Religious bigotry

ধর্মান্তর নিয়ে ফের জিগির মোদীর

জাতীয়

বড়দিনের সময়ে ফের ধর্মান্তরকরণ নিয়ে সুর চড়ালো হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলি। গত কয়েকদিন ধরে খ্রিস্টানদের উপরে দেশের নানা প্রান্তে আক্রমণের পরপর ঘটনা ঘটেছে। এরমধ্যেই ধর্মীয় বিদ্বেষ এবং জিগির ছড়ানোর দায়িত্ব খোদ নিজের কাঁধে তুলে নিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। অন্যদিকে হিন্দুত্ববাদী উগ্রপন্থায় অভিযুক্ত বিজেপি সাংসদ প্রজ্ঞা সিং ঠাকুরও হাতে অস্ত্র তুলে নেওয়ার নিদান দিয়েছেন। 


শিখ ধর্মীয় কাহিনী অনুযায়ী গুরু গোবিন্দ সিংয়ের দুই শিশু সন্তান জোরাওয়ার এবং ফতেহ সিংকে সিরহিন্দের নবাব ওয়াজির খান হত্যা করে। তাদের তখন বয়স ছিল পাঁচ ও সাত বছর। ১৭০৪ সালের ২৬ ডিসেম্বর এই ঘটনা ঘটে বলে প্রচলিত। শিখদের কাছে এই ঘটনা অতি আবেগপূর্ণ। এমনকি শিশু ফতেহ সিংকেই প্রথম নিহাঙ্গ যোদ্ধা বলে মনে করা হয় শিখ ধর্মে। 


শিখ ধর্মবিশ্বাসীদের এই আবেগকে কাজে লাগাতেই চলতি বছর থেকে ২৬ ডিসেম্বর দিনটি ‘বীর বাল দিবস’ বা ‘বীর শিশু দিবস’ হিসাবে উদ্‌যাপন করা হবে বলে ৯ জানুয়ারি ঘোষণা করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী। সেই মোতাবেক এদিনের অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে মোদী শিখ ধর্মীয় কাহিনীকে ব্যবহার করে মুসলিমদের বিরুদ্ধে এবং ধর্মান্তরকরণ নিয়ে আরএসএসের রাজনীতিকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেছেন। উল্লেখ্য, এবারের বিজয়া দশমীর ভাষণে সঙ্ঘপ্রধান মোহন ভাগবৎ ধর্মান্তরকরণকেই প্রধান বিষয় হিসাবে তুলে ধরে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলি এবং কেন্দ্র-রাজ্যের বিজেপি সরকারগুলির এবারের মুখ্য অ্যাজেন্ডা হতে চলেছে ধর্মান্তরকরণ। 


মুসলিম বিরোধী জিগির তৈরির সময়ে মোদী হামেশাই আওরঙ্গজেবকে নির্বাচন করেন। এদিন সেই সূত্রেই বক্তব্য রাখতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘সেই সময়ের কল্পনা করুন! যখন আওরঙ্গজেবের আতঙ্কের বিরুদ্ধে, ভারতকে ধর্মান্তরিত করার আওরঙ্গজেবের চেষ্টার বিরুদ্ধে, গুরু গোবিন্দ সিংজী পাহাড়ের মতো দাঁড়িয়েছিলেন। জোরাওয়ার এবং ফতেহ সিংয়ের মতো শিশুদের আওরঙ্গজেবের সঙ্গে কোনও শত্রুতা ছিল যে তাদের জীবন্ত দেওয়াল গেঁথে হত্যা করা হয়েছিল?’ প্রশ্নের জবাবও দিয়েছেন খোদ প্রধানমন্ত্রীই, ‘কারণ আওরঙ্গজেব এবং তার লোকেরা গুরু গোবিন্দ সিংয়ের সন্তানদের ধর্ম পরিবর্তন করতে চেয়েছিল তলোয়ারের জোরে। কিন্তু তারা ছিল ভারতের সন্তান। সাহসী সন্তান। তারা মৃত্যুর ভয় পায়নি এবং আওরঙ্গজেবের সন্ত্রাসবাদী পরিকল্পনাকে চিরকালের মতো কবর দিয়েছিল’। 

এরপরেই প্রধানমন্ত্রী মূলত দেশের তরুণ সম্প্রদায়কে তাতাতে বলেছেন, যে রাষ্ট্রের নতুন প্রজন্ম জোর-জুলুমের কাছে নতজানু হয়, তাদের আত্মবিশ্বাস আর ভবিষ্যৎ এমনিতেই মরে যায়। ধর্মান্তরকরণের বিরুদ্ধে তরুণ প্রজন্মকে রুখে দাঁড়ানোর জন্যই কার্যত আকারে-ইঙ্গিতে তিনি আহ্বান জানান। 


প্রধানমন্ত্রী তাঁর বক্তব্যে আগের মতোই ফের বলেছেন, ইতিহাসকে একরৈখিকভাবে এতদিন দেখা হয়েছে। এখন সময় এসেছে তাকে বদলে দেওয়ার। মুঘল শাসনকে মুসলিম এবং বিদেশ হানাদারদের শাসন হিসাবে দেখার আরএসএসের যে ‘ইতিহাস’, তাকেই এদিন ফের একবার নানাভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেছেন, এই সব দেশের মাটিতে মাত্র তিন শতক আগে ঘটেছে। এসব ভুলে যাওয়া যায় না। প্রধানমন্ত্রীর ভাষায়, ‘একদিকে ধর্মীয় কট্টরতা এবং সেই ধর্মীয় কট্টরতায় অন্ধ বিশাল মুঘল সাম্রাজ্যের ক্রূরতা, অন্যদিকে আমাদের গুরুদের তপস্যা। একদিকে বিশাল মুঘল সাম্রাজ্য, অন্যদিকে দুটি শিশুর ধর্মান্তরিত না হওয়ার বলিষ্ঠ প্রত্যয়!’ দুটি পাঁচ-সাত বছরের শিশু মৃত্যুবরণ করব কিন্তু ইসলাম গ্রহণ করব না, এইরকম কথা বলতে পারে কি না, ওই বয়সে তাদের এইরকম উপলব্ধি থাকতে পারে কি না, সেই প্রশ্নের মধ্যে না গিয়েও প্রধানমন্ত্রীর এদিনে বক্তব্যের লক্ষ্য স্পষ্ট। 


