ISRAEL PALESTINE CONFLICT

ইজরায়েলের ভিতরে হামাস যোদ্ধারা

আন্তর্জাতিক

israel palestine conflict hamas usa israel iran india bengali news

অভাবনীয় চকিত আক্রমণে ইজরায়েলের মধ্যে ঢুকে পড়েছে প্যালেস্তাইনের যোদ্ধারা। হামাসের নেতৃত্বে গাজা থেকেই এই নজিরবিহীন সামরিক অভিযানের পরপরই পূর্ণ মাত্রার যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। ৭৫ বছরের দখলদারি, গত এক বছরে অধিকৃত ভূখন্ডে ভয়ঙ্কর ইজরায়েলী হিংসার জবাব দিতেই এই প্রত্যাঘাত। সামরিক শক্তিতে অনেক দুর্বল হওয়া সত্ত্বেও এবং বিরাট ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা মাথায় নিয়েই ইজরায়েলের সীমান্ত বাহিনীকে উড়িয়ে দিয়ে হামাসের এই অভিযানে দুনিয়াজুড়েই চাঞ্চল্য তৈরি হয়েছে।  
শনিবার স্থানীয় সময় ভোরে গাজার উত্তর প্রান্তের সীমানা দিয়ে ইজরায়েলী বাহিনীকে হতচকিত করে ঢুকে পড়ে হামাসের বাহিনী। এই সব সীমান্তই আসলে অধিকৃত প্যালেস্তাইনের ভূখন্ড। সশস্ত্র পাহারা থাকে সারা বছর। অতীতে যতবার সংঘাত হয়েছে আরবদের নিয়ন্ত্রিত জমির মধ্যেই হয়েছে। ১৯৪৮ সালের পরে এই প্রথম প্যালেস্তাইনের যোদ্ধারা সরাসরি ইজরায়েলে ঢুকে পড়েছে। সংবাদমাধ্যমের সূত্রে জানা গেছে, প্রায় এক হাজার প্যালেস্তিনীয় ইজরায়েলে ঢুকেছে। স্থল সীমানায় ইজরায়েলী বাহিনীকে হঠিয়ে দিয়ে এমনকি আকাশপথেও, প্যারাগ্লাইডিং করে। ট্যাঙ্ক, মোটর সাইকেল, ট্রাকে করে হামাস যোদ্ধারা দলে দলে ইজরায়েলের শহর এলাকায় পৌঁছে যায়। কিছু যোদ্ধা উপকূলে স্পিড বোটেও ঢুকেছেন। সীমান্তের কড়া প্রাচীর বিস্ফোরণে উড়িয়েও তাঁরা ঢোকেন। ইজরায়েলী সেনাদের ট্যাঙ্ক দখল করে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। রাইফেল থেকে গুলি ছোঁড়া হয়। সেইসঙ্গে গাজা থেকে ক্ষেপণাস্ত্রও ছোঁড়া হয়। প্রায় ২৫০০ ক্ষেপণাস্ত্র ছোঁড়া হয়েছে। ভারতীয় সময় রাত পর্যন্ত প্রায় ১০০ ইজরায়েলী নাগরিক নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ৫০০-র বেশি। 
সাতসকালেই এমন আক্রমণে বিস্মিত ও ত্রস্ত ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু ঘোষণা করে দেন, ইজরায়েল যুদ্ধে রয়েছে। ইজরায়েল পালটা আক্রমণও শুরু করে। ইজরায়েলের মধ্যে অন্তত সাতটি শহরে হামাসের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়েছে ইজরায়েলের সেনাদের। কিন্তু সামরিক আয়োজনে অনেক এগিয়ে থাকা ইজরায়েল মূল আক্রমণ চালাচ্ছে যুদ্ধবিমান থেকে বোমাবর্ষণ করে। গাজাকে গুঁড়িয়ে দেবার লক্ষ্যেই নির্বিচার বোমা ও ক্ষেপণাস্ত্র ছোঁড়া হয়েছে। সর্বশেষ খবর অনুযায়ী, গাজায় ২০০-র বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। 
