Child marriage

হায় ‘কন্যাশ্রী’, পঞ্চায়েত সদস্যার নাবালিকা বৌমা মা হয়েছে!

রাজ্য জেলা

west bengal child marriage kanyasree bengali news ছবি:প্রতিকী

বাকলিয়া ধোবাপাড়া পঞ্চায়েতের নাম। ব্লক বলাগড়। জেলা হুগলী। প্রধান তৃণমূলের। নাম মধুমিতা সমাদ্দার। রবিবার অভিজ্ঞতা জানাতে গিয়ে বললেন,‘‘গত একমাসে আমার কাছেই অন্তত ৩টি ১৫-১৬ বছরের মেয়ে এসেছে। প্রেগন্যান্ট। কী করি বলুন তো? কেউ শুনছে না কথা। যে যেমন খুশি বিয়ে করছে। তারপর গর্ভবতী হয়ে পড়ছে।’’

এই পঞ্চায়েতেই দু’বছর আগে এক পঞ্চায়েত সদস্যার দুই নাবালক ছেলের নাবালিকার সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল। সেই পঞ্চায়েত সদস্যাও তৃণমূলের। তাঁর ছোট ছেলের নাবালিকা স্ত্রীর বাড়ি নদীয়াতে। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা না দিয়ে তিনি পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছিলেন। বিয়ের পরে নাবালিকা অবস্থায় সেই ছোট ছেলের স্ত্রী গর্ভবতীও হয়েছিলেন। তাঁর একটি সন্তানও হয়েছে। আর পঞ্চায়েত সদস্যার বড় ছেলের স্ত্রীরও নাবালিকা অবস্থায় বিয়ে হয়েছিল। তিনি সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছিল।


গ্রামাঞ্চলের এমন ঘটনা অনেক। চিত্র বলছে পশ্চিমবঙ্গ ক্রমশ পিছোচ্ছে। নাবালিকা বিয়েই শুধু নয়, পশ্চিমবঙ্গে কম বয়সে ছেলেদের বিয়েও বেড়েছে। বাড়ছে।
‘মেন অ্যান্ড উওমেন,২০২২’ রিপোর্টও তাই বলছে। কেন্দ্রীয় সরকারের পরিসংখ্যান এবং কর্মসূচি রূপায়ণ মন্ত্রকের ন্যাশনাল স্ট্যাটিসটিক্যাল অফিস দু’বছর অন্তর এই রিপোর্ট প্রকাশ করে। ২০২২-র রিপোর্টই প্রকাশিত হয়েছে চলতি মাসে। সেই রিপোর্টের জন্য তথ্য সরবরাহ করেছে রাজ্য সরকারই। 

রিপোর্টে স্পষ্ট রাজ্যে নাবালিকা বিয়ে কমেনি। বরং দেশের অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় এই প্রশ্নে রাজ্য গত কয়েক বছরে পিছিয়েছে। আঠারো বছর হওয়ার আগে বিবাহিত মহিলার বিচারে পাঁচ বছর আগে পশ্চিমবঙ্গের আগে ছিল বিহার। এখন কেউ নেই। আঠারো বছর হওয়ার আগে বিবাহিত মহিলার বিচারে পশ্চিমবঙ্গ এখন দেশে সবার আগে। রিপোর্ট জানাচ্ছে, এখন বিবাহিত এমন ২০ থেকে ২৪ বছরের যুবতীদের ৪১.৬%-র বিয়ে হয়েছে ১৮ বছর বয়স হওয়ার আগে। ২০১৫-১৬-তেও এই বিষয়ে হার একই ছিল। উন্নতি কিছুই হয়নি। 

যদিও কেরালার মতো অনেক রাজ্যই এই প্রশ্নে উন্নতি করেছে। কেরালায় এখন এই হার ৬.৩%। যা ২০১৫-১৬-তে ছিল ৭.৬%। পশ্চিমবঙ্গের কাছাকাছি আছে বিহার। সেখানে ৪০.৮% যুবতীর বিয়ে হয়েছে ১৮ বছরের আগে। ২০১৫-১৬-তে সেখানে তা ছিল ৪২.৫%। তবে এই সময়কালে ত্রিপুরায় হাল খারাপ হয়েছে।


স্বাভাবিকভাবেই রাজ্যে নাবালিকা বিয়ের এই আয়নায় তৃণমূল সরকারের কন্যা শ্রী কিংবা রূপশ্রীর মতো কর্মসূচির ফল কী, এই প্রশ্ন উঠছে। কন্যা শ্রীতে ১৮বছর বয়স হলে ছাত্রীদের ২৫ হাজার টাকা করে দেয় সরকার। রূপশ্রী সাবালিকার বিয়ের আর্থিক সহায়তার প্রকল্প। এই দুটি প্রকল্প নিয়েই মমতা ব্যানার্জি তাঁর সাফল্য বারবার দাবি করেন। কিন্তু তথ্য অন্য কথাই বলছে।

