Post Editorial

বিজ্ঞানের পথে আর একবার: ডারউইন-২০০

উত্তর সম্পাদকীয়​

Post Editorial


তপন মিশ্র


এক অভিনব পরিকল্পনা নিয়েছেন কয়েকজন ইংরেজ বিজ্ঞানী এবং প্রকৃতি সংরক্ষণে উদ্যোগী মানুষ। উদ্যোগের নাম ডারউইন-২০০ এবং এদের মূল স্লোগান ‘ চেঞ্জ দি ওয়ার্ল্ড’। প্রায় ১৯০ বছর আগে এচএমএস বিগল নিয়ে যে সমুদ্রপথে ডারউইন ৫ বছর ধরে পরিক্রমা এবং পর্যবেক্ষণ করেছিলেন সেই একই পথে ডারউইনের পদাঙ্ক অনুসরণ করবে এই দল। ডারউইনের দেখা যা কিছু তা আর একবার পর্যবেক্ষণ করবেন ওঁরা। উদ্দেশ্য ডারউইনের কাজের সত্যাসত্য যাচাই করা নয়, আধুনিক প্রজন্মের কাছে ডারউইনের যুগান্তকারী কাজের গুরুত্ব তুলে ধরা এবং এই প্রজন্মের মধ্যে অভিব্যক্তিবাদ সম্পর্কে সঠিক তথ্য তুলে ধরা। যাচাই কাজ অনেক আগেই সমাধা হয়েছে। একদিকে যেমন মৌলবাদীদের অভিব্যক্তিবাদের উপর আরও আক্রমণ শাণিত হচ্ছে তেমনই অন্যদিকে প্রাকৃতিক সম্পদ যথেচ্ছ আহরণের জন্য  কর্পোরেটদের মধ্যে প্রতিযোগিতা চলছে। এই দুইয়ের মেলবন্ধন বেশ কিছু দেশে প্রকট। তাই সংরক্ষণের পক্ষে বিশ্বজুড়ে জনমত গড়ে তোলার কাজ এখন জরুরি এবং সঙ্গে জরুরি হল পর্যবেক্ষণের সাহায্যে আধুনিক প্রজন্মের মধ্যে যুক্তিবাদ ও অনুসন্ধিৎসু মনের বিকাশ ঘটানো। এক অভিনব শ্রেণি কক্ষের ব্যবস্থা করেছেন উদ্যোক্তারা যেখানে প্রকৃতি পাঠ থেকে শুরু করে, শ্রেণি কক্ষের পঠন পাঠন এবং বিজ্ঞানাগারে পরীক্ষা নিরীক্ষা সবটাই সম্ভব হবে। সামগ্রিক চিন্তার বিকাশ ব্যতিরেকে কোনও শিক্ষাই সম্পূর্ণ নয়। 
টিম ডারউইন-২০০ 
এই সফরে সংগঠকরা ছাড়া থাকছে ২০০ জন শিক্ষানবীশ। এদের বয়স ১৮ থেকে ২৫-এর মধ্যে। এরা প্রায় ২০০ টি দেশ থেকে ব্যক্তিগত আবেদনের ভিত্তিতে নির্বাচিত হয়েছে। এদের প্রত্যেকের মধ্যে প্রকৃতি সংরক্ষণ সম্পর্কে কিছু না কিছু উদ্ভাবনী চিন্তার পরিচয় পেয়েছেন সংগঠকরা। দু’বছর ধরে এরা সমুদ্রযাত্রা করবেন ডারউইনের পাড়ি দেওয়া পথে। দু’বছরের পর এরা প্রত্যেকেই হবেন এক একজন ‘ডারউইন লিডার’ অর্থাৎ আরও অনেক স্বেচ্ছাসেবী তৈরি করবেন এরা। এই পথে ডারউইন লিডাররা যেমন অনেক তথ্য সংগ্রহ করবে তেমনই সেগুলির উপর বিভিন্ন বাস্তুতান্ত্রিক সমীক্ষা যেমন তাদের আবাসস্থলের বর্তমান অবস্থা, আনুমানিক সংখ্যা, তাদের কঞ্জারভেশন স্ট্যাটাস ইত্যদি সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ চলবে। সংগঠকদের আশা ডারউইন লিডাররা যে যার দেশে ফিরে গিয়ে প্রকৃতি সংরক্ষণের কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করবে। যেমন একজন মাদাগাস্কারের হেরিজো রান্দ্রিয়ানাদ্রাসানা। সে ক্রান্তীয় অরণ্য বাস্তুতন্ত্রের গবেষক এবং এই অঞ্চলের বনবাসী দরিদ্র মানুষের সংরক্ষণের কাজে যুক্ত করার আন্দোলনের সংগঠক।  
কেমন করে বাছাই হয়েছে ডারউইন লিডারদের? যেমন ধরা যাক কেম্যান 
প্রস্তুতি পর্ব 
ওস্টারশেল্ড জাহাজটি ১৯১৭ সালে তৎকালীন হল্যান্ডে তৈরি হয় এবং লাগাতার ভাবে এপর্যন্ত ৫৫টি সমুদ্র যাত্রায় অংশগ্রহণ করেছে। এগুলির প্রত্যেকটাই ছিল দুঃসাহসিক এবং ঝুঁকিপূর্ণ অভিযান। এর মধ্যে দক্ষিণ মেরু যাত্রাও শামিল আছে। এর মধ্যে রয়েছে একটি উন্নত মানের জীব বিজ্ঞানের গবেষণাগার এবং বাইরের বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ করার মত উন্নত ব্যবস্থা। এই অর্থে বিশাল এই জাহাজটি দুঃসাহসিক অভিযান, আবিষ্কার এবং নতুন চিন্তার প্রতীক। 
