নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে কেন্দ্রের আরএসএস-বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে দেশের ধর্মনিরপেক্ষ বিরোধী শক্তির ঐক্যবদ্ধ মঞ্চ আরও একধাপ অগ্রসর হয়েছে মুম্বাই বৈঠকের পর। নিজেদের মধ্যে মত বিনিময়ের পরিসরকে যেমন বাড়ানো সম্ভব হয়েছে তেমনি পরস্পরের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস বাড়িয়ে আরও কাছাকাছি আসতে সক্ষম হয়েছে। ১৬ দলের পাটনা বৈঠক বেঙ্গালুরুতে ২৬ হয়ে মুম্বাইয়ে ২৮ দল হয়েছে। সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে আরও বেশ কয়েকটি দলের যোগদানের। এমনকি এনডিএভুক্ত কয়েকটি দলও আসতে পারে এই মঞ্চে। বেঙ্গালুরুতে বিরোধী মঞ্চের নামকরণ হয় ‘ইন্ডিয়া’। ধীরে কিন্তু দৃঢ়তার সঙ্গে ‘ইন্ডিয়া’র অগ্রগতিতে স্নায়ুর চাপ দ্রুত বাড়ছে শাসক বিজেপি’র। ভীতি ও আতঙ্কে বিচলিত হয়ে তারা পরপর এমন সব সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছে যে নতুন করে ধন্ধ তৈরি হচ্ছে। নানাভাবে চেষ্টা করেও যখন কোনও অবস্থাতেই ইন্ডিয়াতে ফাটল ধরানো সম্ভব হচ্ছে না তখন বাস্তবের দেওয়াল লিখন মোদী-শাহদের হৃদকম্পন বাড়িয়ে দিচ্ছে। তারই পরিণতি ন’বছর ধরে গ্যাসের দাম ৬০ টাকা বাড়িয়ে আচমকা ২০ টাকা কমানো। কার্যত নজিরবিহীনভাবে মাত্র পাঁচ দিনের জন্য সংসদের বিশেষ অধিবেশন ডেকে দেওয়া। অথচ কেন এই বিশেষ অধিবেশন, কর্মসূচিই বা কি সবটাই গোপন রাখা হয়েছে। এরই মধ্যে প্রাক্তন রাষ্ট্রপতিকে প্রধান করে কমিটি গঠন করা হয়েছে ‘এক দেশ, এক ভোট’ নিয়ে সুপারিশ করার জন্য। সন্দেহ নেই কমিটি যা সুপারিশ করবে সেটা আগে থেকেই ঠিক করে দেওয়া হয়েছে।
বাস্তবের জমি যতটা আঁচ করতে পারছে আরএসএস-বিজেপি তাতে তারা বুঝে গেছে নিছক মোদী হাওয়া বা মোদী ম্যাজিকে ২০১৪ সালের লোকসভা ভোট উতরানো যাবে না। বিশ্বগুরু বা শক্তিশালী নেতার ঢাক পিটিয়েও কলকে মিলবে না। জি-২০-এর বর্ষব্যাপী নানা বৈঠককে ঘিরে মোদীর ‘অপরাজেয়’ ভাবমূর্তি গড়ে তোলার বিস্তর চেষ্টা হলেও আসন্ন শীর্ষ সম্মেলনে সেটা বেসুরো হবার আশঙ্কা রয়েছে। শেষ পর্যন্ত সহমতের ভিত্তিতে যৌথ বিবৃতি সম্ভব হবে কিনা বলা মুশকিল। তেমনি বছর শেষে পাঁচ রাজ্যের নির্বাচনে জেতার আশাও প্রায় ফিকে হয়ে যাচ্ছে। রাজস্থান, ছত্তিশগড়ে কংগ্রেসকে হারিয়ে ক্ষমতা দখল তো দূরের কথা মধ্য প্রদেশে ক্ষমতা ধরে রাখাও অনিশ্চিত। মিজোরাম যাদের হাত ধরে ক্ষমতার শরিক হয়েছিল মণিপুর ইস্যুতে তারা বিজেপি-কে পরিত্যাগ করেছে। এমতাবস্থায় দিশাহীন বেপরোয়া হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। এক দেশ এক ভোট, অভিন্ন দেওয়ানি বিধি ইত্যাদি নিয়ে হঠাৎ করে মাতামাতি এবং সংসদের বিশেষ অধিবেশন ডেকে দেওয়া তারই লক্ষণ।
সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকা সংক্রান্ত কোনও ইস্যুতে দাবি করার মতো সাফল্য হাতে নেই মোদী সরকারের। বেকারি বা কর্মসংস্থানের সঙ্কট ভয়ানক জায়গায় পৌঁছে গেছে। মূল্যবৃদ্ধি, বিশেষ করে সাধারণের সর্বাধিক ব্যবহার্য জিনিসের এবং খাদ্য সামগ্রীর দাম আকাশ ছোঁয়া। মোদী জমানায় এসব জিনিসের দাম তিন-চার গুণ বেড়েছে। সরকার মূল্য নিয়ন্ত্রণে কার্যকর কোনও পদক্ষেপ নেয়নি, উলটে এমন নীতি ও পদক্ষেপ নিয়েছে যাতে দাম বাড়ে। তেমনি মানুষের রুজি রোজগারের জায়গাটি সব চেয়ে বিপন্ন এই জমানায়। এই জমানাতেই স্বাধীন ভারতের সর্বোচ্চ বেকারির হারের রেকর্ড তৈরি হয়েছে। আবার মজুরির হারও নিম্নগামী হয়েছে এই জমানায়। গত এক দশকে মানুষের প্রকৃত গড় মজুরি বা আয় বাড়েনি এবং অনেক ক্ষেত্রে কমেছে। তাই মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন পাওয়া সম্ভব নয়। এই অবস্থায় উগ্র হিন্দুত্ব আর উগ্র জাতীয়তাবাদ তথা দেশপ্রেমের ঝড় তুলে আবেগের জোয়ারে ভাসিয়ে ভোট কুড়ানো ছাড়া আর কোনও বিকল্প নেই। অতএব আর এক পুলওয়ামা বা আর একটি বালাকোটের মতো কিছু অথবা আরও ভয়ঙ্কর কিছু ঘটে গেলে অবাক হবার কিছু থাকবে না।
Comments :0