Post Editorial

বিদ্যাসাগরের শিক্ষাচিন্তা, আজকের আশঙ্কা

উত্তর সম্পাদকীয়​

নিলয়কুমার সাহা


 

১৮৪১ খ্রিস্টাব্দের ২৯ ডিসেম্বর মাত্র একুশ বছর বয়সে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মাসিক পঞ্চাশ টাকা বেতনে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের বাংলা বিভাগে সেরেস্তাদারের পদে যোগ দান করেন। কর্মরত অবস্থায় ঈশ্বরচন্দ্র ১৮৪৪ খ্রিস্টাব্দে সংস্কৃত কলেজে ব্যাকারণের প্রথম শ্রেণির পণ্ডিতের পদে এবং ১৮৪৬ খ্রিস্টাব্দে সংস্কৃত কলেজে সাহিত্য শ্রেণির অধ্যাপক পদে যোগদানের লোভনীয় প্রস্তাব গ্রহণ না করে উল্লিখিত দুটি পদেই তিনি যথাক্রমে তারকনাথ তর্কবাচস্পতি এবং মদনমোহন তর্কালঙ্কারের নাম সুপারিশ করেছিলেন। যদিও এই ঘটনার কিছুকাল পর ১৮৪৬ খ্রিস্টাব্দের ৬ এপ্রিল বিদ্যাসাগর মাসিক পঞ্চাশ টাকা বেতনে সংস্কৃত কলেজে সহকারী সম্পাদকের পদে যোগ দেন। বিদ্যাসাগর মহাশয় কেন প্রায় দ্বিগুণ মাসিক বেতনের শিক্ষকতার প্রস্তাব গ্রহণ না করে পাঁচ বছর পর সেরেস্তাদারের কাজ ছেড়ে সমবেতনের সহকারী সম্পাদকের পদে যোগ দিয়েছেলেন, সেই প্রশ্নের উত্তরে তাঁর লিখিত বক্তব্য তাৎপর্যপূর্ণ। বিদ্যাসাগর লিখেছেন, “ইংরেজি ১৮৪৬ সালে, পূজ্যপাদ জয়গোপাল তর্কালঙ্কার মহাশয়ের লোকান্তর প্রাপ্তি হইলে, সংস্কৃত কলেজে সাহিত্য শাস্ত্রের অধ্যাপকের পদ শূন্য হয়। সেক্রেটারি বাবু রসময় দত্ত মহাশয় আমাকে ঐ পদে নিযুক্ত করিবেন, স্থির করিয়াছিলেন। আমি, বিশিষ্ট হেতুবশতঃ, অধ্যাপকের পদ গ্রহণে অসম্মত হইয়া, মদনমোহন তর্কালঙ্কারকে নিযুক্ত করিবার নিমিত্ত, সবিশেষ অনুরোধ করি।” ‘বিশিষ্ট হেতুবশতঃ’ সংস্কৃত কলেজে অধ্যাপকের পদ গ্রহণে অসম্মত হওয়া এবং ওই একই প্রতিষ্ঠানে অপেক্ষাকৃত কম মর্যাদার সহকারী সম্পাদকের পদে যোগদানের সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে ঈশ্বরচন্দ্রের শিক্ষা প্রশাসক সত্ত্বারই আত্মপ্রকাশ ঘটেছে। সম্ভবত পরাধীন দেশে শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কার এবং প্রসারের কাজকেই তিনি অধিক প্রাধান্য দিয়েছিলেন বলেই বিদ্যাসাগর শিক্ষা দান অপেক্ষা শিক্ষা প্রশাসনের আঙ্গিনায় নিজেকে নিয়োজিত করতে চেয়েছিলেন।

