corporate control economy

কর্পোরেট নির্ভর অর্থনীতি বদলাতে হবে

সম্পাদকীয় বিভাগ

ভারতের অর্থনীতি বিশ্বের যেকোন দেশের থেকে বেশি হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে সাম্প্রতিককালে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে বিজেপি-র নেতা-মন্ত্রীরা দেশজুড়ে শোরগোল তুলেছেন। বিশেষ করে নির্বাচনের প্রচারে বিজেপি দেশবাসীর কাছে এমন ধারণা বদ্ধমূল করার চেষ্টা চালাচ্ছে যে মোদীর নেতৃত্বে ভারতের অর্থনীতি সবদেশকে পেছনে ফেলে দ্রুত গতিতে ছুটছে। অর্থাৎ মোদীর হাতেই ভারতের অর্থনীতির সুদিন ফিরেছে। সংখ্যার কারিকুরিতে সাফল্যকে অতিমাত্রায় ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দেখানোয় মোদীদের জুড়ি মেলা ভার। ভিত্তি বর্ষ বদল করে এবং গণনা পদ্ধতি বদল করে মোদীরা বৃদ্ধির যে হার হাজির করে মানুষকে বোকা বানানোর চেষ্টা করছেন তাতে আস্থা ও ভরসা রাখতে পারছেন না অনেক আন্তর্জাতিক খ্যাত অর্থনীতিবিদরা। তাছাড়া জিডিপি-র সঙ্গে মূল্য বৃদ্ধিকে যুক্ত করে গণনা না করলে প্রকৃত সত্য আড়ালে চলে যায়। এবছর নমিনাল জিডিপি (চলতি মূল্যে) বৃদ্ধির হার ৯.১ শতাংশ। পাশাপাশি মূল্যবৃদ্ধির হার ৬ শতাংশ। মূল্যবৃদ্ধিকে বাদ দিয়ে যদি প্রকৃত বৃদ্ধি ঠিক করা হয় তাহলে সেটা হবে ৩ শতাংশ। অর্থাৎ সত্যিকারের বৃদ্ধির হার ৩ শতাংশ। মূল্যবৃদ্ধিকে হিসাবের বাইরে রেখে এক রকম প্রতারণা করে মোদীরা দেখাতে চাইছেন অর্থনীতি দারুণ চাঙ্গা। এমন মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর তথ্য হাজির করেই তারা ৫ট্রিলিয়ন ডলার অর্থনীতির খোশ গল্প শোনাচ্ছেন। দু’তিন বছরের মধ্যেই বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি হবার স্বপ্ন ফেরি করছেন। এখন ২০৪৭ সালে উন্নত অর্থনীতির (আমেরিকা, ব্রিটেনের মতো) খোয়ার দেখাচ্ছেন।
অর্থনীতি যদি সত্যি দ্রুত বর্ধমান হয়ে থাকে তাহলে তার ছাপ তো দেশের নাগরিকদের জীবন জীবিকায় প্রতিফলিত হবে। নতুন কর্মসংস্থান হবে, বেকার যুবকরা কাজ পাবে, বেকারির হার কমে যাবে। মানুষের আয় বাড়বে ও ক্রয়ক্ষমতা বাড়বে। দারিদ্র্য কমে যাবে। মানুষের জীবনে স্বচ্ছলতা আসবে। সর্বোপরি ভারতীয় সমাজে আয় ও সম্পদ বৈষম্য কমবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে কর্মসংস্থান নেই, বেকারির রেকর্ড তৈরি হয়েছে। নিয়ন্ত্রণহীন উচ্চ মূল্যবৃদ্ধির জেরে মানুষের প্রকৃত আয় ও ক্রয়ক্ষমতা হয় থমকে গেছে অথবা কমে গেছে। জীবন জীবিকার সঙ্কট তীব্র থেকে তীব্রতর হয়েছে। সবচেয়ে যেটা উদ্বেগের সেটা হলো