Ayodhya special story

রক্ষা করতে হবে অওধের অবশেষটুকু

জাতীয়

গুফরান সিদ্দিকী
লেখক সমাজকর্মী


কথায় বলে মাছ সমৃদ্ধির প্রতীক। অওধের শাহী প্রতীকেও দু’টি মাছ মুখোমুখি। যা পরে উত্তর প্রদেশের সরকারি প্রতীকও হয়ে ওঠে। যদিও অওধের প্রথম রাজধানী ফৈজাবাদে এই চিহ্ন এখন আবছা হয়ে গেছে। ঘাঘরার কিনারায় অবস্থিত এই ঐতিহাসিক শহর যে সংস্কৃতি এবং মিলিত সংগ্রামের পদাবলী লিখেছিল তা কিংবদন্তি হয়ে গেছে। অওধের আদবকায়দা আর সংস্কৃতি শুধু দেশের মধ্যেই নয়, দেশের বাইরেও পরিচিত। অওধের সরকারি নিশানকে আপনি পুরানো বাড়ি, মন্দির এবং মসজিদেও দেখতে পাবেন, যদি তা বেঁচে থাকে। 
ঘাঘরার তীরে অবস্থিত এই শহরের ভিত্তি ১৭২২ সালে মুঘল দরবার থেকে বুরহান মুলক উপাধিপ্রাপ্ত প্রথম নবাব সাদাত আলি খান করেন, যখন তাঁকে অওধের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। এই নতুন শহরের নাম মুঘল সাম্রাজ্যের দরবারি এবং অওধের প্রথম দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রভারি ফৈজ বখশের নামে করা হয়। ফৈজ বখশের পরে নবাব সাদাত আলি খান এবং পরে তাঁর উত্তরাধিকারিরা এই শহরকে গড়ে তুলেছিলেন এবং অওধের সেই সময়ের সবথেকে বড় প্রদেশে পরিণত করেছিলেন। 
সম্মিলিত আত্মত্যাগ এবং সম্মিলিত ঐতিহ্যের কেন্দ্র এই শহর আচমকাই স্বাধীনতার পরে নিজেদের আঘাতের শিকার হয়ে গেল। ১৯৪৯ সালের ২২ জানুয়ারি রাতে দক্ষিণপন্থী চরমপন্থীরা ফৈজাবাদ শহরের গা লাগা অযোধ্যায় বাবরি মসজিদে মধ্য রাতে তালা ভেঙে রামের মূর্তি রেখে দেওয়া হয়। এরফলে এই শহরের গায়ে সাম্প্রদায়িকতার যে ছাপ পড়ল তা দেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক ভবিষ্যতকে বদলে ফেলতে যাচ্ছিল। 
ফৈজাবাদ শহর তার কলা, সংস্কৃতি এবং সংগ্রামের জন্যেই পরিচিত ছিল। অযোধ্যায় স্থিত কেল্লা যার মধ্যে হনুমানগড়ি রয়েছে, তা অওধের নবাবদের দানের জমি হিসেবেই সরকারি নথিতে আছে। এর থেকে ওই সময়ের সমাজে হৃদ্যতার অনুমান করা যায়। 
নবাব শুজাউদদৌলা জীবদ্দশাতেই নিজের সমাধিক্ষেত্র বানিয়ে ফেলেছিলেন অতি সুন্দর গুলাববাড়ি। সেই গুলাববাড়ির আশপাশেই এই শহরে ছড়িয়ে রয়েছে বহু বেগমের মকবরা, মকবরা বনি খানম, মোতি মহল সহ বেশ কিছু ইমামবাড়া। ঘাঘরা নদী যাকে সরযু বলা হয়, তার তীরেও অপূর্ব সব মন্দির তৈরি হয়, যা ওই সময়ের বাস্তুকলার কাহিনি তুলে ধরে। গুলাববাড়ির ভেতরে নামের সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই অসংখ্য প্রজাতির গোলাপের সুগন্ধ সেখানের পরিবেশকে মাতিয়ে রাখে। যদিও দীর্ঘ সময় সরকারের পক্ষ থেকে এইসব ঐতিহাসিক ইমারতগুলির রক্ষণাবেক্ষণ উপেক্ষা করতে থাকায় তা জর্জর হয়ে যায়।
এইরকম জর্জর হতে থাকা ইমারতগুলির মতই এই সুন্দর শহরের গায়েও ১৯৯২সালের ৬ ডিসেম্বর সাম্প্রদায়িক ছাপ লাগিয়ে দেওয়া হয়। অথচ এই শহরের ইতিহাস ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত স্বাধীনতার মিলিত সংগ্রামের কাহিনিতে পরিপূর্ণ। মহন্ত পাগল দাস থেকে মৌলবী আহমদ উল্লা শাহ ওরফে ডঙ্কা শাহ থেকে কাকোরির শহীদ আসফাকউল্লাহ খান পর্যন্ত পৌঁছায়। মীর আনিস, পণ্ডিত বৃজনারায়ণ চকবস্ত, বেগম আখতার, মজাজ লখনওভি, মেরাজ ফৈজাবাদী, আচার্য নরেন্দ্র দেব প্রমুখ লোকেদের সম্পর্ক এই শহরের সঙ্গেই ছিল। নিরপেক্ষতার জন্য পরিচিত সমবায় আধারিত বহুচর্চিত সংবাদপত্র ‘জনমোর্চা’র সূচনাও এখান থেকেই হয়েছে। 
দিলকুশা, টাকসাল, রিকাবগঞ্জ, মোতি মসজিদ, অঙ্গুরিবাগ মহল্লা সেই সময়েই তৈরি হয়েছিল। এই শহরের মুখ্য বাজারের কথাও যদি বলি, তাহলে সেই চক বাজারের চারদিকে সুন্দর খিলানের দরজাগুলি যা এক দরা, দ্বিদরা এবং তিন দরা নামে পরিচিত, জর্জর হয়ে পড়লেও অতীত গৌরবের পরিচয় দেয়। এই চকের একদিকে ওই সময়ের শাহী মসজিদ আছে, যার ছাদ থেকে এই চকের পুরো এলাকা দেখা যায়। ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহ ব্যর্থ হওয়ার পরে ব্রিটিশ তাদের জয়ের নিশান হিসেবে চকের মাঝামাঝি একটা ক্লক টাওয়ার বানিয়ে দেয়, যা আজও আছে। 
ফৈজাবাদ শহর থেকে কিছু দূরে অযোধ্যা অসংখ্য দরগা এবং মসজিদ রয়েছে। এখানে কবীরপন্থ, জৈন এবং বৌদ্ধ ধর্মের সঙ্গে যুক্ত ঐতিহাসিক প্রমাণ আছে, আছে গুরদ্বার থেকে ভেসে আসা গুরবাণীর সুর। কিন্তু এই নতুন সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গী শ্রেষ্ঠতার যে ঘূর্ণিঝড়কে দাঁড় করিয়েছে, তা শত শত বছরে রীতিনীতি, সাহিত্য এবং সংস্কৃতিকে নিজের কর্কশ আওয়াজের নিচে চাপা দিয়ে দিয়েছে। এই সময়ে জরুরি এই শহরের সমাবেশী ইতিহাসকে বাঁচিয়ে রাখার, আর যেটুকু বেঁচে গেছে তাকে রক্ষা করার।
 

Comments :0

Login to leave a comment