ নম্বর ব্লক তৃণমূলের সভাপতি, শাসক দলের জেলা পরিষদ প্রার্থী হাসিমুদ্দিন আহমেদের গাড়ি। আক্রান্ত হন তাঁর ছেলেও।
ঘটনার সূত্রপাত স্ট্রং রুমে পাহারাদারি নিয়ে। নির্বাচনের আগেই সর্বদলীয় বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, প্রতিটি রাজনৈতিক দলের তরফে তিন জন করে স্ট্রং রুমের ওয়াচ রুমে থেকে পাহারা দিতে পারবেন। তার জন্য বিডিও’র অনুমতিপত্র সঙ্গে রাখতে হবে। সেই অনুযায়ী অন্যান্য দলগুলি বিডিও’র অনুমতিপত্র সংগ্রহ করলেও তৃণমূল তা করেনি। ফলে কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানরা ওয়াচ রুমে তৃণমূলের কাউকে প্রবেশ করতে দেননি। এরই মধ্যে রবিবার রাত সাড়ে ১১টা নাগাদ মোথাবাড়ির স্ট্রং রুমে দলবল নিয়ে হাজির হন মন্ত্রী সাবিনা ইয়াসমিন। কেন্দ্রীয় বাহিনীর সঙ্গে বচসায় জড়িয়ে পড়েন তাঁরা।
এরই মধ্যে চাউর হয়ে যায়, মন্ত্রী দলবল নিয়ে স্ট্রং রুমে জোর করে ঢোকার চেষ্টা করছেন। সেই খবর পেয়েই বিরোধী দলের নেতা-কর্মীরা ঘটনাস্থলে ছুটে যান। স্ট্রং রুমের সামনে থেকে মন্ত্রী সহ তৃণমূলের লোকজনকে সরিয়ে দেওয়া হয়। বিরোধীরা স্ট্রং রুমের সামনে পাহারাদারি শুরু করেন। ঘটনাস্থলে ছুটে যায় বিশাল পুলিশবাহিনী, যায় কেন্দ্রীয় বাহিনীও। সেই সময়েই হাসিমুদ্দিন আহমেদের গাড়ি ভাঙচুর করে ক্ষুব্ধ জনতা। কংগ্রেসের জেলা পরিষদের প্রার্থী দুলাল শেখ বলেছেন, ‘‘রাত ১২টার সময়ে স্ট্রং রুমের সামনে মন্ত্রী সাবিনা ইয়াসমিন কী করছিলেন? আমাদের কাছে খবর ছিল, তিনি কয়েকশো কর্মী নিয়ে ব্যালট বাক্স লুট করার চেষ্টা করবেন। গতকাল রাতে সেটাই ঘটেছিল। সেই খবর পেয়ে আমরা ব্যালট বাক্স লুটের পরিকল্পনা ভেস্তে দিয়েছি।’’
রাতেই খবর পেয়ে স্ট্রং রুমের কাছে পৌঁছান সিপিআই(এম)‘র জেলা পরিষদের প্রার্থী নৈমুদ্দিন শেখ। পার্টির জেলা সম্পাদক অম্বর মিত্র বলেছেন, রবিবার রাতে যেভাবে একজন মন্ত্রী মোথাবাড়ি  হাই স্কুলে আচরণবিধি ভেঙ্গে স্ট্রং রুমে ঢুকেছিলেন এবং প্রশাসনিক আধিকারিকরা তাতে বাধা না দিয়ে সহায়তা করেছেন, তা অপরাধ। পরাজয়ের আশঙ্কা থেকেই এখন ভোটের পরে ব্যালট লুটের চেষ্টা করছে তৃণমূল। 
মোথাবাড়ি যখন রবিবার রাতে উত্তাল, ঠিক সেই সময়েই আবার উলুবেড়িয়া উত্তর কেন্দ্রের বিধায়ক নির্মল মাজি স্ট্রং রুমে ঢুকেছেন, এই অভিযোগে উত্তাল হয় হাওড়ার রাজাপুর থানার সাইনী ইন্টারন্যাশনাল স্কুল। স্ট্রং রুম হয়েছে ওই স্কুলেই। স্ট্রং রুম ঘিরে রেখে বিক্ষোভ চলে গ্রামবাসীদের। পরে পুলিশ লাঠি চালিয়ে ও কাঁদানে গ্যাস ছুঁড়ে ঘটনাস্থল থেকে বিক্ষোভকারীদের হটিয়ে দেয়। 
এখানে উলুবেড়িয়া-২ নম্বর ব্লকের স্ট্রং রুমের ব্যবস্থা করা হয়েছে। রবিবার সন্ধ্যায় স্ট্রং রুম চত্বরে বিধায়ক নির্মল মাজি ও উলুবেড়িয়া-২ নম্বর পঞ্চায়েত সমিতির প্রাক্তন সভাপতি সেখ ইলিয়াসকে দেখতে পান গ্রামবাসীরা। তাঁদের অভিযোগ, নির্মল মাজি ও ইলিয়াস ভোট চুরি করতে স্ট্রং রুমে ঢুকেছেন। এই খবর ছড়িয়ে পড়তেই শয়ে শয়ে মানুষ স্ট্রং রুমের সামনে জড়ো হতে থাকেন। তাঁরা গোটা স্ট্রং রুম চত্বর ঘিরে ধরে