দেশে আয় ও সম্পদের অতি কেন্দ্রীভবন তীব্রতর হয়েছে। এক শতাংশ মানুষের হাতে কেন্দ্রীভূত হয়েছে দেশের মোট সম্পদের ৪০ শতাংশ। অন্যদিকে নিচের ৫০ শতাংশ মানুষের হাতে আছে মাত্র ৩ শতাংশ সম্পদ। মোদী জমানায় শুধু বিলিওনিয়ারের সংখ্যা বাড়ছে। সরকারের নীতি এমনভাবে সাজানো হয়েছে যাতে দেশের যাবতীয় সম্পদ মুষ্টিমেয় মানুষের হাতে চলে যায়।
মেক ইন ইন্ডিয়ার ফাঁকা আওয়াজ হয়েছে ঠিকই কিন্তু শিল্প গড়ে ওঠেনি। উলটে রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পগুলি ধাপে ধাপে বেসরকারি মালিকানায় স্থানান্তরিত। স্কিল ইন্ডিয়ার নামে দক্ষ শ্রমিক গড়ার কথা হয়েছে। কিন্তু কাজের সুযোগ তৈরি হয়নি। কর্পোরেট মালিকদের স্বার্থকে ঘিরেই সরকার সেই ২০১৪ সাল থেকে পা ফেলছে। তাদের জন্য এপর্যন্ত সাড়ে সতেরো লক্ষ কোটি টাকার ব্যাঙ্ক ঋণ মকুব হয়েছে। কর্পোরেট কর কমিয়ে ফেলা হয়েছে অনেকটাই। এছাড়া নানাভাবে বিস্তর ছাড় ও সুবিধাদান তো আছেই। রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বেসরকারি হাতে তুলে দেবার পাশাপাশি এতদিন পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে যত পরিকাঠামো নির্মাণ হয়েছে সেগুলিকে ন্যাশনাল মানিটাইজেশন পাইপলাইন প্রকল্পে বেসরকারি হাতে তুলে দেবার ব্যবস্থা হয়েছে। অর্থাৎ বেসরকারি সংস্থা কোনও বিনিয়োগ না করেই যথেচ্ছ হারে মুনাফা ঘরে তুলবে। একইভাবে জল, জমি, বন থেকে শুরু করে সমস্ত জাতীয় সম্পদ তুলে দেওয়া হচ্ছে কর্পোরেটের হাতে। রাষ্ট্রকে একেবারে নিঃস্ব করে ফেলার ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। খনিজ সম্পদের দখল নিতে আদিবাসীদের উৎখাত করে পাহাড় বনাঞ্চল যাচ্ছে কর্পোরেটের হাতে। শ্রম আইন সংশোধন করে শ্রমিকের অধিকার ছাঁটাই এবং অতিমাত্রায় শোষণের বন্দোবস্ত করা হয়েছে। কৃষিকেও কর্পোরেট মুনাফার একচেটিয়া অধিকারে আনার চেষ্টা চলছে। কৃষক আন্দোলন সেটা খানিকটা ঠেকানোর চেষ্টা করলেও তাদের ওপর নামানো হচ্ছে ভয়ঙ্কর আক্রমণ।
এইভাবে দেশের যাবতীয় সম্পদ যেমন তুলে দেওয়া হচ্ছে তেমনি শ্রমিক শোষণের মাত্রা বাড়িয়ে অতিমাত্রায় মুনাফার বন্দোবস্ত হয়েছে। এই নীতির জেরে কৃষক-খেতমজুররাও বিপন্ন। ১৪০ কোটি মানুষের দেশ ভারতের অর্থনীতি রাষ্ট্রের এক্তিয়ার থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে কর্পোরেটের হাতে। নাগরিক স্বার্থে স্বনির্ভর অর্থনীতির ভিত্তিটাই উপড়ে ফেলা হচ্ছে। এইভাবেই ভারত হয়ে উঠছে বিশ্বের সবচেয়ে বৈষম্যের দেশ।
 

Comments :0

Login to leave a comment