mental depression

অবসাদ আর আত্মহননের প্রত্নরহস্য

উত্তর সম্পাদকীয়​

অরবিন্দ সামন্ত 

‘বধু শুয়ে ছিল পাশে– শিশুটিও ছিল; প্রেম ছিল, আশা ছিল…’, তবুও গৃহস্থ মানুষটির যাপিত জীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে কী করে, কী-সে বিপন্ন বিস্ময় যা তার অন্তর্গত রক্তের ভিতরে  খেলা করে! তাকে নিরন্তর ক্লান্ত করে, সে ধেয়ে চলে অনিবার্য আত্মহননের পথে! সুখী দাম্পত্যের সপ্তপদী কেন পঙ্কিল হয়ে ওঠে বিপন্নতার নীরব রক্তক্ষরণে? সাংসারিক জটিলতার ভঙ্গুর উপত্যকায় দাঁড়িয়ে এ হলো আমাদের উত্তর-আধুনিক জীবন-জিজ্ঞাসা! জীবনানন্দ ক্লান্তির পৌনঃপুনিকতাজনিত অবসাদকেই জীবনের প্রস্থান-বিন্দু বলে সাব্যস্ত করেছিলেন। তাঁর সিদ্ধান্ত চিকিৎসা-বিজ্ঞানের পরিসীমা লঙ্ঘন করেছিল কিনা তা মনোবিদরা বিচার করবেন। আমরা জীবনানন্দের এই অমীমাংসিত দার্শনিক সংশয়টিকে সাম্প্রতিক যাপিত জীবনের প্রেক্ষিতে ভেবে দেখতে পারি।

   গত কয়েক মাসের সংবাদপত্রে চোখ বোলালে মনে হবে আমরা যেন এক বিলয়ন-উন্মুখ বিশ্বে বাস করছি যেখানে আত্মহননের উৎসমুখ বহুধা বিস্তারিত।…বিয়ের পর থেকেই সাংসারিক অশান্তি আর নির্যাতন। শেষে কুয়োর ভিতরে মেলে যুবতী গৃহবধূর দেহ। ভিন্নধর্মে প্রেম, অত্যাচারের আতঙ্কে মাথায় গুলি করে আত্মঘাতী যুবক, হাতে প্রেমিকার ছবি। শুটিং চলাকালীন শৌচাগারে মিলল অভিনেত্রীর ঝুলন্ত দেহ। মেসি জেতার আনন্দে পার্টি, তারপরেই আত্মহত্যা বিষণ্ণ কিশোরীর। স্ত্রীকে খোরপোশ দিতে গিয়ে নাজেহাল, আত্মঘাতী ব্যবসায়ী। সিনেমার হিরোদের মতো চুলের কাট দেখে বকেছিল বাবা, ছেলের চরম সিদ্ধান্তে হতভম্ব পরিবার। গভীর সমপ্রেমে বিয়ের সিদ্ধান্ত, পরিবারের ব্ল্যাকমেইল, ছাত্রীমৃত্যু। অন্তরঙ্গ মুহূর্তের গোপন ভিডিও বন্ধুদের হাতে পড়ে যায়। বন্ধুদের হাতে ঘুরতে থাকে ভিডিও। আত্মঘাতী কিশোর।…এর সঙ্গে যোগ করুন রোহিত ভেমুলার আত্মহননের ঘটনাটি। আত্মহত্যার ভিন্ন মাত্রার একটি দৃশ্যপট উন্মোচিত হবে। 