শিক্ষা সংস্কার বিষয়ক প্রথম প্রস্তাব ও স্বপ্ন ভঙ্গ 

প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থার আমূল সংস্কারের সংকল্প নিয়ে সংস্কৃত কলেজে সহকারী সম্পাদকের পদে যোগদানের মাত্র পাঁচ মাসের মধ্যেই ১৮৪৬ খ্রিস্টাব্দের ১৯ সেপ্টেম্বর ঈশ্বরচন্দ্র কলেজ শিক্ষা সংসদের কাছে প্রতিষ্ঠানের শিক্ষা সংস্কার বিষয়ক এক সুপরিকল্পিত দলিল দাখিল করেন। বিদ্যাসাগরের প্রস্তাবিত শিক্ষা সংস্কার বিষয়ক পরিকল্পনা সম্পর্কে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের সেক্রেটারি মার্শাল সাহেব আগে থেকেই অবগত ছিলেন কারণ বিদ্যাসাগর মার্শাল সাহেবের সাথে মত বিনিময় করেই এই দলিল প্রস্তুত করেছিলেন। এই দলিল সম্পর্কে মার্শাল সাহেব উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে বলেছিলেন, “বিপুল সময় এবং শ্রমের বিনিময়ে সহকারী সম্পাদক শিক্ষা বিষয়ক যে পরিকল্পনা প্রস্তুত করিয়াছেন, সেই বিষয়ে তিনি পূর্বে আমার সাথে মত বিনিময় করিয়াছিলেন। এই পরিকল্পনায় যে সকল পরামর্শ উপস্থাপিত হইয়াছে আমার মতে সে সকল অত্যন্ত ন্যায় বিচারপূরণ এবং এই পরিকল্পনা শৃঙ্খলা তৈরি করতে, সময় বাঁচাতে, সর্বোপরি প্রতিটি বিষয়ের প্রতি কাম্য মনোযোগ সুনিশ্চিত করতে প্রস্তুত হইয়াছে। আমি সঙ্গত কারণে খুব দৃঢ়তার সহিত সংসদকে পরীক্ষামূলকভাবে এই পরিকল্পনাকে কার্যকর করিতে অনুরোধ জানাইতেছি। আমার যদি খুব ভুল না হইয়া থাকে, তবে এই পরিকল্পনার ফল অত্যন্ত সন্তোষজনক হইবে।” কিন্তু পরিতাপের বিষয় সংস্কৃত কলেজের তদানীন্তন প্রভাবশালী সম্পাদক রসময় দত্ত ঈশ্বরচন্দ্রের প্রতি সদয় ছিলেন না এবং তীব্র উন্নাসিক দত্ত মহাশয়ের ইচ্ছানুসারে ঈশ্বরচন্দ্রের প্রস্তাব সংসদে সঠিকভাবে উপস্থাপিত না হওয়ার কারণে তীব্র আত্মমর্যাদা এবং বলিষ্ঠ চরিত্রের অধিকারী ঈশ্বরচন্দ্র নিজেকে কলেজ পরিচালন ব্যবস্থা থেকে সরিয়ে নেওয়ার সংকল্প নিয়ে ১৮৪৭ খ্রিস্টাব্দে শিক্ষা সংসদের সম্পাদক ময়েট সাহেবের কাছে পদত্যাগ পত্র পেশ করেন। পদত্যাগ পত্র পেশের তিন মাস পর অর্থাৎ ১৮৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৬ জুলাই বিদ্যাসাগরের পদত্যাগ পত্র গৃহীত হয়।

