Post Editorial

প্যালেস্তাইনের শেষ অস্তিত্বটুকুও মুছে ফেলতে চায় ইজরায়েল

উত্তর সম্পাদকীয়​

বিক্রমজিৎ ভট্টাচার্য 
 

‘আমিই সেই প্যালেস্টানিয়ান, আমিই গরবে দাঁড়িয়ে আছি- ডেভিডের শিশু। হাতে আমার শুধু একটা পাথর, এই নিয়েই আমার সংগ্রাম। ইজরায়েলি গোলিয়াথের বিরুদ্ধে- একা লড়ব, এতটুকু ভয় নেই আমার’।  -কবি মাহমুদ দারভিশ।
এক মাস বয়স থেকে আট বছরের শিশুদেরও রেয়াত করছে না ইজরায়েলী‍‌ সেনাবাহিনী। গাজাতে প্যালেস্তিনীয় শিশুরাই ইজরায়েলী সেনাদের পছন্দের টার্গেট। আন্তর্জাতিক আইনের কোনরকম তোয়াক্কা না করে প্যালেস্তাইন দখলের পরও ক্ষান্ত হয়নি ইজরায়েল। অধিকৃত প্যালেস্তাইনের লক্ষ লক্ষ মানুষ বর্তমানে ঘর ছাড়া। গাজায় অন্যায় অবরোধ করে রেখেছে ইজরায়েল। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় খোলা জেলখানা এখন গাজা। শুকিয়ে মারা হচ্ছে গাজার মানুষকে। জল নেই , বিদ্যুৎ নেই , খাবার নেই , ওষুধ নেই। নাগাড়ে চলছে যুদ্ধবিমান থেকে বোমা বর্ষণ। ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে জায়গা জমি কেড়ে নিয়েছে ইজরায়েলী দখলদারেরা। খেয়াল খুশি মতোই বহু প্যালেস্তিনীয় নাগরিকের বাড়ি-ঘর ট্যাঙ্কার গোলার সাহায্য গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। আর তারই সঙ্গে যোগ হয়েছে প্যালেস্তাইনের আগামী প্রজন্ম ধ্বংসের ছক। প্রথম লক্ষ্য হলো নির্বিচারে সন্ত্রাস চালিয়ে প্যালেস্তিনীয়দের দেশছাড়া করার। এবং এর জন্যই ইজরায়েলী সেনাদের নিশানায় প্যালেস্তিনীয় শিশুরা। আর যাই হোক, বাচ্চাদের রক্ষা করতে প্যালেস্তিনীয় অভিভাবকেরা যে বাধ্য হবেন, তা খুব ভালো করেই জানে ইজরায়েল। দ্বিতীয় লক্ষ্যও সাংঘাতিক। ছোট থেকেই প্যালেস্তিনীয় শিশুদের ওপর বীভৎস শারীরিক ও মানসিক অত্যাচার চালিয়ে তাদের প্রতিবাদী সত্তাকে তিলে তিলে খতম করে দেওয়া। আজকের শিশু যাতে যৌবনে বিদ্রোহী না হয়। একই সঙ্গে চলছে শৈশব খতম অভিযান। ফলে ইজরায়েলী সেনাদের বন্দুকের নল তাক করছে প্যালেস্তিনীয় শিশুদের। অধিকাংশ ক্ষেত্রে শিশুদের মাথা অথবা দেহের উপরিভাগেই গুলি করা হচ্ছে। মাঝ রাতে প্যালেস্তিনীয় বাড়িতে অভিযান চালানো হচ্ছে। বিছানায় ঘুম থেকে টেনে তোলা হচ্ছে শিশুদের। একদফা মারধরের পর তাদের কুকুর-বিড়ালের মতো রাস্তা দিয়ে মারতে মারতে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে কোনও সেনা শিবিরে। এখানে শিশুদের ওপর চলছে অকথ্য অত্যাচার এবং যৌন নির্যাতন। গাজায় নির্বিচার বোমাবর্ষণ চলছে আবাসিক এলাকায়। জেনেশুনেই। এখন এমনকি হাসপাতালও গুঁড়িয়ে দিয়েছে ইজরায়েলী বোমা। 