   আত্মহননের যে-দৃশ্যমান আনুষ্ঠানিকতা আমরা প্রত্যক্ষ করি, মনোবিদরা বলেন, আত্মঘাতী মানুষটি তার জীবদ্দশায় তা মনে মনে ঘটিয়ে থাকেন সহস্রবার। কেন না তার জীবনযাপন তার কাছে নিজস্ব কবন্ধেরই ভারবহন। জীবনের উদযাপন  নয়, জীবন জুড়ে শুধুই অবসাদ আর হতাশা। এই অবসাদঘন আত্মহননের সমাজতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন এমিল ডুরখেইম। ডুরখেইম বলেছিলেন, সামাজিক সংযুক্তি আর নৈতিক নিয়ন্ত্রণ– এই দুই শক্তির ভারসাম্যহীনতার রকমফেরেই লুকিয়ে থাকে আত্মহত্যার প্রত্নরহস্য। তিনি চার ধরনের আত্মহননের কথা ভেবেছিলেন। প্রথমত, আত্মমগ্ন আত্মহনন। সামাজিক সংযুক্তির অভাব আর মাত্রাতিরিক্ত ব্যক্তিকরণ এর কারণ। দেখা যায়, সামাজিক কর্মকাণ্ড থেকে মানুষটি বরাবর বাদ পড়ে যাচ্ছিল। তাই তার  হতাশা এবং আত্মহনন। দ্বিতীয়ত, পরার্থবাদী আত্মহত্যা, যখন ব্যক্তির নিজস্ব আকাঙ্ক্ষা নয়, সমাজের বৃহত্তর প্রয়োজনের টানে মানুষ আত্মাহূতি দেয়। তৃতীয়ত, অনাচারসম্ভূত আত্মহত্যা, যখন ব্যক্তি তার বৈধ আকাঙ্ক্ষার সীমা সংজ্ঞায়িত করতে ব্যর্থ হয় আর সমাজ যখন বিবেকী মানুষটির উপর শৃঙ্খলা চাপিয়ে দেয়, সে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। পরিশেষে, অদৃষ্টবাদী আত্মহত্যা, ব্যক্তি যখন মাত্রাতিরিক্ত নিয়ন্ত্রিত হয়, দমনমূলক শৃঙ্খলা যখন তার আবেগের স্বাভাবিক স্ফূর্তিকে ব্যাহত করে, তখনই সে জীবনের থেকে মরণকেই বরণীয় মনে করে।

 সেকালের এবং একালের পণ্ডিতরা ডুরখেইমকে দুয়ো দিয়েছেন, কেননা  আত্মহত্যায় ব্যক্তি নয়, তিনি সমাজকেই বেশি দোষী ঠাওরেছিলেন। ব্যক্তিকে তিনি মহাভারতের নকুল-সহদেবের চেয়েও অকিঞ্চিৎকর মনে করেছিলেন! কিন্তু একালের মনোবিদরাও কি জানেন, ঠিক কী কারণে মানুষ অবসাদগ্রস্ত হয়? সমাজ না ব্যক্তি— এজন্য কে বেশি দায়ী? ডিপ্রেশনের ট্রিগার ঠিক কোথায়, কীভাবে লুকানো আছে? আমরা তা জানি না। কিন্তু বুঝতে পারি, অবসাদের উদ্বোধন আসলে বাল্যকালেই। আমাদের মাত্রাতিরিক্ত অ্যান্ড্রয়েড-আসক্তি ছোট-বড়োর পারিবারিক আলাপচারিতার বন্ধন আলগা করে দিচ্ছে। বাবা-মাও সন্তানের চেয়ে ভার্চুয়াল বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে বেশি ভালোবাসেন। বাবা-মার উপর সন্তানদের আর্থিক টান বাড়ছে, কমে যাচ্ছে পরমাত্মিক ঘনিষ্টতা। তাই শৈশব থেকেই  স্বাভাবিক জীবনযাপনে পরাঙ্মুখ সন্তানরা বিষন্ন আমিত্বে নির্বাসিত হচ্ছে।

  অবসাদ আজ বিশ্বব্যাপী, বিশ্বগ্রাসী। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে এখন বিশ্বজুড়ে ৩৪ কোটি মানুষ অবসাদগ্রস্ত।  ভারতে সংখ্যাটা সাড়ে তিন কোটিরও বেশি। আর এর মধ্যে ১৮ থেকে ৩৪ বছর বয়সিরাই বেশি অবসাদগ্রস্ত। মানসিক অবসাদের নিরিখে পশ্চিমবঙ্গে রোগীর সংখ্যা জাতীয় গড়ের প্রায় দ্বিগুণ। মোট জনসংখ্যার প্রায় পাঁচ শতাংশ মানুষ অবসাদে ডুবে রয়েছেন এ-বাংলায়। পরিসংখ্যান বলছে, বর্তমানে প্রতি ২৩ জন মানুষের মধ্যে একজন অবসাদের শিকার এরাজ্যে। আর সংখ্যাটা চল্লিশ লাখ ছুঁই ছুঁই। সারা দেশে যেখানে প্রায় পনের শতাংশ অবসাদগ্রস্ত মানুষ চিকিৎসা করাচ্ছেন, সেখানে এরাজ্যে মাত্র দশ শতাংশ চিকিৎসার অধীন। মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, সেই কারণেই এ-রাজ্য আত্মহত্যার  ক্ষেত্রে সব সময়ই দেশের মধ্যে প্রথম চারে থাকছে গত কয়েক বছর ধরেই। 