শিক্ষা প্রশাসক ও সংস্কারক রূপে আত্মপ্রকাশ 

সংস্কৃত কলেজের পাট চুকিয়ে ১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দের ১ মার্চ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের রাইটার ও কোষাধ্যক্ষের পদে যোগদান করেন। ইতিমধ্যে ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দে সংস্কৃত কলেজের সাহিত্যের অধ্যাপক মদনমোহন তর্কালঙ্কার ইস্তফা দেওয়ায় শিক্ষা সংসদের সম্পাদক ময়েট সাহেব ওই শূন্য পদে পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে যোগদানের বিশেষ অনুরোধ জানালে বিদ্যাসাগর তাঁর ইচ্ছার কথা ব্যক্ত করে বলেন, শিক্ষকতা নয়, শিক্ষার সংস্কারই তাঁর প্রধান লক্ষ্য। শিক্ষা সংস্কার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ বিদ্যাসাগর ময়েট সাহেবকে প্রস্তাব দেন যদি সংস্কৃত কলেজ তাঁকে কলেজের অধ্যক্ষের পদে নিয়োগ করে তবেই তিনি সংস্কৃত কলেজে ফিরবেন, অন্যথায় নয়। সেই সময় সংস্কৃত কলেজে অধ্যক্ষের কোনও পদ ছিল না। বিদ্যাসাগরের প্রস্তাবে সম্মত হয়ে ময়েট সাহেব তাঁকে অনুরোধ করেন যতদিন না পর্যন্ত অধ্যক্ষের পদ সৃষ্টি হচ্ছে; ততদিন সাহিত্যশাস্ত্রের অধ্যাপক পদে কাজ চালিয়ে যেতে। ময়েট সাহেবের অনুরোধে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দের ৪ ডিসেম্বর ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের রাইটার ও কোষাধ্যক্ষের পদে ইস্তফা দিয়ে পরদিন অর্থাৎ ৫ ডিসেম্বর সংস্কৃত কলেজে সাহিত্যশাস্ত্রের অধ্যাপক পদে যোগ দেন। বিদ্যাসাগর পুনরায় সংস্কৃত কলেজে যোগদানের মাসেই কলেজের সম্পাদকের পদ থেকে রসময় দত্ত পদত্যাগ করেন। পরবর্তী সময়ে ব্রিটিশ গভর্নমেন্ট শিক্ষা সংসদের সুপারিশ এবং প্রস্তাব গ্রহণ করায় ১৮৫১ খ্রিস্টাব্দের ২২ জানুয়ারি পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মাসিক ১৫০ টাকা বেতনে সংস্কৃত কলেজের প্রথম অধ্যক্ষ পদে আসীন হন। 