প্রতিবন্ধী আশ্রম, ত্রাণ শিবিরের ওপরেও আঘাত হেনেছে ইজরায়েলি রকেট। এসবই হচ্ছে হামাসের ৭ অক্টোবরের আক্রমণের পরে। কিন্তু ইতিহাস শুধু এইটুকু নয়। এই অক্টোবরের অনেক আগেই গাজায় বারংবার আক্রমণের নজির রেখেছে ইজরায়েল। প্যালেস্তাইনের অভ্যন্তরের ঘটনাক্রম হামাসকে শক্তিশালী করেছে। একটানা মার খাওয়া প্যালেস্তিনীয়দের সমর্থন জুটেছে তাদের। হামাস চোরাগোপ্তা  প্রত্যাঘাত চালিয়ে গেছে ইজরায়েলের ওপর। ৭ অক্টোবরের পরে ইজরায়েল শুধু হামাসকে লক্ষ্যবস্তু করেনি, করেছে গোটা গাজাকেই, এমনকি ওয়েস্ট ব্যাঙ্ককেও, যেখানে হামাস তত শক্তিশালী নয়। ইজরায়েলের নির্বিচার বিমান হানায় প্রাণ গেছে এক হাজারের বেশি প্যালেস্তিনীয় শিশুর ! প্রাণ গেছে অন্তত এক হাজার মহিলার।  গাজায় এই হামলা চালানোর জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে আমেরিকার পাঠানো এফ-১৬ যুদ্ধবিমান, অ্যাপাচে হেলিকপ্টার ও যুদ্ধজাহাজ। প্রতিদিন গড়ে হাজারটি করে প্রায় ১০ হাজার বোমা ফেলেছে ইজরায়েল। গাজা স্ট্রিপের জনসংখ্যা প্রায় ২৩ লক্ষ। তিন দশক ইজরায়েলের দখলদারিতে ছিল গাজা। ২০০৫ সালে ইজরায়েল গাজা থেকে তার সেনা সরিয়ে নিলেও গাজাকে আক্ষরিক অর্থেই দেওয়াল তুলে অবরুদ্ধ করে দেয়। চার পাশ থেকে শুরু হয় নির্মম অবরোধ। গাজায় অবরোধ শুরু হওয়ার পর থেকে থেকেই হামলা চালিয়েছে ইজরায়েল। ২০০৮-০৯-এ বড় রকমের আক্রমণ চালায় তারা। ইজরায়েলের এই হামলার নাম দেওয়া হয়েছিল অপারেশন ‘কাস্ট লিড’। প্রায় বছরখানেক ধরে চলেছিল আক্রমণ। যার প্রথম ভাগেই নিহত হয়েছিল গাজার মহিলা-শিশু সহ ১,৩০০ জন। পরে সেই সংখ্যা বেড়ে হয়েছিল দেড় হাজারের ওপর। ২০১২-র নভেম্বরে ফের হয় একটানা হামলা। পাশাপাশি গাজাকে ঘিরে অবরোধ এক অমানবিক অবস্থা তৈরি করেছে। প্রতিদিনই এখানে খাবার, ওষুধ এবং অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের অভাবে মানুষ মারা যাচ্ছে। 