এই প্রশ্নে তাৎপর্যপূর্ণ কথা বলেছেন রাজ্যের সমাজকল্যাণ দপ্তরের এক আধিকারিক। তিনি মহিলা। তাঁর কথায়,‘‘যদি কন্যাশ্রী প্রকল্পের গতিপ্রকৃতি খেয়াল করেন, দেখবেন এই প্রকল্পে ফ্রেশ, অর্থাৎ নতুন ছাত্রীদের অন্তর্ভুক্তি কমছে। অর্থাৎ পড়াশোনা ছাড়ছে ছাত্রীদের একটি অংশ। তাঁরা বিয়ে করে নিচ্ছে বাড়ির চাপে। অথবা নিজেদের ইচ্ছেয়। কারণ, তাঁর সামনে আর কিছু করার সুযোগ নেই।’’


এই সময়কালে রাজ্যে ২১ বছরের কম বয়সি পুরুষদের বিয়ের প্রবণতাও বেড়েছে। রিপোর্ট জানাচ্ছে, রাজ্যের ২৫ থেকে ২৮ বছর বয়সি যুবকদের ২০%-র বিয়ে হয়েছে ২১ বছর বয়স হওয়ার আগে। ২০১৫-১৬-তে তা ছিল ১৭.৩%। অর্থাৎ প্রবণতা বেড়েছে। মদ্য প্রদেশ, ঝাড়খণ্ড, গুজরাট, উত্তর প্রদেশের মতো রাজ্যগুলিতে এই প্রবণতা দীর্ঘদিন ধরেই বেশি। মূলত এই রাজ্যগুলির গ্রামাঞ্চলে অল্প বয়সে বাড়ির ছেলেদের বিয়ে দিয়ে দেওয়ার একটি ধারা আছে। 

কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে তা এতটা প্রকট ছিল না। ইদানীং তা বেড়েছে। এই প্রসঙ্গে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের এক অধ্যাপিকার কথায়,‘‘রাজ্যে ছাত্রদের মধ্যে পড়াশোনা ছেড়ে দেওয়ার প্রবণতা গত বেশ কয়েক বছর ধরেই বাড়ছে। নাবালক অবস্থাতেই এদের অনেকে কাজের খোঁজে ভিন রাজ্যে যাচ্ছেন। সেখানে কিছু উপার্জনও করছেন। এই স্কুলছুট, ভিন রাজ্যে কাজে যুক্ত হয়ে পড়া অনেকেই বিয়ে করে ফেলছেন। স্ত্রীকে নিয়ে চলে যাচ্ছেন ভিন রাজ্যে কাজের জায়গায়।’’

সব মিলিয়ে নারী এবং পুরুষ— দুজনেরই ক্ষতি হচ্ছে। সামগ্রিকভাবে সমাজ পিছোচ্ছে।


কিন্তু এই প্রশ্নে হস্তক্ষেপ করার জন্য পঞ্চায়েতের একটি কমিটি থাকে। নাম — গ্রাম, স্বাস্থ্য ও পুষ্টি বিষয়ক কমিটি। সেই কমিটিতে পঞ্চায়েতের সদস্যরা থাকেন। প্রতি মাসের চতুর্থ রবিবার পঞ্চায়েতের বৈঠকে প্রধান এবং অন্য সদস্যরা, কর্মচারী, স্বাস্থ্যকর্মীরা, অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের থাকার কথা। সেখানে এলাকা ধরে ধরে বিয়ের সংখ্যা, সন্তানের জন্ম, টিকা প্রভৃতি বিষয়ে আলোচনা হওয়ার কথা। কিন্তু দখল করে জেতা পঞ্চায়েতে এই সব কাজ অনেকদিনই বন্ধ মমতা-শাসনে।

রাজ্যে গত পাঁচ বছরে মহিলাদের রক্তাল্পতা বেড়েছে। পাঁচ বছর আগে মহিলাদের রক্তাল্পতায় পশ্চিমবঙ্গের পিছনে ছিল ৫টি রাজ্য, কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল। এখন পশ্চিমবঙ্গ শীর্ষে। অপুষ্টি এর প্রধান কারণ। 


পশ্চিমবঙ্গের ১৫ থেকে ৪৯ বছরের মহিলাদের ৭১%-র বেশি রক্তাল্পতায় ভোগেন। পাঁচ বছর আগে তা ছিল ৬২.৫%। এখন জাতীয় গড় ৫৭%। পশ্চিমবঙ্গ জাতীয় গড়ের অনেক পিছনেই আছে। রক্তাল্পতায় ভোগা মহিলাদের শতাংশের বিচারে পশ্চিমবঙ্গ দেশে দ্বিতীয়। প্রথম লাদাখ।

পশ্চিমবঙ্গে মহিলাদের মাসে মাসে এক হাজার টাকা করে দেওয়ার প্রকল্প চালু করেছেন মমতা ব্যানার্জি। নাম ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার।’ কিন্তু টাকা দেওয়াই সার। তাও সবাই পাচ্ছেন না। তার চেয়েও বড় কথা জনস্বাস্থ্য পুরোপুরি ব্রাত্য হয়েছে রাজ্যে। তার ফলাফল দেখা যাচ্ছে নারীদের রক্তাল্পতা বৃদ্ধিতেও।
 

Comments :0

Login to leave a comment