Israel Palestine War

শুধু কি মার খাবে আর কাঁদবে?

আন্তর্জাতিক উত্তর সম্পাদকীয়​

দেবাশিস চক্রবর্তী 
 

বিশ্বের সবচেয়ে বড় খোলা জেলখানার নাম গাজা। গাজা স্ট্রিপ। সেখানে ২৩ লক্ষ মানুষ থাকেন, যাঁদের সম্পর্কে ইজরায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ইয়োভা গ্যালান্ট বললেন, ‘পশু’। বাস্তবেই মানবেতর জীবন তাঁদের। চারদিকে ইজরায়েল ঘিরে রেখেছে, একদিকে কিছুটা ভূমধ্যসাগর, যেখানে মাত্র তিন মাইল পর্যন্ত তাদের যেতে দেওয়া হয়। ১৯৬৭ থেকে ইজরায়েলের সরাসরি দখলে থাকা গাজা থেকে ২০০৫-এ ইজরায়েলীরা সেনা সরিয়ে নেয়। কিন্তু গাজার মানুষ স্বদেশেই কোথাও যেতে পারেন না, তাঁদের বিদ্যুৎ আসে ইজরায়েলের খেয়ালে, রাষ্ট্রসঙ্ঘের হিসেবে যে জল তাঁরা পান করেন তার ৯৬শতাংশ মানুষের পানের অযোগ্য। আকাশপথ ইজরায়েলের কবলে। ২০০৮ থেকে চার বার ইজরায়েল সামরিক অভিযান চালিয়েছে, একবার ৫১ দিনের জন্য। হাজার হাজার মানুষ মারা গেছেন, শত শত বাড়ি মাটিতে মিশে গেছে। গাজার শিশুরাও জানে মায়ের আদর বেশিদিন তাদের জন্য নয়। 
গাজাকে নাকি ‘পূর্ণ অবরুদ্ধ’ করে খাদ্য বন্ধ করে দিয়েছে ইজরায়েল। এ কি নতুন নাকি? ইজরায়েলের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী অ্যারিয়েল শ্যারন দাবি করতেন, গাজার মানুষকে তিনি ‘ডায়েট’ মেনে চলতে বাধ্য করেছেন। সেই ‘ডায়েট’ চলছেই, ৬৪ শতাংশ পরিবারের কোনো খাদ্য সুরক্ষা নেই। 


ছেড়ে দিন গাজার কথা। ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে ইজরায়েলের দখলদারি এমনই যে গোটা ভূখণ্ডকে তারাই ২২৪টি ঘেটোয় ভাগ করে রেখেছে, একটির সঙ্গে আরেকটির কোনো যোগাযোগ অসম্ভব। ৫৬০টি ইজরায়েলী চেক পয়েন্ট আছে ওয়েস্ট ব্যাঙ্কের ভেতরেই। ওয়েস্ট ব্যাঙ্কের মধ্যে চলছে বেআইনি বসতি স্থাপন, দীর্ঘদিন ধরেই কিন্তু এখন ঝড়ের গতিতে। নতুন করে জমি দখল করে ওয়েস্ট ব্যাঙ্কের জলের উৎস সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে সেখানে। পশ্চিমী সংবাদমাধ্যম যা কখনও জানাবে না— প্যালেস্তিনীয়দের অঞ্চলে জলের কুয়োয় কংক্রিট ঢেলে দেওয়া হচ্ছে। শুধু এ বছরেই ইজরায়েলের সেনারা ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে, জেনিনে ২৪৮ জন প্যালেস্তিনীয়কে হত্যা করেছে। 
প্যালেস্তাইনে ইজরায়েলের দখলদারির শুরু এই রাষ্ট্রটি গঠনের দিন থেকেই। ইউরোপে ইহুদিদের বিরুদ্ধে অত্যাচারের ফল ভুগছে ইউরোপ নয়, আরবভূমি। ১৯৬৭ থেকে প্যালেস্তাইনের বিস্তীর্ণ অঞ্চল সরাসরি দখল করে নেয় ইজরায়েল। তা বাড়তে থাকে। এই মূহূর্তে ৭ লক্ষ মানুষ ইজরায়েলের তৈরি করা এই বেআইনি বসতিতে থাকে। জমি প্যালেস্তিনীয়দের, তা দখল করে বানানো হচ্ছে আবাসন এবং প্যালেস্তিনীয়রা চলে যাচ্ছেন শরণার্থী শিবিরে। জেরুজালেম থেকে জর্ডান সীমান্তে ইজরায়েলের মানচিত্রের নিচে সমাধিতে শুয়ে আছে প্যালেস্তাইন। ছিটমহলের মতো তিন ভগ্নাংশ- গাজা, ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক, গোলান হাইটস। ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু রাষ্ট্রসঙ্ঘে গিয়ে ইজরায়েলের যে মানচিত্র দেখালেন তাতে এই তিন ভূখণ্ডও অন্তর্ভুক্ত। আন্তর্জাতিক মহলের নিন্দা তো কেউ শুনলো না, কেউ আঙ্গুল তুললো না। এ যদি আন্তর্জাতিক কূটনীতির ভাষায় ‘অকুপেশন’ না হয় তো কী? এ যদি উপনিবেশ না হয় তো কী নামে ডাকা হবে? 


