Modi man ki bat

‘বিশ্বগুরু’ সাজার মঞ্চ জি-২০, স্পষ্ট করল ‘মন কি বাত’

জাতীয়

 রবিবার ৯৫ তম ‘মন কি বাত’-এ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর আলোচনার সিংহভাগ জুড়ে রইল ‘জি-২০’। ভারত যে আগামী বছর জি-২০’র সভাপতিত্ব করার সুযোগ পেয়েছে, সেটাকে তিনি বিরাট করে তুলে ধরলেন এদিনের বক্তব্যে। প্রধানমন্ত্রীর ভাষায় জি-২০’র সভাপতিত্ব আমাদের জন্য একটি সুযোগ। আমাদের বিশ্ব কল্যাণের দিকে নজর দিতে হবে। সেটা শান্তি হোক বা একতা হোক বা সতত বিকাশ। এই সমস্ত বিষয়ের সঙ্গে সংযুক্ত চ্যালেঞ্জের সমাধান ভারতের পাশেই আছে বলে তিনি দাবি করেছেন। এক ধরতি, এক পরিবার এবং এক ভবিষ্যতের থিম রাখা হয়েছে ভারতের পক্ষ থেকে, জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। 


২০২৩ সালে জি-২০ দেশগুলির বার্ষিক বৈঠক হবে ভারতে। আগামী বছর ভারতের সভাপতিত্ব করার বিষয়টি নিয়ে এদিন থেকেই প্রধানমন্ত্রী এক নতুন ধরনের জাতীয়তাবাদের প্রচার শুরু করলেন বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। প্রধানমন্ত্রী রবিবার বলেন, জি-২০ হলো বিশ্ব জনসংখ্যার দুই-তৃতীয়াং, বিশ্ব বাণিজ্যের তিন-চতুর্থাংশ এবং বিশ্ব জিডিপি’র ৮৫ শতাংশ। এরপরেই পরিচিত নাটকীয় ভঙ্গিমায় বলেন, ‘আপনারা কল্পনা করতে পারছেন আজ থেকে ঠিক তিন দিন পরে অর্থাৎ পয়লা ডিসেম্বর থেকে এত বড় গোষ্ঠীর এবং এত সামর্থ্যবান শক্তির সভাপতিত্ব করতে যাচ্ছে ভারত!’ বিশ্লেষকদের মতে, প্রধানমন্ত্রী এমন একটা ধারণা তৈরি করতে চাইলেন, যেন জি-২০’র সভাপতিত্ব পেয়ে ভারত বিশ্বের তাবড় দেশের নেতা হয়ে উঠল। অনেকেই মনে করছেন, ভারত (আসলে নরেন্দ্র মোদী) ‘বিশ্বগুরু’ হতে চলেছে বলে যে প্রচার নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর থেকে হিন্দুত্ববাদীরা লাগাতার করে এসেছে, জি-২০ নিয়ে এই ধারণা তৈরির চেষ্টাও সেই লক্ষ্যেই বলে মনে করা হচ্ছে। এরমধ্যেই কেউ কেউ প্রধানমন্ত্রীর ঢক্কানিনাদের ফানুস ফুটো করে দেওয়ার চেষ্টায় মনে করিয়ে দিয়েছেন, ভারতের ঠিক আগেই অর্থাৎ এ দিন পর্যন্ত জি-২০’র সভাপতিত্ব করছে ইন্দোনেশিয়ার মতো একটি ছোট্ট দেশ। 


বস্তুত জি-২০’র সভাপতিত্ব পাওয়া নিয়ে মোদী যে বিরাট ধারণা তৈরি করতে চলেছেন, আদপে বিষয়টি মোটেই তেমন নয়। আর্জেন্টিনা, অস্ট্রেলিয়া,, ব্রাজিল,  কানাডা, চীন,  ফ্রান্স, জার্মানি,  ভারত,  ইন্দোনেশিয়া, ইতালি, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, মেক্সিকো, রাশিয়া, সৌদি আরব, দক্ষিণ আফ্রিকা, তুরস্ক, ব্রিটেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র- এই ১৯টি দেশ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন নিয়ে জি-২০। ইউরোপীয় ইউনিয়নকে বাদ দিয়ে বাকি দেশগুলি মোট ৫টি গোষ্ঠীতে বিভক্ত। এর মধ্যে চারটি গোষ্ঠীতে চারটি করে দেশ আছে। ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা এবং মেক্সিকো এই তিনটে দেশ অন্য একটি গোষ্ঠীতে আছে। যে গোষ্ঠীতে ভারত আছে তাতে অন্য দেশগুলি হলো রাশিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা এবং তুরস্ক। প্রতিবছর পৃথক পৃথক গোষ্ঠী থেকে একটি দেশকে সভাপতিত্ব করার জন্য বেছে নেওয়া হয়। ২০১০ সালে এই নীতি গ্রহণ করা হয়। যেবার যে গোষ্ঠীর সুযোগ আসবে, তার আওতাধীন প্রতিটি সদস্য দেশেরই অধিকার আছে সভাপতিত্ব করার। ফলে জি-২০’র সভাপতিত্ব করা আলাদা করে কোনও স্বীকৃতি নয়। মনে রাখা দরকার ১৯ সদস্য দেশের জি-২০’ মধ্যে এখনও পর্যন্ত ১১টি দেশ সভাপতিত্ব করে ফেলেছে। 