এই প্রসঙ্গে কলকাতার বাসিন্দা শিখ ইতিহাসের বিশেষজ্ঞ, প্রবীণ ইতিহাসবিদ জানালেন, ‘ধর্মীয় বিশ্বাস এবং লোকশ্রুতি মানুষের মনের মধ্যে গভীরভাবে প্রোথিত। ঐতিহাসিক উপাদান তার মধ্যে আছে কিনা সেটা তর্ক-বিতর্কের বিষয়। কিন্তু তাতে মানুষের কিছু আসে যায় না। রাজনীতিবিদ্‌রা মানুষের সেই বিশ্বাসকে ব্যবহার করে অন্য ধর্মের বিরুদ্ধে জিগির তৈরির চেষ্টা করছেন।’ ইতিহাসবিদ রত্নাবলী চট্টোপাধ্যায়ের মতে, ‘শিখ এবং মারাঠাদের সঙ্গে মুঘলদের সংঘাত অনেকাংশেই আর্থ-সামাজিক কারণে ছিল, ধর্মীয় কারণ তত গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। কিন্তু বর্তমান সরকারের লক্ষ্যই হচ্ছে ‘মিথ’কে ইতিহাস বলে চালানো। ইতিহাসে যা ঘটে গেছে তাকে আমরা বদল করতে পারি না। কিন্তু ইতিহাসে যদি কিছু অন্যায় হয়ে থাকে, বর্তমানে সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি বা তার পালটা করার উসকানি দেওয়া তার থেকেও বড় অন্যায়।’ 


প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে সিপিআই (এম) পাঞ্জাব রাজ্য কমিটির সম্পাদক সুখবিন্দর সিং সেখু বলেছেন, আরএসএস বহুদিন ধরেই শিখদের মধ্যে প্রভাব বিস্তার করতে চাইছে। আরএসএস দাবি করে শিখ ধর্ম বলে পৃথক কিছু নেই সেটা হিন্দু ধর্মেরই একটা অংশ। সেই লক্ষ্যেই নানা ধরনের কৌশল নিয়ে চলেছে। অথচ আরএসএসের যে লক্ষ্য তা শিখ ধর্মের মূল নীতির বিরোধী। দেশের বড় বড় গুরুদ্বারগুলোর দখল নিয়েছে বা নেওয়ার চেষ্টা করছে আরএসএস-বিজেপি। শিখ ধর্মের উগ্র অংশকে কাছে টানার চেষ্টা করছে আরএসএস। প্রধানমন্ত্রীর এদিনের বক্তব্যও সেই লক্ষ্যেই। শিখ ধর্মের ইতিহাস এবং বিশ্বাসকে ব্যবহার করে মুসলিমদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়ানোর কাজ করেছেন প্রধানমন্ত্রী। 


প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য যে কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, তার প্রমাণ রয়েছে একাধিক ঘটনায়। ধর্মান্তরকরণের নাম করে বড়দিনের সময়ে দেশের নানা প্রান্তে আক্রমণ করা হয়েছে খ্রিস্টানদের উপরে। উত্তর প্রদেশের রামপুরে দুই ব্যক্তিকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে এই অভিযোগে, তারা তফসিলি জাতির লোকেদের খ্রিস্ট ধর্মে ধর্মান্তরিত করার জন্য প্রলুব্ধ করছিল। শুক্রবারই মুখ্যমন্ত্রী আদিত্যনাথ এক নির্দেশে বলেছিলেন বড়দিনের অনুষ্ঠানে যাতে জোর করে ধর্মান্তরকরণ করা না হয় সেটা দেখার জন্য। 

একইভাবে বড়দিনের আগেই উত্তরাখণ্ডে খ্রিস্টান মিশনারিদের বিরুদ্ধে এফআইআর হয়েছে। ছত্তিশগড়ে লাগাতার হামলা চলছে দলিত-আদিবাসী খ্রিস্টানদের ওপরে। একইসঙ্গে মধ্য প্রদেশেও বড়দিন উপলক্ষে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ স্কুলগুলিকে হুমকি দিয়ে জানিয়েছে শিশুদের সান্তা সাজা চলবে না। রবিবার কর্ণাটকের শিবমোগায় ‘হিন্দু জাগরণ বেদীকে’ নামে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের এক শাখা সংগঠনের সম্মেলনে প্রজ্ঞা ঠাকুর বলেছেন, বাড়িতে অস্ত্র রাখুন। যদি কিছু না থাকে, তাহলে নিদেনপক্ষে সবজি কাটার ছুরিই শাণ দিয়ে রাখুন। কখন, কী পরিস্থিতি তৈরি হবে, তা (আমরা) জানি না। প্রত্যেকেরই আত্মরক্ষার অধিকার আছে।... সব অত্যাচারী এবং পাপীদের শেষ করে দিন। নিজের মেয়েদের রক্ষা করুন এবং তাদের সঠিক মূল্যবোধে শিক্ষিত করে তুলুন।’
 

Comments :0

Login to leave a comment