অধ্যক্ষ পদে আসীন হয়ে ছ’মাসের মধ্যেই প্রশাসক বিদ্যাসাগর সংস্কারমূলক একাধিক যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। জন্মলগ্ন থেকে সংস্কৃত কলেজে কেবলমাত্র ব্রাহ্মণ ও বৈদ্য সম্প্রদায়ভুক্ত সন্তানেরা পঠন-পাঠনের সুযোগ পেতেন। জাত-পাতের বেড়াজাল চূর্ণ করে ১৮৫১ খ্রিস্টাব্দের ৯ জুলাই সংস্কৃত কলেজের ভর্তি সংক্রান্ত নির্দেশিকায় ঘোষিত হয়, “যে কোনও সম্ভ্রান্ত হিন্দু সন্তান সংস্কৃত কলেজে ভর্তি হতে পারবে।”  বিদ্যাসাগর যখন অধ্যক্ষ পদে যোগ দেন তখন সংস্কৃত কলেজ অষ্টমী ও প্রতিপদ তিথিতে বন্ধ থাকত। ১৮৫১ খ্রিস্টাব্দের ২৬ জুলাই থেকে বিদ্যাসাগর নিয়ম করলেনে, অষ্টমী ও প্রতিপদে নয়, কেবলমাত্র রবিবার সংস্কৃত কলেজ বন্ধ থাকবে। প্রশাসক বিদ্যাসাগর সংস্কৃত কলেজে অবৈতনিক শিক্ষাক্রমে ছাত্রদের দীর্ঘকালীন ধারাবাহিক অনুপস্থিতির বিষয়টি লক্ষ্য করণে এবং ছাত্রদের সুশৃঙ্খল করতেই তিনি ১৮৫২ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট মাস থেকে সংস্কৃত কলেজে বৈতনিক শিক্ষাক্রমের সূচনা করেন। সংস্কৃত কলেজে ভর্তির ফি ধার্য হয় দু’টাকা এবং একবার নাম কাটা গেলে পুনরায় নাম অন্তর্ভুক্তির ফি ও নির্ধারিত হয়েছিল দু’টাকা। ছাত্রদরদি বিদ্যাসাগর লক্ষ্য করেন হিন্দু কলেজ এবং মাদ্রাসার কৃতবিদ্য ছাত্ররা ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট পদে যোগদানের সুযোগ পেলেও সংস্কৃত কলেজের ছাত্ররা সেই সুযোগ পেত না। এই বৈষম্য নিরসনে অপরাজেয় পৌরুষের অধিকারী বিদ্যাসাগর ১৮৫২ খ্রিস্টাব্দের ১৩ জানুয়ারি কাউন্সিল অব এডুকেশনের সেক্রেটারিকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের অনুরোধ জানান। তিনি তাঁর বক্তব্যে হিন্দু কলেজ, মাদ্রাসা এবং সংস্কৃত কলেজের ছাত্রদের দক্ষতা বিশ্লেষণের এক নিরপেক্ষ চিত্র তুলে ধরেছিলেন। ছাত্রদরদি এক প্রশাসকের আবেদনে সাড়া দিয়ে কর্তৃপক্ষ সংস্কৃত কলেজের ছাত্রদের জন্য ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রটের পদ উন্মুক্ত করেছিল। নারীশিক্ষা প্রসারে পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কৌশলগত কারণেই শাস্ত্রের আশ্রয় নিয়েছিলেন। শিক্ষা সংসদের সভাপতি জন এলিয়ট ড্রিঙ্কওয়াটার বেথুন প্রতিষ্ঠিত কলকাতার প্রথম মহিলা বিদ্যালয় ‘ক্যালকাটা ফিমেল স্কুল’এর অবৈতনিক সম্পাদক পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বহুদূর থেকে মেয়েদের বিদ্যালয়ে আনার ঘোড়ার গাড়ির গায়ে অত্যন্ত সচেতনভাবে তুলে ধরেছিলেন শাস্ত্রের বচন – ‘কন্যাপ্যেবং পালনীয়া শিক্ষাণীয়াতিযত্নতঃ’ অর্থাৎ কন্যাকে সযত্নে পালন ও শিক্ষাদান শাস্ত্রের বিধান। নারীশিক্ষার পাশাপাশি শিক্ষাদানে অপরিহার্য যোগ্য শিক্ষকের অভাব মেটানোর উদ্দেশ্যে বিদ্যাসাগর শিক্ষক প্রশিক্ষণ স্কুল বা নর্মাল স্কুল স্থাপনে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেছিলেন। সংস্কৃত কলেজে পুনরায় যোগদানের পরেই শিক্ষা সংসদ ঈশ্বরচন্দ্রকে ‘শিক্ষা সংস্কার পরিকল্পনা’ রচনা করতে অনুরোধ করলে, সেই অনুরোধে সাড়া দিয়ে তিনি ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দের ১৬ ডিসেম্বর সংসদে উপস্থাপন করেন ‘শিক্ষা সংস্কার পরিকল্পনা’। বিদ্যাসাগর নিজেই এই পরিকল্পনাটিকে ‘গভীর চিন্তা ও বিবেচনা প্রসূত’ বলে মন্তব্য করেছিলেন। শিক্ষা সংস্কার সংক্রান্ত বিদ্যাসাগরের যাবতীয় পরিকল্পনার বিস্তারিত বিবরণ আমরা পাই ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দের ১২ এপ্রিল তাঁর নিজের হাতে লেখা ‘নোটস অন দি সংস্কৃত কলেজ’ শীর্ষক প্রতিবেদনে। এই প্রতিবেদনটি আজও ভারতীয় শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কার এবং প্রসারের এক চলমান সহায়িকা।

