Post Editorial Women Reservation

মহিলা সংরক্ষণের সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে অর্থনীতিরও

উত্তর সম্পাদকীয়​

দেবাশিস মিথিয়া

এবছর অর্থনীতিতে নোবেল পেয়েছেন ক্লডিয়া গোল্ডিন। তাঁর অর্থনৈতিক গবেষণার বেশির ভাগটাই কাজের বাজারে মহিলাদের বঞ্চনাকে ঘিরে। যেসময় তাঁর এই কাজ স্বীকৃতি পাচ্ছে ঠিক তখনই বিশ্বে প্রতিদিন ৩ জন মহিলার মধ্যে ১ জন হিংস্রতার শিকার। প্রতি ৫ জনে ১ জন ধর্ষিত হন। বছরে পাচার হয়ে যায় প্রায় ১১৫০০ মহিলা।  আধুনিক  বিশ্বে এখনও ৯০ কোটি মহিলা লিখতে পড়তে জানেন না। এঁদেরই একটা অংশ প্রতিদিন বাড়ি কিংবা কাজের জায়গায় পুরুষের দ্বারা লাঞ্ছিত হচ্ছেন। বিশ্বের মোট আয়ের মাত্র ১০ % মহিলাদের হাতে। এরকম পরিস্থিতিতে, সারা বিশ্বের সংসদগুলিতে মহিলা সদস্যের অনুপাত মোট সদস্যের  মাত্র ২৬.৭%। অর্থাৎ আইন প্রণয়নকারীদের মধ্যে মহিলাদের সংখ্যা নেহাতই নগণ্য।  অথচ, বিশ্বের মোট জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশি মহিলা।  মহিলাদের রাজনীতি বিমুখ করে রাখার অর্থ, কোনও দেশের অর্ধেক শক্তিকে দেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করার অধিকার থেকে দূরে রাখা।
ভারতীয় সংসদে ‘নারী শক্তি বন্দন অধিনিয়ম’ শিরোনামে মহিলা সংরক্ষণ বিল পাশ হয়েছে। এর ফলে, কেন্দ্র ও রাজ্যস্তরের আইনসভাগুলিতে  এক তৃতীয়াংশ আসন মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত থাকবে। বেশিরভাগ সময় ‘সংরক্ষণ’- এর ভুল ব্যাখ্যা করা হয়। সংরক্ষণ নাকি অযোগ্যদের পিছনের দরজা দিয়ে সুযোগ পাইয়ে দেওয়ার উপায়। কিন্তু একটু যুক্তি দিয়ে ভাবলে দেখা যাবে সমাজের পিছিয়ে পড়া, বঞ্চিত,  অবহেলিতদের বাড়তি যত্ন ও গুরুত্ব দিয়ে  মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনতে বা সামনের সারিতে এগিয়ে দিতে সংরক্ষণ জরুরি। মহিলাদের রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের জন্য এই বিলের ঐতিহাসিক তাৎপর্য আছে সন্দেহ নেই, কিন্তু বিলটি অনিশ্চিত বাস্তবায়নের মুখোমুখি। এটির বাস্তবায়নের সময়সীমা আপাতত ২০২৯ সাল। কিন্তু কেন এই বিলম্ব? কারণ সংসদে একে আইনে পরিণত করতে হলে অর্ধেক সংখ্যক রাজ্যের বিধানসভায় অনুমোদন পেতে হবে। আর রাজ্য আইনসভায় কার্যকর হতে হলে সমস্ত রাজ্যেই এর অনুমোদন প্রয়োজন। এখানেই শেষ নয়। আইন কার্যকর করে লাগু করতে হলে জনগণনার কাজ শেষ হওয়া জরুরি। তার ভিত্তিতে লোকসভা, বিধানসভার আসন ডিলিমিটেশন হবে। সেই আসনের  ৩৩ % মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত থাকবে। ডিলিমিটেশন হলো নির্বাচনী এলাকার  সীমানা নির্ধারণ। এর মাধ্যমে জনপ্রতিনিধিদের এলাকা এবং জনসংখ্যার সুষমবণ্টন সুনিশ্চিত করা হয়। কিন্তু আমাদের দেশে আগামী জনগণনা হওয়ার কথা ২০৩১-এ। সেটা যদি স্বাভাবিক সময়ে শেষ হয়, তাহলেও ২০৩৪ লোকসভা নির্বাচনের আগে কিছুতেই আসন সংরক্ষণ সম্ভব নয়।
প্রশ্ন উঠছে মহিলা সংরক্ষণ বিল পাশ কেন লোকসভা নির্বাচনের মুখে? ২০১৪ সালে বিজেপি নির্বাচনে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল ক্ষমতায় এলে মহিলা সংরক্ষণ বিল চালু করবে। কিন্তু বিগত ৯ বছরে তা নিয়ে সংসদে একবারও রা কাড়েনি। গবেষণায় দেখা গেছে যে মহিলাদের ভোট দানের প্রবণতা পুরুষদের থেকে আলাদা। পুরুষেরা রাজনৈতিক স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে বেশি পছন্দ করলেও মহিলারা পরিবর্তনের পক্ষেই রায় দেন। যেহেতু দেশের মোট ভোটারের ৫০ শতাংশ মহিলা। তাদের ঠেকাতে না পারলে,  বিজেপি’র সরকার টিকিয়ে রাখা কষ্টকর হবে। বিশেষজ্ঞ মহলের ধারণা মহিলাদের  মন পেতেই এই বিল পাশ।  তবে, এই বিল কার্যকর হলে, মহিলাদের  ক্ষমতায়নে তা যে অনেকখানি সাহায্য করবে  এটা জোর দিয়ে বলাই যায়।
মহিলাদের ক্ষমতায়নে যেটা সবচেয়ে জরুরি তা হলো,  নারী ও পুরুষের সমান অধিকার।  অথচ, লিঙ্গ বৈষম্য ভারতের গ্রাম-শহর সর্বত্র। ভারত বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের দেশ হয়েও স্বাধীনতার পর মাত্র একজন মহিলা প্রধানমন্ত্রী পেয়েছে, মহিলা রাষ্ট্রপতি মাত্র ২ জন। আইনসভায় মহিলা প্রতিনিধির অনুপাত উচ্চ কক্ষে  ১৪.০৫% এবং নিম্ন কক্ষে ১৪.৯৪%। বিধানসভাগুলিতে মহিলা প্রতিনিধির সংখ্যা আরও হতাশাজনক। এর ফলে আইনসভাগুলিতে লিঙ্গ সমতার ভিত্তিতে যে বিশ্ব তালিকা তৈরি হয়েছে, ভারতের নাম তার তলার দিকে। ওয়ার্ল্ড ইকনমিক ফোরামের সাম্প্রতিক ‘গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপের’ রিপোর্টে পাওয়া যাচ্ছে, বিশ্বে ১৪৬ টি দেশের মধ্যে ভারত  ১২৭ তম স্থানে রয়েছে।

