‘‘ভারতের সমস্ত মানুষের জন্য সুলভে পরিবহণ পরিষেবা দেওয়ার পাশাপাশি দেশের প্রতিটি প্রান্তে রেল সংযোগ পৌঁছে দিয়ে দেশকে ঐক্যবদ্ধ করত ভারতীয় রেল। এর পাশাপাশি বিভিন্ন ধর্ম, ভাষা এবং পরম্পরার যাত্রীদের মধ্যেও ঐক্য সাধন করত ভারতীয় রেল। বর্তমানে সেই ঐতিহ্য ধ্বংস করছে ভারতীয় রেল।’’
রবিবার নিজের এক্স অ্যাকাউন্ট থেকে মুনথাসির ইয়াসিন নামে এক ব্যক্তির করা একাধিক এক্স পোস্ট শেয়ার করে এ’কথা লিখলেন সিপিআই(এম)’র সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি।
একদিকে ‘ফ্লেক্সি ফেয়ার’-র নামে টিকিটের দাম আকাশছোঁয়া। ২০২৩ সালের ১৭ নভেম্বরের দ্যা হিন্দুর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ফ্লেক্সি ফেয়ারের ঠেলায় মুম্বই থেকে পাটনাগামী পাটনা সুবিধা এক্সপ্রেসের থার্ড এসির টিকিটের দাম ছিল ৬,৬৫৫ টাকা এবং স্লিপার ক্লাসের টিকিট ছিল ২,৬২৫ টাকা। সেকেন্ড এসির দাম ছিল ৯,৩৯৫ টাকা, যা বিমান ভাড়ার সমান। আরেকদিকে ট্রেনে সাধারণ বগির অভাব। বেশিরভাগই এসি কোচ করে দেওয়া হচ্ছে। গাড়ির সংখ্যা কম। ফলে সংরক্ষিত কামরাতেও লেগে রয়েছে ভিড়। দুই ছবিই হাজির করেছেন ইয়াসিন।
বর্তমানে ভারতীয় রেল যাত্রার পরিচিত ছবি হয়ে দাঁড়িয়েছে সংরক্ষিত কামরায় অসংরক্ষিত যাত্রীদের ভিড়। ভিড়ের এক খন্ডচিত্র ১৪ এপ্রিল নিজের এক্স অ্যাকাউন্ট থেকে পোস্ট করেন জনৈক আদনান বিন সুফিয়ান এক্স নামে ব্যবহারকারী। ভিডিও’র ক্যাপশনে তিনি লেখেন, কাশী এক্সপ্রেসের এসি টু টিয়ার কামরা ভিড়ের দখলে চলে গিয়েছে। পানীয় জল, খাবার কিছুই মিলছে না। যাত্রীরা শৌচালয়ে যেতে পারছেন না। সংরক্ষিত আসনের যাত্রীরা কামরার দরজা খুলে দাঁড়িয়ে থাকায় এসিও কাজ করছে না।
তিনি রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণবকে ট্যাগ করে নিজের অভিযোগ জানান। সেই পোস্ট ও ভিডিও ভাইরাল হয়।
এরপর রেলের তরফে পালটা একটি কামরার ছবি পোস্ট করে জানানো হয়, কাশী এক্সপ্রেসে কোনও ভিড় নেই। রেলের দাবি, ইচ্ছাকৃত ভাবে ভুল তথ্য দিয়ে রেলের বদনাম করার চেষ্টা করছেন ওই এক্স ব্যবহারকারী।
রেলের বক্তব্য যদিও ভালোভাবে নেননি এক্স ব্যবহারকারীরা। একের পর এক পোস্টে তাঁরা জানান, বর্তমানে রেলযাত্রা কঠিন হয়ে পড়েছে। সাধারণ যাত্রীবাহী এক্সপ্রেস ট্রেনগুলির চেনা ছবি হল ভিড়ের দাপট। অন্যান্য পরিষেবাও ভেঙে পড়েছে। বহু যাত্রী এই পরিষেবার দিকে নজর না দিয়ে বন্দে ভারতের মত বহুল প্রচারিত ট্রেনের প্রচারকেও এরজন্য দায়ী করেন।