হ্যারি বেকার নামে ‘লাইভ সায়েন্সেস’-এর একজন ইংরেজ স্টাফ লেখক এই উদ্যোগের মূল সংগঠক। তিনি একজন মেরিন বায়োলজির গবেষকও বটে। তাঁর ‘মেরিন ম্যাডনেস’ নামে একটি ব্লগও আছে। অনেক সমুদ্র-জীববিজ্ঞানী এই ব্লগে লেখেন। বিবর্তন, জলবায়ু পরিবর্তন, পরিবেশ সংরক্ষণ এবং বিভিন্ন ধরনের ফসিল সম্পর্কিত তথ্য সংগ্রহের কাজে তাঁর সংস্থাটি যুক্ত। অভিযানের সঙ্গে থেকে সমগ্র প্রকল্পের নেতৃত্ব দিচ্ছেন স্টিওয়ার্ট ম্যাক ফেরসন, যিনি প্রায় ৩৫টি প্রজাতির আবিষ্কর্তা। তা ছাড়াও তিনি বেশ কিছু বইয়ের লেখক এবং প্রতিনিয়ত গবেষণার সঙ্গে যুক্ত। বিশ্বজুড়ে যে সমস্ত পৃষ্ঠপোষক এই অভিযানের সঙ্গে যুক্ত তাঁদের মধ্যে রয়েছেন চার্লস ডারউইনের প্র-প্রপৌত্রী ড. সারা ডারউইন। পৃষ্ঠপোষকদের তালিকায় আরও রয়েছেন ড. জেন গুডল, যিনি ১৯৬০ সালে ইথিওপিয়ায় শিম্পাঞ্জিদের উপর গবেষণার সঙ্গে যুক্ত এবং তিনি প্রথম বলেন যে শিম্পাঞ্জিরা আদিম মানুষদের মত বেশ কিছু টুল বা অস্ত্র ব্যবহার করে। তাঁর এই গবেষণা মানব বিবর্তনে এক গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন।       
চেনা পথে অনুসন্ধান    
ডারউইন-২০০ নামে এই অভিযানটি গত ১৫ আগস্ট শুরু হয়েছে ইংল্যান্ডের ঐতিহাসিক প্লাইমাউথ বন্দর থেকে। এখান থেকেই ডারউইন পাড়ি দেন। দলটি ৪৬,০০০ মাইল (৭৪,০০০ কিলোমিটার)-এরও বেশি পথ পাড়ি দেবে এবং চারটি মহাদেশের ৩২ টি বিভিন্ন বন্দরে নোঙর ফেলবে। যাত্রা শেষে এরা আবার ফিরে আসবে ইংল্যান্ডের ফ্যালমাউথ বন্দরে। এখানেই এচএমএস বিগল যাত্রা শেষ করে। এই দুই বন্দরের দূরত্ব প্রায় ১০০ কিলোমিটার। শুধু এখানেই এদের যাত্রা শেষ হবে না বরং তাদের যাত্রা সময়ে যে সমস্ত বৈজ্ঞানিক তথ্য সংগৃহীত হবে ভবিষ্যতের পরিবেশবিদদের প্রশিক্ষণের জন্য তা ব্যবহৃত হবে যাতে অন্যদের মধ্যে প্রকৃতি সংরক্ষণের ইচ্ছা তৈরি হয়।
অভিযানের পথ এইচএমএস বিগলে ডারউইনের মূল সমুদ্রযাত্রা পথকে পুরোপুরি অনুসরণ করবে। পাঠকদের মনে করিয়ে দেওয়া যেতে পারে যে ডারউইনের যাত্রা শুরু হয়েছিল ২৭ ডিসেম্বর, ১৮৩১ সালে প্লাইমাউথ বন্দর থেকে এবং ২ অক্টোবর, ১৮৩৬ সালে ফ্যালমাউথ বন্দরে তাঁর জাহাজ ফিরে আসে। সেই পথ ধরে পরিক্রমা করলেও এখন আধুনিক প্রযুক্তি এবং পর্যবেক্ষণের নতুন পদ্ধতি আবিষ্কৃত হওয়ার ফলে অনেক কম সময়ে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবে ওস্টারশেল্ডের গবেষকরা। ডারউইন যখন পাড়ি দিতে শুরু করেন তখন তার বয়স ছিল মাত্র ২২ বছর। সেই বয়সে তাঁর পরিবারের ইচ্ছামত তাঁর চার্চে যোগ দেওয়ার কথা ছিল। তার আগে তিনি পৃথিবী দেখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ভ্রমণের সময়ে ডারউইন প্রকৃতির মধ্যে বিভিন্ন ধরনের প্রজাতি সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করতে করতে এতোটাই প্রভাবিত হয়েছিলেন যে ভগবানের সৃষ্টিতত্ত্বের পরিবর্তে তিনি প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্বের আবিষ্কার করলেন।