আলো-আঁধারে বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থা 

সারা দেশ সহ আমাদের রাজ্যে কার্যকর হয়েছে ‘জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০’। প্রস্তাবিত এই শিক্ষানীতি সরকারি ব্যয়ে পরিচালিত শিক্ষা ব্যবস্থা সঙ্কোচনের পাশাপাশি দেশের শিক্ষাক্রমে বেসরকারি উদ্যোগপতিদের উদাত্ত কণ্ঠে আহ্বান জানিয়েছে। ‘ভারতীয় জ্ঞান ভাণ্ডার’-এর প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের অছিলায় এই শিক্ষানীতি বিজ্ঞান নির্ভর পাঠক্রমের অবলুপ্তি ঘটিয়ে ভারতীয় বহুত্ববাদের উপর আঘাত হেনেছে। কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকারের যৌথ উদ্যোগ দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার বেসরকারিকরণের আবহে প্রায় আড়াইশো বছর আগের ঈশ্বরচন্দ্র  বিদ্যাসাগরের শিক্ষা বিষয়ক প্রস্তাব অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। অদম্য ইচ্ছাশক্তি, ব্যক্তিগত উদ্যোগ এবং নিজস্ব অর্থ ব্যয়ে শিক্ষা ব্যবস্থার প্রসার ও সংস্কারে কালজয়ী পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও বিদ্যাসাগর মহাশয়ও অনুভব করেছিলেন সরকারি অনুদান ব্যতীত দীর্ঘকাল এই কাজ পরিচালনা করা সম্ভব নয়। বালিকা বিদ্যালয় স্থাপনে সরকারি সাহায্যের নিশ্চয়তা বিদ্যাসাগরকে অধিক উৎসাহী করে তুলেছিল এবং এই উৎসাহের ফলশ্রুতিতে বিদ্যাসাগর মহাশয় ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাস থেকে ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দের মে মাস পর্যন্ত বাংলায় পঁয়ত্রিশটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে নারীশিক্ষা প্রসারে হঠাৎই সরকারি অনুদানের অনিশ্চয়তা বিদ্যাসাগর মহাশয়কে কেবল হতোদ্যম করেনি, ঠেলে দিয়েছিল চরম সঙ্কটের মুখে। বর্তমান সময়ে কেন্দ্রীয় সরকার সারা দেশে ‘জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০’র মাধ্যমে প্রাথমিক স্তর থেকে বিশ্ববিদ্যালয় স্তর পর্যন্ত শিক্ষা ব্যবস্থার কাঠামোগত আমূল পরিবর্তন কার্যকর করার পরিকল্পনা গ্রহণ করলেও প্রয়োজনীয় অর্থ সংস্থানের বিষয়ে কোনও প্রকার দিক নির্দেশ করেনি। কেন্দ্রীয় সরকারের গৃহীত এই নীতি অচিরেই সরকার পোষিত শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্কোচনের পাশাপাশি শিক্ষাক্ষেত্রে বেসরকারি উদ্যোগের লাগামহীন প্রসারে দেশীয় শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধনীর একচেটিয়া সম্পদে পরিণত করবে। বিদ্যাসাগর তাঁর শিক্ষা সংস্কার বিষয়ক প্রস্তাবে সাংখ্য ও বেদান্তকে ভ্রান্ত দর্শন হিসাবে বর্ণনা করে এই দুই শাস্ত্র পাঠের প্রতিষেধক স্বরূপ ছাত্রদের ইংরেজি ভাষায় উৎকৃষ্ট দর্শনশাস্ত্র পড়ার সুপারিশ করেছিলেন। সমৃদ্ধ এবং উন্নত বাংলা সাহিত্য সৃষ্টির লক্ষ্যে বিদ্যাসাগর সংস্কৃত ভাষায় পারদর্শী পণ্ডিতদের ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে সুশিক্ষার প্রয়োজনীয়তার কথা ব্যক্ত করেছিলেন। সংস্কৃত গণিতের তীব্র বিরোধিতা করে বিদ্যাসাগর ইংরেজি মাধ্যমে গণিতবিদ্যা শিক্ষার প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করেছিলেন। শিক্ষা ব্যবস্থার প্রয়োজনে তিনি একাধারে বাংলা, সংস্কৃত এবং ইংরেজি ভাষার প্রসারের কথা উল্লেখ করলেও বর্তমান সময়ের শিক্ষানীতি বহুক্ষেত্রেই রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডা রূপায়ণের হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। সর্বোপরি দেশীয় শিক্ষা বিস্তারে বিদ্যাসাগর সরকারি আর্থিক আনুকূল্যের উপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করেলেও, আজকের শিক্ষানীতিতে সেই বিষয়টি সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষিত যা দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে নিশ্চিত বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দেবে।

Comments :0

Login to leave a comment