প্যালেস্তিনীয়রা তাদের পূর্ণাঙ্গ ভূমি বলতে বোঝেন ‘নদী থেকে সমুদ্র’। উত্তরে লেবানন সীমান্ত থেকে দক্ষিণে গালফ অফ আকাবা। সেটি মনের মধ্যে রয়েছে, ইতিহাসের পৃষ্ঠায়।  ১৯৪৭-এর ২৯ নভেম্বরে রাষ্ট্রসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদ সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে প্যালেস্তাইনকে যখন দু’ভাগ করে তখনও যে মানচিত্র ছিল, আজ তা নেই। ১৯৬৭-র যুদ্ধের পরে প্যালেস্তাইনের বিরাট অংশই দখল করে নেয় ইজরায়েল। সেই মানচিত্রও আজ নেই। দখলদারি বাড়তে বাড়তে প্যালেস্তাইন এখন টুকরো কয়েকটি স্থলভূমি, যাদের মধ্যে যাতায়াতে ইজরায়েলী নিষেধ, বিশাল পাঁচিলে কাঁটাতারে ঘেরা, ইজরায়েলী সামরিক বা অসামরিক প্রশাসনের অধীন। ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক যে ‘সেনা দখলীকৃত এলাকা’ তা আন্তর্জাতিক বিচারালয়ের রায়েও বলা রয়েছে। এমনকি ইজরায়েলের সুপ্রিম কোর্টও তা-ই মনে করে। আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে ইজরায়েল বেআইনি বসতি স্থাপন করেই চলেছে। রাষ্ট্রসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদ বারংবার এই বসতি স্থাপনকে ‘নির্লজ্জ আইন লঙ্ঘন’ বলে চিহ্নিত করলেও ইজরায়েল পাত্তা দেয়নি। ওয়েস্ট ব্যাঙ্কের ইজরায়েলী বসতির বাসিন্দারা ইজরায়েলের আইনের অধীন, ইজরায়েলী সংসদে ভোটও দেন। কিন্তু প্যালেস্তিনীয়রা সামরিক শাসনের অধীন, তাঁদের কোনো নাগরিক অধিকার নেই। গাজা সরাসরি ইজরায়েলী সামরিক নিয়ন্ত্রণে ছিল ২০০৫ পর্যন্ত। লাগাতার আন্তর্জাতিক চাপ এবং প্যালেস্তিনীয়দের লড়াইয়ের মুখে তারা সরে যায়। কিন্তু আন্তর্জাতিক ভাবে গাজাকে ‘দখলীকৃত এলাকা’ বলে স্বীকৃতি দেওয়া হয় কেননা গাজাকে চারদিক থেকে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে। গাজার মানুষের চলাফেরা নিয়ন্ত্রিত, আকাশপথ ইজরায়েলের দখলে। 