এই লিঙ্গ বৈষম্য অর্থনীতিকে দারুণভাবে প্রভাবিত করে। ২০১২ সালে বিশ্ব ব্যাঙ্ক “জেন্ডার ইকুয়ালিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট” নামক বিশ্ব উন্নয়ন সংক্রান্ত প্রতিবেদনে স্পষ্ট করে বলেছে— অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং নীতিনির্ধারণের জন্য, লিঙ্গ বৈষম্য দূর করা জরুরি। কারণ এটি সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের একটা অংশ। লিঙ্গ সমতা অর্থনৈতিক উৎপাদনশীলতাকে বহুগুণ বাড়ায়। বিশ্বের মোট শ্রমশক্তির ৪০% মহিলা। তাদের দক্ষতা এবং প্রতিভাকে পুরোপুরি ব্যবহার  করতে পারলে সামগ্রিক উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে।  রাষ্ট্রসঙ্ঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, মহিলারা যদি জমি এবং সারের  মতো উৎপাদনশীল উপাদান নিয়ন্ত্রণে পুরুষের সমান সুযোগ সুবিধা পায়, তাহলে উন্নয়নশীল দেশগুলিতে কৃষি উৎপাদন ২.৫% থেকে ৪% পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে। এছাড়াও নির্দিষ্ট কিছু পেশায় মহিলাদের কাজের অসুবিধাগুলি দূর করতে পারলে তাঁদের দিয়ে উৎপাদন ২৫% পর্যন্ত বাড়ানো যেতে পারে— যা গবেষণায় প্রমাণিত। বিশ্ব ব্যাঙ্কের রিপোর্ট বলছে  ব্রাজিল, চীন, ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা এবং যুক্তরাজ্যের মতো দেশে পারিবারিক আয়ের বেশি অংশ যদি মহিলারা নিয়ন্ত্রণ করেন তাহলে তাঁরা শিশুর খাদ্য ও শিক্ষার উপর ব্যয় করেন বেশি। এতে অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার ত্বরান্বিত হয়। এছাড়া, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সামাজিক ক্ষেত্রে নারীর  ক্ষমতায়ন  সরকারি নীতির অভিমুখ বদলে দিতে পারে।  মহিলারা মূলত যে সমস্ত সুযোগ সুবিধার দাবিতে সোচ্চার হন, সরকারি  প্রতিষ্ঠানগুলি সেই সব সুবিধা মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে উদ্যোগী হয়। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, ভারতের আঞ্চলিক স্তরে মহিলাদের হাতে ক্ষমতা আসার পরে পানীয় জল ও নিকাশি ব্যবস্থার মতো সরকারি দ্রব্য বেশি বেশি করে মানুষের কাছে পৌঁছাচ্ছে  কারণ মেয়েদের কাছে এগুলির গুরুত্ব তুলনামূলকভাবে বেশি।