‘মিলার-উরে: বস্তু থেকে জীবন’-এর পরীক্ষা

বস্তু থেকেই জীবনের সৃষ্টি। এই ধারণাকে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার মাধ্যমে যারা প্রতিষ্ঠিত করেন তাঁরা হলেন চিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টানলে মিলার এবং হারল্ড মুরে।  ১৯৫২ সালে এই দুই বিজ্ঞানী আদিম পৃথিবীর প্রাক-জৈব যুগের বায়ুমণ্ডল গবেষণাগারে তৈরি করে কী করে জল, মিথেন, অ্যামোনিয়া এবং হাইড্রোজেনকে বিদ্যুৎ শক্তি প্রয়োগ করে জীবনের মৌলিক অণু বা জীবনের বিল্ডিং ব্লক, অ্যামিনো আসিড তৈরি করার উদ্যোগ নেন। এর আগে সোভিয়েত বিজ্ঞানী অ্যালেক্সান্ডার ওপারিন এবং ব্রিটিশ বিজ্ঞানী জেবিএস হল্ডেন আদিম পৃথিবীর পরিবেশ এবং সেখান থেকে জীবনের উৎস সম্পর্কে একটি তত্ত্ব খাড়া করেন। দুজনেই ছিলেন বামপন্থার প্রচারক। তাঁদের তত্ত্বের পরীক্ষামূলক প্রয়োগ করেছিলেন মিলার এবং উরে।        
বিশ্বজুড়ে এই অভিযানের শেষ কয়েক মাসে উক্ত মিলার-উরে পরীক্ষা চালানো হবে। উপরে উল্লেখিত উপাদান অর্থাৎ যৌগের স্যুপ থেকে অ্যামিনো অ্যাসিড (জীবনের বিল্ডিং ব্লক) তৈরি করতে আদিম পৃথিবীর পরিবেশের প্রতিলিপি তৈরি করে এই পরীক্ষা হবে। এই পরীক্ষার ফল ২০২৬ সালে লন্ডনে সমাপনী এবং শংসাপত্র অনুষ্ঠানে পৃথিবীতে জীবনের বিবর্তনীয় উৎস অন্বেষণের একটি বিশেষ বক্তৃতার সময়ে ফলাফলগুলি সার্বজনীনভাবে প্রকাশ করা হবে।
এই দুঃসময়ে অভিব্যক্তিবাদ এবং প্রকৃতি সংরক্ষণের চেতনা বিকশিত করা অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। মৌলবাদী শক্তি কর্পোরেটদের সঙ্গে মিলে মিশে পুঁজিবাদী শোষণ ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার জন্য মরণ কামড় দিচ্ছে। তার বিরুদ্ধে লড়াই করার সৈনিক তৈরি করছে ডারউইন-২০০।  

 

Comments :0

Login to leave a comment