এমনিতেই চারদিক থেকে অবরুদ্ধ গাজা। প্যালেস্তাইনের ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক ঘিরে রেখেছে ইজরায়েল। তার মধ্যেই আরব জমি দখলের আগ্রাসী অভিযান চলছে গত কয়েক মাস ধরে। ইজরায়েলের কট্টর দক্ষিণপন্থী সরকার ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে আরবদের হঠিয়ে অভিবাসনের মাত্রা কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। ইজরায়েলী সেনারা পূর্ব জেরুজালেম এবং ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে একের পর এক আক্রমণ চালিয়ে প্রায়  ৩০০ প্যালেস্তিনীয়কে হত্যা করেছে হত এক বছরে। জেরুজালেমে আল-আকসা মসজিদ ইজরায়েলী সেনারা কার্যত দখল করে নিয়েছে। এই ঘটনাক্রমই হামাসের তরফ থেকে এমন দুঃসাহসিক অভিযানের জন্ম দিয়েছে। হামাস এই অভিযানের নাম দিয়েছে ‘অপারেশন আল-আসকা ফ্লাড’। হামাসের সেনাবাহিনীর অন্যতম নেতা মহম্মদ দেইফ এক অডিও বার্তায় বলেছেন, ‘অনেক হয়েছে, আর নয়। পৃথিবীর ভূখন্ডে শেষ দখলদারির অবসানের লক্ষ্যে এ হলো শেষ এবং মহত্তম যুদ্ধ’। তিনি প্যালেস্তাইনের জনগণের কাছে আহ্বান জানিয়েছেন, ‘ইজরায়েলের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে সামিল হন। যদি বন্দুক থাকে তাহলে হাতে তুলে নিন। ট্রাক, গাড়িতে বেরিয়ে পড়ুন, হাতে কুঠার থাকলে তা নিয়েও বেরোন।’  
গাজা থেকে বেরোনোর সাতটি স্থান রয়েছে। ৪৫ কিলোমিটার দৈর্ঘের এই সীমান্তের উত্তরতম প্রান্ত দিয়েই সরাসরি ইজরায়েলে ঢুকে পড়া যায়। এদিন সেই সীমান্ত সহ কঠিনতম এলাকাগুলি দিয়েও হামাস যোদ্ধারা ঢুকে পড়েন। ভিডিওতে দেখা গেছে, তাঁরা ইজরায়েলী সেনাদের আটক করেছেন। তাঁদের অস্ত্র কেড়ে নিয়েছেন। ট্যাঙ্ক দখল করে সেই ট্যাঙ্ক নিয়েই এগচ্ছেন। তেল আভিভ এবং জেরুজালেমেও একটানা সাইরেন বেজেছে। তা থেকে অনুমান করা যাচ্ছে অন্তত ৮০ কিলোমিটার দূরত্ব পর্যন্ত হামাসের ক্ষেপণাস্ত্র পৌঁছচ্ছে। লক্ষ লক্ষ ইজরায়েলী বম্ব শেল্টারে আশ্রয় নিয়েছেন। শহর ফাঁকা হয়ে গেছে। হামাস যোদ্ধারা ইজরায়েলের কয়েকজন সেনা কম্যান্ডার ও জওয়ানকে ধরে গাজায় নিয়ে গেছে। তবে রাতের দিকে হামাস জানিয়েছে, প্রচুর সংখ্যায় তারা ইজরায়েলীদের বন্দি করেছে। ইজরায়েলে কারারুদ্ধ প্যালেস্তিনীয় বন্দিদের মুক্ত করতে এদের বিনিময় করা হবে। 
ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু টেলিভিশন ভাষণে বলেন, আমরা যুদ্ধে চলে গেছি। সমগ্র সেনাবাহিনীকে সমবেত করা হচ্ছে। এ কোনো ছোটখাটো অভিযান নয়, এটি পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ। ইজরায়েল শত্রুকে এমন উত্তর দেবে যা তারা কখনও দেখেনি। নেতানিয়াহু নিরাপত্তা অফিসারদের বৈঠকে আদেশ দিয়েছেন, প্রথমে শত্রুরা যেখানে ঢুকেছে তা পুরো সাফ করে দিতে হবে। তারপর শত্রুদের কাছ থেকে চড়া মূল্য আদায় করতে হবে। অন্য সীমান্ত রক্ষা করতে হবে যাতে