১৯৪৭ সালে রাষ্ট্রসঙ্ঘ বলেছিল, প্যালেস্তাইনের ৫৫ ভাগ জমিতে গঠিত হবে ইহুদি রাষ্ট্র। বাকি জমি আরব সম্প্রদায়ের জন্য। যদিও সেই সময় সমগ্র প্যালেস্তাইন ভূখণ্ডে ইহুদি সম্প্রদায়ের হাতে ছিল মাত্র ৭ শতাংশ জমি। আদি আরব বাসিন্দাদের জমি কেড়ে দিয়ে দেওয়া হয়েছিল ইহুদিদের হাতে। রাষ্ট্র গঠনের মাত্র একবছরের মধ্যে মূল প্যালেস্তাইন ভূখণ্ডের প্রায় ৮০ শতাংশ জমি দখল করে নেয় ইজরায়েলী দখলদার বাহিনী। ১৯৬৭ সালের জুনে আরব দেশগুলির সঙ্গে যুদ্ধের সময় থেকে গাজা ( ১৯৪৮ সাল থেকে ছিল মিশরের প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণে) এবং পূর্ব জেরুজালেমসহ ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক (১৯৪৮ সাল থেকে ছিল জর্ডানের প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণে) অঞ্চল ইজরায়েল দখল করে নেয়। দখল করে নেয় সিরিয়ার গোলান হাইটস। পুরোটাই বেআইনি দখলদারি।  লক্ষ লক্ষ প্যালেস্তাইনবাসী উদ্বাস্তু হিসেবে দিন কাটাচ্ছেন নিদারুণ যন্ত্রণায়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বাস্তুচ্যুত প্যালেস্তিনীয়ের সংখ্যা এখন ৭০ লক্ষেরও বেশি।  ফলে এক সময় ঐতিহাসিক প্যালেস্তাইনের ৮০শতাংশ ইজরায়েলের দখলে ছিল। এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯৫ শতাংশে। রাষ্ট্রসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদের ১৯৪ নম্বর প্রস্তাব মানছে না ইজরায়েল। যেখানে বলা হয়েছে, প্যালেস্তিনীয় শরণার্থীদের তাঁদের পিতৃভূমিতে বাস করার অধিকার আছে। উলটে ইজরায়েল ৬৬৩ কিলোমিটার দীর্ঘ প্রাচীর তৈরি করছে। যা আসলে বিভেদ ও বিভাজনের প্রাচীর। যে সীমান্ত প্রাচীর ১৯৬৭ সালের সীমানার দ্বিগুণ। রাষ্ট্রসঙ্ঘের ঘোষণা, ইজরায়েলের দখলদারি অবৈধ। কানেই তোলে না ইজরায়েল। রাষ্ট্রসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদ এখনও পর্যন্ত কোনও পদক্ষেপ নেয়নি। কোনও পদক্ষেপ না নেওয়ার কারণ ইজরায়েল নয়। আসল কারণ ইজরায়েলের পাশে আমেরিকা। অধিকৃত অঞ্চল থেকে ইজরায়েলের সরে যাওয়া সংক্রান্ত যাবতীয় পদক্ষেপে ওয়াশিংটন প্রয়োগ করে এসেছে ভেটো। অন্যদিকে, প্যালেস্তাইনের রাস্তায় আজ রক্তের স্রোত। প্রতিবছর ইজরায়েল সরকার ও তার সেনাবাহিনীকে আমেরিকা দেয় চার বিলিয়ন ডলার। আত্মরক্ষার জন্য নয়, দখলদারি কায়েম রাখার জন্য। কিন্তু প্যালেস্তিনীয়দের নিরাপত্তায়? কোনো শব্দ নেই আমেরিকা সহ পশ্চিম বিশ্বের। গত তিন দশকে ইজরায়েলের প্রতি পশ্চিম বিশ্বের পৃষ্ঠপোষকতা একবারও দোদুল্যমান হয়নি। এমনকি গাজার পশ্চিমাঞ্চলের ছিটমহলকে ইজরায়েল খোলা আকাশের নিচে বিশ্বের সবচেয়ে বড় কারাগার থেকে ভয়ঙ্কর নির্যাতন শিবিরে পরিণত করার পরও তাদের সেই সমর্থনে একবিন্দু্ও চিড় ধরেনি। আমেরিকা এমনিতেই খুব খুশি, কারণ ওদের চাই যুদ্ধ, জো বাইডেন তো বলেই দিয়েছেন যে ইজরায়েল ও হামাসের মধ্যে একটা ‘দীর্ঘ যুদ্ধ’ সামনে। দীর্ঘ যুদ্ধ আমেরিকার সমরাস্ত্র শিল্পের মুনাফার জন্য এবং অভ্যন্তরীণ সঙ্কট থেকে জনসাধারণের চোখ সরিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে আশীর্বাদ হিসেবে বারবার প্রমাণিত। 
‘ইংল্যান্ড যেমন ইংলিশদের, ফ্রান্স যেমন ফরাসিদের, প্যালেস্তাইনও সেভাবে আরবদের। সে কারণে আরবদের উপরে ইহুদিদের চাপিয়ে দেওয়া ভুল ও অমানবিক। প্যালেস্তাইনে যা চলছে তাকে কোনোরকম নৈতিক আচরণবিধি দ্বারা বৈধতা দেওয়া যায় না।’ লিখেছিলেন গান্ধীজী, হরিজন পত্রিকার সম্পাদকীয়তে। ১৯৩৮সালের নভেম্বরে। আবার, ইহুদিবাদই যে সর্বশ্রেষ্ঠ এই ফ্যাসিবাদী তত্ত্বের উদগাতা থিওডোর হারজল। ১৮৯৬ সালে ‘দি জুইশ স্টেট’ নামক বইতে তিনি বলেন , একটি ইহুদি রাষ্ট্র তৈরি করাই সেরা সমাধান। এইরকম রাষ্ট্র গঠনের সবচেয়ে ভালো জায়গা প্যালেস্তাইন। জায়নবাদ তৈরি হয়েছে এই ধারণা থেকে। এরকম ভাবনা আরো একজন ভেবেছিলো, সে আবার ছিল উল্টোদিকের, সে হত্যা করেছিল এই ইহুদিদেরই ! জার্মানির সেই একনায়ক ব্যক্তি ও তার জেনারেলদের স্থান কোথায় সেটা আজকের ইজরায়েল হয়তো ভুলে গেছে ! গাজা থেকে মুছে ফেলা হচ্ছে তার অধিবাসীদের শেষ অস্তিত্বটুকুও। হাতের রক্তের দাগ আরও লাল হচ্ছে আমেরিকা, ব্রিটেন সহ তাদের ইউরোপীয় মিত্রদের।
 

Comments :0

Login to leave a comment