তাহলে জি-২০-তে ভারতের সভাপতিত্ব করা নিয়ে নরেন্দ্র মোদী এত উন্মাদনা তৈরি করতে চাইছেন কেন, মোদী এদিন বলেছেন,  দেশের বিভিন্ন প্রান্তে জি-২০ নিয়ে অনেক কর্মসূচি হবে। এদিনই মোদী তেলেঙ্গানাকেও জুড়ে নিয়েছেন জি-২০ নিয়ে। মোদী বলেছেন, তেলেঙ্গানার রাজন্না সির্সিলা জেলার এক তাঁতি ভাই ইয়েলধি হরিপ্রসাদ গারু নিজে হাতে বুনে জি-২০-র একটি লোগো প্রধানমন্ত্রীকে পাঠিয়েছেন। এরপরেই মোদী বলেছেন, তেলেঙ্গানার কোনও একজন তাঁতি জি-২০ নিয়ে এতটা সংযুক্ত হয়ে পড়েছেন দেখে তাঁর খুব ভালো লাগছে। দক্ষিণ ভারতে বিজেপি’র বর্তমান রাজনৈতিক কৌশলেই প্রধানমন্ত্রী তেলেঙ্গানাকে উদাহরণ হিসাবে বেছে নিয়েছেন বলে মনে করা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী আরও দাবি করেছেন,পুনের বাসিন্দা সুব্বা রাও চিল্লারা এবং কলকাতার তুষার জগমোহনও জি-২০ নিয়ে ভারতের ‘প্রোঅ্যাক্টিভ এফোর্ট’ দেখে খুব খুশি হয়েছেন এবং সেই কথা নাকি প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়েছেন। দেশের যুবদের তিনি জি-২০’র সঙ্গে যুক্ত হতে বলেছেন। দেশের যুবদের টি শার্টে জি-২০ লোগো লাগিয়ে এরসঙ্গে যুক্ত হতে বলেছেন। 
বিশ্লেষকদের অভিমত, ২০২৪ সালের শুরুতেই লোকসভা ভোট। তার আগে মোদীকে আর শুধু ভারতের নেতা নয়, বিশ্বের নেতা হিসাবে তুলে ধরার চেষ্টা করছে হিন্দুত্ববাদীরা। সেই লক্ষ্যেই জি-২০-কে সম্পূর্ণ ব্যবহার করার চেষ্টা চলছে। গত লোকসভা ভোটের আগের বছর ২০১৮ সালেও মোদী জোর চেষ্টা চালিয়েছিলেন জি-২০’র সভাপতিত্ব ভারতে আনার জন্য। কিন্তু সেই বার তৃতীয় গোষ্ঠী থেকে সভাপতি হওয়ার কথা ছিল। আর্জেন্টিনা কিছুতেই তাদের দাবি না ছাড়ায় মোদীর আশায় জল পড়ে। এবার সেই সুযোগ আর কোনোভাবেই হাতছাড়া করতে চাইছে না মোদী, বিজেপি। 


প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর থেকে কোভিডের আগে পর্যন্ত মোদী প্রতি বছর সারা দুনিয়া ভ্রমণ করেছেন জনগণের কোটি কোটি টাকা খরচ করে। বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের জড়িয়ে ধরে তাঁর ছবি পরিচিতও হয়ে উঠেছিল সেই সময়ে। এমনকি কোনও কোনও রাষ্ট্রপ্রধানের কাঁধে হাত দিয়ে তাঁর হাঁটার ছবিও ঢালাও প্রচার করেছে মিডিয়া ম্যানেজাররা। রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাত সমাধানে মোদীই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছেন বলে প্রচার চলেছে! এমনকি ইন্দোনেশিয়ার বালিতে সদ্য সমাপ্ত জি-২০ বৈঠকের পরে মার্কিন রাষ্ট্রপতি বাইডেনের সঙ্গে মোদীর আঞ্চলিক এবং বিশ্ব উন্নয়ন নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে বলে বিদেশ মন্ত্রী এস জয়শঙ্কর দাবি করেন। যদিও হোয়াইট হাউসের প্রেস সচিব জানিয়ে দেন, বালিতে রাষ্ট্রপতি বাইডেনের সঙ্গে মোদীর খুবই সামান্য সময়ে দেখা হয়ম, একে অপরকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। কোনও বিশেষ আলোচনা হয়নি! কিন্তু এইসবের পরেও ‘ভারত আবার জগৎ সভায় শ্রেষ্ঠ আসন লবে’র প্রচারে কোনও ঘাটতি পড়বে না বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা। আগামী লোকসভা ভোটের আগে মোদীকে ‘বিশ্বগুরু’ সাজাতেই হবে। জি-২০-র সভাপতিত্ব হবে তার মঞ্চ। এদিনের ‘মন কি বাত’ সে কথাই স্পষ্ট করেছে।  
 

Comments :0

Login to leave a comment