কেউ কি দেখেছে? রাষ্ট্রসঙ্ঘের কোনো প্রস্তাব কি কার্যকর হয়েছে? মিশরের সঙ্গে ইজরায়েলের শান্তি চুক্তি হয়েছে, ধরে নেওয়া হয়েছিল তা বৃহত্তর আঞ্চলিক চুক্তির পথ করে দেবে। প্যালেস্তাইন প্রশ্নকে এড়িয়েই যাওয়া হয়েছে। তথাকথিত ‘আব্রাহামিক চুক্তি’ আরব দেশগুলির সঙ্গে ইজরায়েলের সম্পর্ক তৈরি করার রাস্তা করেছে। মরক্কোকে দিয়ে দেওয়া হয়েছে পশ্চিম সাহারা, সুদানকে মার্কিনী ‘সন্ত্রাসবাদী’ তালিকা থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে, সংযুক্ত আরব আমিরশাহী, বাহরিন ইজরায়েলে বিনিয়োগ করেছে, বিনিময়ে অস্ত্রও পেয়েছে। এরা ইজরায়েলের সার্বভৌমত্ব স্বীকার করে নিয়েছে। কিন্তু প্যালেস্তাইন বাদ থেকেই গেছে। দুই রাষ্ট্রের অস্তিত্বের সূত্রকে ইজরায়েল গোড়াতেই খতম করে দিয়েছে। এমনকি যে হামাস ইজরায়েলের অস্তিত্বকে অবৈধ বলে মতাদর্শগত ভাবে মনে করে তারাও ১৯৬৭-র ৪ জুনের সীমানা মেনে নিয়েছিল, তারা জেরুজালেমকে প্যালেস্তাইনের রাজধানী হিসাবে চায়। ১৯৪৭-এ কিন্তু বলা হয়েছিল জেরুজালেম পৃথক অঞ্চল হিসাবে থাকবে। এখন সেখানে পূর্ণ দখলদারি ইজরায়েলের। এমনকি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি সত্ত্বেও পূর্ব জেরুজালেম প্যালেস্তাইনের হাত থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছে। ইজরায়েল এইসব একা করেনি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমী মিত্রদের নিয়ে আরবদের ওপরে বুলডোজার চালানো হয়েছে। অর্থাৎ, তথাকথিত ‘বাস্তব’ সমাধানের কোনো রাস্তাও খোলা রাখেনি ইজরায়েল। লক্ষণীয়, ২০১৪ সালের পরে ইজরায়েল প্যালেস্তাইনের কোনো স্বীকৃত প্রতিনিধি বা নেতার সঙ্গে কথাও বলতে রাজি হয়নি। সাম্প্রতিক সময়ে ইজরায়েলে কট্টর দক্ষিণপন্থী নেতানিয়াহু সরকার আসার পর জায়নবাদীদের বহু কালের লক্ষ্য ‘এক রাষ্ট্র’ বাস্তবায়িত হতে চলেছে। সেই জন্যই ইজরায়েল এতকাল ধরে যুদ্ধ চালিয়ে গেছে, স্থায়ী যুদ্ধ। 
তাহলে প্যালেস্তিনীয়রা কী করবেন? অক্টোবরের সংঘাতের অনেক আগেই ইজরায়েলের অর্থমন্ত্রী বেজালেল ইয়োলেল স্মোতরিচ এর উত্তর দিয়েছেন: ‘তিনটি বিকল্প, অন্য দেশে চলে যাও, থাকতে চাইলে ইজরায়েলের অধীনে থাকো, অথবা মরো।’ ইতিমধ্যেই হাজার হাজার প্যালেস্তিনীয় বিশ্বের নানা জায়গায় শরণার্থী শিবিরে থাকেন, প্যালেস্তাইন আরব-মুক্ত করা হবে। ইজরায়েলের জেলে ৫৩০০ প্যালেস্তিনীয় বন্দি রয়েছেন, ১২৬০ জনকে জানানোই হয়নি তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ কী। 