পঞ্চায়েত ও পৌরসভাতে মহিলাদের জন্য আসন সংরক্ষণ আজ তিন দশকে পা দিল।  এই সংরক্ষণের হাত ধরে, ক্ষমতার নিম্ন স্তরে মহিলারা  যেমন নিজেদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছেন তেমনই পঞ্চায়েতের কাজে  শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ দিয়েছেন। ছত্তিশগড়ের রিসামা পঞ্চায়েতের প্রধান গীতা মহানন্দ বলছেন, “পঞ্চায়েতে  মহিলাদের জন্য  সংরক্ষণ না থাকলে তিনি কখনও গ্রামীণ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে এগিয়ে আসতেন না, রাজনীতিতেও নাম লেখাতেন না।  সংরক্ষণ শুধু স্বাধীন সিদ্ধান্ত  নেওয়ার ক্ষমতাই দেয়নি বরং সমাজের মঙ্গলে বাড়তি কিছু করার  আত্মবিশ্বাস জুগিয়েছে”।  পাশাপাশি, অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের রিপোর্ট বলছে— “স্থানীয় স্তরের সভাগুলিতে মহিলাদের উপস্থিতি এখন প্রায় ৪৪%। এটি একটি উল্লেখযোগ্য রেকর্ড । মহিলাদের রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের এর চেয়ে ভালো উদাহরণ আর কী হতে পারে! এর নিরিখে বিচার করলে ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, জার্মানি এবং জাপানের মতো বিশ্বের  শীর্ষস্থানীয় দেশগুলিকে পিছনে ফেলেছে ভারত। মহিলা নেতৃত্বাধীন পঞ্চায়েতের উপর গবেষণার ফল বলছে নীতি প্রণয়ন, কর্মসূচি রুপায়ণ এবং অর্থ বরাদ্দের ক্ষেত্রে সংরক্ষণের ইতিবাচক প্রভাব রয়েছে। নারীর রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব শুধু যে তাদের উপর সামাজিক এবং পারিবারিক নিপীড়ন নিয়ন্ত্রণ করেছে তাই নয়, আঞ্চলিক স্তরে অর্থনৈতিক কাঠামোতেও বদল এনেছে। শ্রমের বাজারে নারী-পুরুষ মজুরি হারের  বৈষম্য অনেকাংশে কমেছে এবং পরিচালন পদ্ধতিতে নারীদের নেতৃত্ব দিতে দেখা যাচ্ছে।

‘মহিলা সংরক্ষণ’ বিল  আইনে পরিণত হলে জাতীয় নীতি নির্ধারণে মহিলাদের রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব বাড়বে। সংসদে মহিলাদের নিজস্ব দাবি দাওয়া জোরদার হবে।  আজও দেশের ৬২% মহিলা স্কুল শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত যেখানে পুরুষদের ক্ষেত্রে এই অনুপাত মেয়েদের অর্ধেক। তাই শিক্ষা ক্ষেত্রে লিঙ্গ বৈষম্য দূর করা এই মুহূর্তে দেশের কাছে বড় চ্যালেঞ্জ।  শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে ভারতের বিনিয়োগও কম। মহিলারা নীতি নির্ধারণকারী হলে এই বৈষম্য দূর করতে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে বিনিয়োগ বৃদ্ধি পাবে এবং মেয়েদের জন্য প্রয়োজনীয়  সুযোগ সুবিধা তৈরি হবে। তাদের সামনে নতুন নতুন কাজের দরজা খুলে যাবে। এছাড়া পরিবহণ, পরিশুদ্ধ পানীয় জল ও নিকাশি ব্যবস্থার অভাব- যা মেয়েদের সমস্যায় ফেলে সেগুলিতে আরও বিনিয়োগ বাড়বে। সুতরাং, নতুন আইন তৈরি হলে সামাজিক এবং মানব পরিকাঠামোর উন্নতি ঘটবে তা নিয়ে সন্দেহ নেই।
ভারতীয় আইনসভায় মহিলাদের আসন সংরক্ষিত হলে তাদের সামগ্রিক ক্ষমতাই বাড়বে। রাজনৈতিক নেতৃত্ব তাদের অর্থনৈতিক সক্ষমতা দেবে। ফলে দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সুদৃঢ় হবে।  কিন্তু এই সংরক্ষণ বিল আইনে পরিণত হয়ে কার্যকরী হতে বেশ কিছুদিন লেগে যাবে। এরমধ্যে দেশ একাধিক  নিবার্চনের মুখোমুখি হবে। পরশুরামের ভাষায় 'কে থাকে কে যায়' - সকলেরই অজানা। তাই সংরক্ষণ বিলের পরিণতি একমাত্র সময়ই বলতে পারবে।

Comments :0

Login to leave a comment