বিক্ষোভ দেখাতে থাকেন। ‘চোর নির্মল মাজিকে গ্রেপ্তার করতে হবে’— এই দাবিতে মুখরিত হয় সাইনী ইন্টারন্যাশনাল স্কুল প্রাঙ্গন। রাত সাড়ে বারোটা পর্যন্ত চলে বিক্ষোভ। পরে তৃণমূলী নির্দেশেই  পুলিশ এলাকায় ব্যাপক লাঠি চালাতে শুরু করে। সঙ্গে কাঁদানে গ্যাসের বহু সেল ফাটায়। বিক্ষোভকারীদের বাইকগুলিও ভাঙচুর করে পুলিশ। এমনকী সাংবাদিকদের বাইকও ভেঙে দেয় পুলিশ। তারপর চার জন বিক্ষোভকারীকে গ্রেপ্তারও করা হয়। ধৃতদের সোমবার উলুবেড়িয়া আদালতে তোলা হলে বিচারক ১৪ দিনের জেলা হেপাজতের নির্দেশ দেন।
অন্যদিকে, রবিবার রাতেই ভোট গণনা কেন্দ্রের পাঁচিল ভাঙাকে কেন্দ্র করে উত্তেজনা ছড়ায় ডোমজুড় অঞ্চলে। ডোমজুড় ব্লকের ভোট গণনা হবে ডোমজুড় আজাদ হিন্দ কলেজে। রবিবার রাতে স্থানীয় বাসিন্দারা দেখতে পান কলেজের পিছন দিকের পাঁচিল ভাঙা। খবর ছড়িয়ে পড়তেই কলেজের গেটের সামনে চলে যান সিপিআই(এম)’র কর্মী-সমর্থকরা। বিক্ষোভ শুরু হয় কলেজের গেটে। পার্টির কর্মীরা অভিযোগ করেন, কলেজের পাঁচিল ভেঙে ঢুকে স্ট্রং রুমের ভিতরে গিয়ে ব্যালট বাক্স খুলে ছাপ্পা দেওয়ার জন্যই তৃণমূল কংগ্রেস এই কাজ করেছে। ঘটনাস্থলে পৌঁছান জেলা প্রশাসনের আধিকারিকরা। কেন পাঁচিল ভাঙা হলো, সেই প্রশ্নের উত্তরে ডোমজুড়ের বিডিও জানান, গণনা শেষ হলে কাউন্টিং এজেন্টদের বাইরে বের করার জন্য এই পাঁচিল ভাঙা হয়েছে। কিন্তু রাতের অন্ধকারে কেন এই কাজ করা হলো, সেই প্রশ্নের কোনও সদুত্তর দিতে পারেননি ডোমজুড়ের বিডিও। উত্তেজিত পার্টিকর্মী ও স্থানীয় বাসিন্দারা রাতেই হাওড়া-আমতা রোড অবরোধ করে প্রতিবাদ জানান। শেষে পাটির কর্মী-নেতাদের চাপে ভাঙা পাঁচিল ফের তৈরি করা হয়।
আরেকটি ঘটনায় স্ট্রং রুমে ছাপ্পা মারতে গিয়ে গ্রামবাসীদের হাতে বেধড়ক মার খেয়েছেন তমলুকের তৃণমূল নেতা চঞ্চল খাঁড়া। তিনি তমলুক শহর তৃণমূল কংগ্রেস কমিটির সভাপতি, সেই সঙ্গে তমলুক পৌরসভার কাউন্সিলর। তমলুক ব্লকের স্ট্রং রুম হয়েছে নাইকুড়ির ঠাকুর দাস ইনস্টিটিউশনে। রবিবার দুপুরের পর এলাকাবাসী দেখেন, এই স্ট্রং রুমের পেছনের দিকের দরজাটি খোলা রয়েছে। তা নিয়ে বিক্ষোভ চলে স্ট্রং রুমের সামনে। জানা যায়, রবিবার বিকালের দিকে তমলুকের ওই তৃণমূল নেতা নিজের মোটরবাইকে যান স্ট্রং রুম এলাকায়। এলাকাবাসীর সন্দেহ হয়। আর তারপরেই স্ট্রং রুম চত্বরে সন্দেহজনক বেশ কয়েক জনকে ঘোরাফেরা করতে দেখা যায়। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তারা চঞ্চল খাঁড়ার লোক। আর এরপরেই সাধারণ মানুষের সঙ্গে তর্কাতর্কি শুরু হয় ওই তৃণমূল নেতার। নিজেদের দেওয়া ভোটের বাক্স সুরক্ষিত রাখতে এককাট্টা হয়ে ওই তৃণমূল নেতার উপর চড়াও হন এলাকাবাসী। সোস্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা যায়, বেধড়ক মারা হয় চঞ্চল খাঁড়াকে। তাঁর মোটরবাইকও জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। পাশাপাশি একটি ম্যাটাডোর এবং একটি চার চাকা গাড়িও জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে।
 

Comments :0

Login to leave a comment