এই ঘটনার কারণ হিসেবে মোট ৬’টি বিষয়কে চিহ্নিত করেন মুনথাসির ইয়াসিন। সেই পোস্ট শেয়ার করেছেন ইয়েচুরি।
ইয়াসিন লিখেছেন, ভারতীয় রেল ব্যবস্থাকে ধ্বংসের প্রথম ধাপ ছিল পৃথক রেলবাজেট তুলে দেওয়া। পৃথক রেল বাজেট থাকার ফলে রেলের উন্নয়নে বাড়তি নজর দিতে বাধ্য ছিল কেন্দ্রীয় সরকার। বর্তমানে সেটা বন্ধ।
দ্বিতীয়ত, বিমানের কায়দায় রেলের টিকিটের দামও চাহিদার সঙ্গে বাড়ানোর ব্যবস্থা করে কেন্দ্র। খাতায় কলমে এই প্রক্রিয়ার নাম ফ্লেক্সি ফেয়ার। ২০২৩ সালের ১৭ নভেম্বরের দ্যা হিন্দুর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ফ্লেক্সি ফেয়ারের ঠেলায় মুম্বই থেকে পাটনাগামী পাটনা সুবিধা এক্সপ্রেসের ১টি এসি টু টিয়ারের দাম দেখায় ৯,৩৯৫ টাকা, যা বিমানের ভাড়ার সমতূল্য। একই টিকিটের বেস প্রাইস ২,৯৫০ টাকা। কিন্তু চাহিদার তুঙ্গে থাকায় যাত্রীদের গুণতে হয়েছে বাড়তি ৫৯০০ টাকা। থার্ড এসি এবং সাধারণ স্লিপার ক্লাসেও টিকিটের দাম পাল্লা দিয়ে বেড়েছে।
এরফলে রেল বিপুল মুনাফা করলেও বহু সাধারণ যাত্রী টিকিট কিনতে পারছেন না। তাঁরা বাধ্য হয়ে অসংরক্ষিত আসনের টিকিট কিনে ট্রেনের কোনও একটা কামরায় উঠে পড়ছেন।
ইয়াসিনের বিশ্লেষণ, রেলকে অন্ধকারে ঠেলে দেওয়ার তৃতীয় ধাপ হিসেবে কাজ করেছে স্লিপার এবং সেকেন্ড ক্লাস কোচের সংখ্যা কমিয়ে এসি কোচের সংখ্যা বাড়ানো। রেলমন্ত্রক বাস্তবকে অগ্রাহ্য করে স্রেফ মুনাফার জন্য এই কাজ করেছে। ভারতীয় রেলের ৯৫.৩ শতাংশ যাত্রী জেনারেল কিংবা স্লিপার ক্লাসে যাতায়াত করেন। এসি কামরার টিকিট কাটেন মাত্র ৪.৭ শতাংশ। তারপরেও ২২ কামরার ট্রেনে জেনারেল এবং স্লিপার কামরার সংখ্যা মাত্র ১২। ৮টি কামরা এসি। স্বাভাবিক নিয়মেই আসন না পাওয়া ভিড় হানা দিচ্ছে সংরক্ষিত কামরায়, এবং সমস্যায় পড়ছেন সাধারণ যাত্রীরা।
এছাড়াও বয়স্ক যাত্রীদের টিকিটের ছাড় তুলে দেওয়া এবং টিকিট ক্যানসেল করলে বেশি টাকা কেটে নেওয়ার মত পদক্ষেপের মাধ্যমেও ভারতীয় রেলকে পিছনের দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে বলে মত ওই এক্স ব্যবহারকারীর।
প্রসঙ্গত, কোভিডের সময় থেকেই বয়স্কদের টিকিটের ছাড় তুলে দিয়েছে কেন্দ্র। ২০২০ সাল থেকে এখনও অবধি সেই ছাড় না দিয়ে ২২৪২ কোটি টাকারও বেশি আয় করেছে রেল। টিকিট ক্যানসেল করার মাশুল বাড়িয়ে রেল গত তিন বছরে আয় করেছে ১২৩০ কোটি টাকা।
Comments :0