অন্য কেউ সেখান দিয়ে আক্রমণ করতে না পারে। নেতানিয়াহু ‘শত্রু’ বলতে প্যালেস্তাইনের মানুষকেই বুঝিয়েছেন। ‘অন্য কেউ’ বলতে তাঁর ইঙ্গিত লেবানের হেজবুল্লাহ। ইতিমধ্যেই হেজবুল্লাহ গোষ্ঠীর পক্ষ থেকে হামাসের ‘বীর ভাইদের’ অভিনন্দন জানানো হয়েছে। নেতানিয়াহু মার্কিন রাষ্ট্রপতি বাইডেনকে জানিয়েছেন, এই যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হবে। ইজরায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ইয়োয়াভ গ্যালান্ট বলেছেন, হামাস বড় ভুল করল। এই যুদ্ধে ইজরায়েলই জিতবে। 
হামাস গাজার নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতায় রয়েছে ১৫ বছর ধরে। তখন থেকেই গাজাকে সেনা দিয়ে অবরুদ্ধ করে রেখেছে ইজরায়েল। চার বার সামরিক সংঘাতও হয়েছে। কিন্তু হামাসের তরফে এই মাত্রার সামরিক অভিযান কখনও হয়নি। হামাসের আক্রমণের খবরে পুরো প্যালেস্তাইন জুড়েই রাস্তায় নেমে পড়েন মানুষ। উচ্ছ্বাস ও সমর্থন প্রকাশ করে বুঝিয়ে দেন, এই যুদ্ধ শুধু হামাস লড়ছে না। 
তবে গাজাকে ‘চড়া মূল্য’ দিতে হবে, তা আন্দাজ করাই যাচ্ছে। ইতিমধ্যেই গাজা জুড়ে বোমাবর্ষণ চলছে। গাজার সীমান্তে শরণার্থী শিবিরগুলিতে হাজার হাজার মানুষ কোনোক্রমে ঠাসাঠাসি করে থাকেন। সেগুলি লক্ষ্য করেও ইজরায়েলের বিমান হানা চলছে। একটির পর একটি বড় বাড়ি লক্ষ্য করে ইজরায়েল বোমা ফেলছে। হাসপাতাল ভরে উঠেছে আহতদের স্রোতে। ১৬০০ মানুষ আহত হবার খবর মিলেছে ভারতীয় সময় রাত পর্যন্ত। গাজার অধিবাসী ইব্রাহিম ওয়াঘি সংবাদসংস্থাকে বলেছেন, সকাল থেকে আমাদের এলাকায় টানা বোমা ফেলছে ইজরায়েল। আমাদের শিশুরা আতঙ্কিত, তাদের জীবন ও স্বপ্ন শেষ হয়ে যাবে। দক্ষিণ গাজার রাফায় এনাস কেশতা বলেছেন, একটানা ৭৫ বছর ধরে প্যালেস্তাইন আক্রান্ত। এই হতাশাই প্যালেস্তিনীয়দের সামরিক অভিযানে রূপান্তরিত হয়েছে। নাসের হাসপাতালের সামনে অ্যাম্বুল্যান্সেও ইজরায়েলী বোমা পড়েছে। হামাসের তরফে জানানো হয়েছে, সবচেয়ে খারাপ কী হতে পারে তা জেনেই এই যুদ্ধ। ইজরায়েল গাজার ভূখন্ডে সেনা পাঠাবে। আমরা প্রস্তুত রয়েছি। 
ইতিমধ্যেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমী দেশগুলি প্রত্যাশিত ভাবেই ইজরায়েলের পাশে দাঁড়িয়েছে। ভারতও ইজরায়েলের ওপরে ‘আক্রমণের’ নিন্দা করেছে। অন্যদিকে ইরান হামাস যোদ্ধাদের অভিনন্দন জানিয়েছে। সৌদি আরব ইজরায়েলের সঙ্গে মৈত্রী স্থাপনের প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে। তাদের তরফে বলা হয়েছে, যেভাবে প্যালেস্তাইনের জনগণকে বঞ্চিত করে রাখা হচ্ছে, যেভাবে উত্তেজনা বাড়ছিল তার এমন ফলাফল হবে বলে সৌদি আরব আগেই আশঙ্কা জানিয়েছিল। তারা ও তুরস্ক উভয় পক্ষকেই সংযম দেখাতে আহ্বান জানিয়েছে।

Comments :0

Login to leave a comment