প্যালেস্তিনীয়রা বিদ্রোহ করবেন না? করেছেন, আগেও করেছেন, দু’দুবার ‘ইন্তিফাদা’ হয়েছে, সামূহিক বিদ্রোহ। ইজরায়েলী সেনাদের সঙ্গে বছরভর লড়াই করে শহীদ হচ্ছেন তরুণরা। দৃশ্য এতদিন শুধু এইটুকুই ছিল। এতদিন যা দেখা যায়নি ৭ অক্টোবর তা দেখা গেছে। ইজরায়েলের মধ্যে ঢুকে গিয়ে প্রত্যাঘাত করেছে হামাস। ইজরায়েলের লৌহবর্ম ভেঙে দিয়েছে। পালটা আক্রমণ হবে এবং তা হবে মারাত্মক, তা বুঝেই নিশ্চয়ই এই অভিযান। ইজরায়েল গাজাকে মাটিতে মিশিয়ে দিচ্ছে। কত হাজার মৃত্যু হবে, তা আন্দাজ করা যাচ্ছে। কিন্তু দখলদারদের এমন ধাক্কা দেওয়াও ইতিহাসে লেখা থাকবে। 
শোর উঠেছে, হামাস ‘সন্ত্রাসবাদী’, তাদের এই হামলায় নাকি সন্ত্রাসবাদের সমস্ত লক্ষণ ফুটে উঠেছে। পশ্চিমী রাষ্ট্র, সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্যিক সংবাদমাধ্যমেও একই সুর। প্যালেস্তাইন মুক্তি সংস্থা, পিএলও, এক সময়ে ইয়াসের আরাফত যাদের নেতা ছিলেন তাদেরও কিন্তু ‘সন্ত্রাসবাদী’ বলত ইজরায়েল এবং পশ্চিমী দেশগুলি। পিএলও’র কথা শুনেছে উপনিবেশবাদী দখলদাররা? হামাস ঐস্লামিক রেজিন্ট্যান্স মুভমেন্ট। তারা ইসলাম মানে, কিন্তু তাদের সংবিধান পড়লেই বোঝা যায় প্যালেস্তাইনে সব ধর্মের প্যালেস্তিনীয়দের অধিকারকে সম মর্যাদা দেয়। একথা সংবিধানে জানাতে ভোলে না যীশু খ্রিষ্টের জন্মও প্যালেস্তাইনে। ‘তাঁর ওপরে শান্তি বর্ষিত হোক’ শব্দ বন্ধটি হজরত মহম্মদ এবং যীশুর প্রতি সমভাবে উচ্চারিত। এক পর্যবেক্ষক বলেছেন, ১৯৪৩-এর বিখ্যাত ওয়ারশ ঘেটো বিদ্রোহ  পরিচালিত হয়েছিল ইহুদিদের ফাইটিং অর্গানাইজেশনের নেতৃত্বে। নাৎসি প্রচারের ভাষ্যে ওই বিদ্রোহের ইতিহাস পড়া আর পশ্চিমী সংবাদমাধ্যমের দৃষ্টিভঙ্গিতে হামাসের বিদ্রোহকে দেখা একই ব্যাপার। হামাসের সংগঠন রয়েছে, তাদের হাতে ক্ষেপণাস্ত্রের মতো অস্ত্রও রয়েছে, কিন্তু বিদ্রোহ গাজার, বলা যায়, গাজা ঘেটো আপরাইজিং। কাদের বিরুদ্ধে? দুনিয়ার সবচেয়ে ক্রুর সন্ত্রাসবাদী রাষ্ট্র ইজরায়েলের বিরুদ্ধে যাদের হাতে পারমাণবিক অস্ত্রও রয়েছে। 


রক্তপাত হচ্ছে, কে চায় রক্তপাত? ভারতে সিপাহী বিদ্রোহের সময়ে ইউরোপে সিপাহীদের ‘অত্যাচারের’ রগরগে বর্ণনা প্রকাশিত হচ্ছিল। কানপুর, লক্ষ্ণৌয়ের কাছে চিনহাটে বিদ্রোহীদের ইউরোপীয় হত্যার নিষ্ঠুরতা নিয়ে ইউরোপীয় প্রচারের বিপরীতে দাঁড়িয়ে কার্ল মার্কস লিখেছিলেন, ‘ভারতে বিদ্রোহী সিপাহীদের বাড়াবাড়ি সত্যিই আতঙ্কজনক, ভয়ঙ্কর, অবর্ণনীয়— এইরকম ঘটনা দেখা যায় কেবলমাত্র জাতি, সভ্যতা, সর্বোপরি ধর্মীয় অভ্যুত্থানের যুদ্ধে। এককথায়, সম্ভ্রান্ত ইংল্যান্ড প্রশংসা করেছে এমনই হিংসার যখন ‘ব্লু’-দের বিরুদ্ধে ভেন্ডিয়ানরা তা করেছে; জার্মান ও হাঙ্গেরির প্রতিবেশীদের বিরুদ্ধে সার্বিয়ানরা করেছে, ভিয়েনার বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে ক্রোয়েশীয়রা করেছে, ফ্রান্সের সর্বহারার সন্তানদের বিরুদ্ধে ক্যাভাইগজ্যাকের গার্দে মোবাইল বা বোনাপার্টের ডিসেমব্রিস্টরা করেছে। সিপাহীদের আচরণ যত কুখ্যাতই হোক, তা ভারতে ইংল্যান্ডের নিজের আচরণেরই ঘনীভূত প্রতিফলন। ...এই শাসনের বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করতে একথা বলাই যথেষ্ট যে তার আর্থিক নীতির একটি অঙ্গীভূত প্রতিষ্ঠান হলো অত্যাচার। মানব ইতিহাসে প্রতিশোধ বলে একটি জিনিস আছে। ঐতিহাসিক প্রতিশোধের নিয়ম হলো তার হাতিয়ার অত্যাচারিতের নয়, অত্যাচারীর নিজেরই কামারশালায় তৈরি হয়।’

Comments :0

Login to leave a comment