Editorial

রাষ্ট্রবাদের আড়ালে সম্রাট হবার চেষ্টা

সম্পাদকীয় বিভাগ


বিশ্বশান্তির পতাকা উড়িয়ে জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে যে ভারত সৌভ্রাতৃত্ব ও মৈত্রীর আহ্বান জানিয়ে যে ভারত গোটা বিশ্বের সম্ভ্রম আদায় করে নিজেকে মর্যাদার উচ্চাসনে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছিল আজ নিম্নমানের অযোগ্যদের হাতে পড়ে সেই সম্মান মুছে যেতে বসেছে। ভারত কখনোই এটা ভাবেনি সামরিক শক্তিতে বলীয়ান হয়ে বোমা-ক্ষেপণাস্ত্রের মুখে দুনিয়াকে পদানত করে আপন শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করবে। বরং ভেবেছে উলটোটা। মানবতার বৃহত্তর আদর্শে অনুপ্রাণিত করে সকল দেশের সকল মানুষের বন্ধু হতে, সহযোগী হতে চেয়েছিল। রাষ্ট্রের সঙ্গে রাষ্ট্রের বা সরকারের সঙ্গে সরকারের বন্ধুত্ব নয়, মানুষের সঙ্গে মানুষের বন্ধুত্ব ও ঐক্যই মানব সভ্যতার বিকাশের সেরা অভিমুখ। তাই ভারত কোনোদিন সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির কোলে আশ্রয় নেয়নি। উন্নয়নশীল, অনুন্নত সমস্ত দেশকে জোটবদ্ধ করে এক সঙ্গে সকলে মিলে বিকল্প পথে এগতে চেয়েছিল। তাই উন্নত সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির বৃত্তের বাইরে অবশিষ্ট বিশ্বের মানুষের চোখে ভারতের আসন থেকে ভারতে টেনে নামিয়ে একটা বাহুবলী দেশের ভূমিকায় রূপান্তরিত করার চেষ্টা হচ্ছে। অন্যদের দমিয়ে, দূরে সরিয়ে আপন আধিপত্য ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের ঔদ্ধত্যপূর্ণ অভিযান শুরু হয়েছে। আজ ভিন দেশের মানুষের সম্মান অর্জনের বদলে শক্তির দম্ভে ভয় দেখিয়ে আনুগত্য আদায় অগ্রাধিকার পাচ্ছে। জাতীয় নিরাপত্তার প্রয়োজন ছাড়িয়ে সামরিক শক্তিতে মহাশক্তিধর হতে চাইছে ভারত। আপন আধিপত্য বিস্তার আর দাদাগিরির মনোভাব অপরাপর দেশে কাছে ভারত সম্পর্কে সন্দেহ ও অবিশ্বাস বাড়ছে। ফলে বন্ধুত্বের জমিটা অনুর্বর হয়ে বিরোধ-সংঘাতের চোরাস্রোত বইছে।
কোনও দেশ যদি নিজের শ্রেষ্ঠত্বের অহমিকায় অন্যদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য ও উপেক্ষার মনোভাব দেখায় তাহলে সে দেশ কখনও অন্য দেশের বন্ধু হতে পারে না। তাদের আস্থা, বিশ্বাস অর্জন করতে পারে না। গত দশ বছরে আত্মদম্ভের বিপুল প্রকাশ ঘটেছে ঠিকই কিন্তু আসল বন্ধু কেউ হয়নি। বরং পুরানো বন্ধুর সঙ্গে দূরত্ব বেড়েছে। যে সরকার তার সকল নাগরিকের সার্বিক উন্নয়ন, রুজি রোজগার, জীবনযাত্রার মানের উন্নতিকে পাখির চোখ করে সে সামাজিক ন্যায়কে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়। নাগরিকদের মধ্যে সম্পদ ও আয়ের বৈষম্য সর্বনিম্নস্তরে নামিয়ে আনার চেষ্টা করে। কোনও দেশের মসৃণ অগ্রগতির প্রথম এবং প্রধান শর্ত অভ্যন্তরীণ ঐক্য ও সম্রীরেতি। দেশের মধ্যে ঐক্য ও সংহতি দৃঢ় না হলে কোনও উন্নয়নের কাজ গতি পায় না। তেমনি প্রতিবেশী ও অন্যান্য সকলে দেশের সঙ্গেও বিশ্বাসযোগ্য ও ভরসাযোগ্য সম্পর্ক গড়ে তুলতে। আপন ক্ষুদ্র স্বার্থে বন্ধুত্ব হলে সেখানে বিরাট ফাঁক থাকে।
মানবিক দিকগুলিকে দূরে সরিয়ে ভারত এখন অস্ত্র শক্তিতে শক্তিধর হতে চাইছে। অর্থনীতিতে সর্বাধিক গুরুত্ব পাচ্ছে সমরাস্ত্র উৎপাদন ও যুদ্ধ সংক্রান্ত বিষয়। সৃষ্টির বদলে ধ্বংসের শক্তি বেশি উৎসাহ পাচ্ছে। অন্য ক্ষেত্রে অর্থনীতিকে উন্নত করার বদলে সামরিক শিল্পে জোর দেওয়া হচ্ছে। অস্ত্র রপ্তানি করে অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার চেষ্টা হচ্ছে। সামরিক অর্থনীতি চায় দেশে দেশে, অঞ্চলে অঞ্চলে বিরোধ-সংঘাত বাড়িয়ে যুদ্ধের আবহ তৈরি করতে। যত যুদ্ধের আবহ, নিরাপত্তা ভয়, ততই যুদ্ধাস্ত্রের বাজার বাড়বে। যুদ্ধবাজ সাম্রাজ্যবাদীদের চিরাচরিত কৌশলের ফাঁদে পা দিয়ে ভারতও সামরিক দাদাগিরির পরিধি বাড়াতে চাইছে। ফলে সাধারণ মানুষের প্রয়োজনের পণ্য-পরিষেবা ক্ষেত্রকে উন্নত ও প্রসারিত করার বদলে সামরিক অর্থনীতি সরকারের নীতিতে প্রাধান্য পাচ্ছে। বিপদ এখানেই।
 

Comments :0

Login to leave a comment