    সাম্প্রতিক বিশ্বে প্রতি বছর আত্মহত্যা করেন প্রায় আট লক্ষ মানুষ, মানে প্রতি চল্লিশ সেকেন্ডে একজন! আত্মহত্যার ব্যর্থ চেষ্টা করেন আরও প্রায় দশ লাখ মানুষ। বিশ্বব্যাপী আত্মহত্যার ৭৭ শতাংশই ঘটে নিম্ন ও মধ্য-আয়ের দেশগুলিতে। আর আত্মহত্যা ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সিদের মধ্যে মৃত্যুর চতুর্থ প্রধান কারণ। ভারতের ক্ষেত্রে আত্মহত্যার সংখ্যাটা বছর দুই আগেও ছিল দেড় লক্ষের কিছু বেশি। এদেশে আত্মহননের জাতীয় গড় এখন বছরে লাখে বারো জন। ১৯৬৭ সালের পর থেকে এদেশে এটিই সম্ভবত এদেশের রেকর্ড। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, আত্মহত্যা সাম্প্রতিক ভারতের লোকস্বাস্থ্যে  গুরুতর উদ্বেগজনক সমস্যা। কেননা, গত পাঁচ দশক ধরে আত্মহননের ঘটনা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। ২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ সালে আত্মহত্যার হার বেড়েছে সাত শতাংশেরও বেশি। ফলত ভারতেই বিশ্বের সবথেকে বেশি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। গতবছর আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছিল মহারাষ্ট্রে সবচেয়ে বেশি (২২,২০৭), তারপর তামিলনাড়ু (১৮,৯২৫), মধ্যপ্রদেশ (১৪,৯৬৫),পশ্চিমবঙ্গ (১৩,৫০০) আর কর্ণাটক(১৩,০৫৬)। গতবছর ভারতে নথিভুক্ত মোট আত্মহত্যার প্রায় অর্ধেক ঘটেছিল এই পাঁচটি রাজ্য মিলে।

   আমাদের অবসাদ কিংবা আত্মহননের শিকড় কি বাঙালির আবেগ-সর্বস্বতায়?  নাকি স্রেফ সেরোটোনিন আর ডোপামিনের অনটনের কারণে? সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, আত্মহত্যা বাড়ছে, কেননা কলঙ্ক না-ভেবে এটিকে আমরা জনস্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে ভাবতে পারছি না। কয়েকদিন আগে শহরতলির এক মানসিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের আউটডোরে দেখলাম রোগী ও তার পরিজনদের উপচে পড়া ভিড়। এঁরা বেশিরভাগই সমাজের প্রান্তিক মানুষ। রোগ সম্পর্কে তাদের বিন্দুমাত্র সংকোচ বা গোপনীয়তা নেই। তাহলে শহুরে উচ্চবর্গের বাঙালিই কি বেশি গোপনচারি? পরিবারের রুগ্‌ণ মানুষটির মানসিক অসুখ জনসমক্ষে স্বীকার করতে কুন্ঠিত?  কিন্তু এই কুন্ঠিত সংকোচ পরিবারের বিষন্ন মানুষটিকে মুমূর্ষু করে তুললে তা অপরাধ নয় কি? 

আত্মহনন কখন বৈধ, কখন প্রয়োজনীয় আর অপ্রতিরোধ্য, তা আমরা জানি না। কিন্তু জানি মন আসলে আলো-আঁধারের জার্নাল। গোপন না করে, সে-ধূসর পান্ডুলিপি পাঠোদ্ধারের  দায়িত্ব আমরা মনোবিদকেই দিই না কেন!

(লেখক প্রাক্তন অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়।)

Comments :0

Login to leave a comment