Post editorial

কেন সে শিশুটি দাঁড়িয়ে থাকে পথের প্রান্তে

উত্তর সম্পাদকীয়​

মণীন্দ্র চক্রবর্তী 

 

সাংলা, ছবির মতো সাজানো হিমাচল প্রদেশের একটি ছোট্ট শহর। শহরের অন্যতম একটি দর্শনীয় স্থান হলো কামরু ফোর্ট। টিলার মতো পাহাড়ের উপরে অবস্থিত ওই ফোর্টে পৌঁছতে কমবেশি ছয়- সাতশ ফুট পথ সিঁড়ি ভেঙে উঠতে হয়। আগে একবার গিয়েছিলাম বলে জানি, ফোর্টের কিছুটা নিচে বদ্রীবিশালের একটি মন্দির আছে। গাড়ি থেকে নামতেই কানে ভেসে এল স্থানীয় ভাষায় গানের সুর। শব্দটা উপর থেকে আসছে। যত উপরে উঠছি, ততই তীব্রতা বাড়তে লাগল। ভাবলাম, মন্দিরে বোধহয় নবরাত্রির উৎসব চলছে। কিন্তু মন্দির প্রাঙ্গণে এসে দেখলাম, সেখানে একেবারে অন্য পরিবেশ। জমিয়ে খানাপিনা এবং নাচগানের আসর বসেছে সেখানে। খোঁজ নিয়ে জানলাম, বিয়ের আনন্দ অনুষ্ঠান চলছে সেখানে। এটাই নাকি এখানকার রেওয়াজ। এও জানলাম, উৎসব অনুষ্ঠানের দিনগুলোতে স্থানীয় মানুষজন এভাবেই মন্দির প্রাঙ্গণে সমবেত হয়ে নাচগানে মেতে ওঠেন। নারী পুরুষ সকলেই গানের তালে নাচছেন। তবে, পানের মাত্রা যাদের একটু বেশি হয়ে গিয়েছে, মন্দিরের রোয়াকে বসে তাঁরা কেবল সেই তালে মাথা ঝাঁকিয়ে চলেছেন। কিছুটা সময় সেখানে কাটিয়ে পা বাড়ালাম ফোর্টের পথে। পথেই নজরে এল সেই উৎসব বাড়ি। উঠোনে ম্যারাপ বেঁধে খাওয়ানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। কাছাকাছি আসতেই কয়েকজন মহিলা এগিয়ে এসে আমাদের দুপুরের খাবার গ্রহণ করার জন্য জোরাজুরি করতে শুরু করলেন। একেই অপরিচিত, তার উপর সকালের নাস্তাটা একটু ভারী হয়ে গিয়েছিল, তাই আমরা সেই অনুরোধ ফেরাতে বাধ্য হলাম। এই অনুরোধ উপরোধের মধ্যেই একজন আবার স্টিলের থালায় গরম গরম জিলিপি নিয়ে হাজির হলেন আমাদের সামনে। বুঝলাম, অনুরোধ এড়ানো মুশকিল। অগত্যা, ওনাদের আশ্বস্ত করে বললাম, আগে ফোর্ট দেখে আসি, তারপর মিষ্টি মুখ করা যাবে। এই বলে আমরা যখন উপরের দিকে পা বাড়াচ্ছি, তখন লক্ষ্য করলাম ওনারাও জিলিপির থালা হাতে আমাদের পিছু নিয়েছেন। যাই হোক, শেষ চড়াইটুকু পেরিয়ে আমরা প্রবেশ করলাম ফোর্ট চত্বরে। যেহেতু মূল প্রাসাদের অভ্যন্তরে প্রবেশের অনুমতি নেই, তাই ফোর্ট চত্বরে খানিকক্ষণ সময় কাটিয়ে যখন নেমে আসছি, তখন ওই মহিলাদের একজন বললেন, ফোর্টের প্রধান ফটকের পাশে জিলিপির থালাটি রাখা আছে আমরা অবশ্যই যেন সেগুলো খেয়ে নিই। স্বীকার করতে বাধা নেই, এ ধরনের আতিথেয়তা শহুরে সমাজে বিরল।


ওনাদের ধন্যবাদ জানিয়ে থালা ভর্তি জিলিপি হাতে যখন নিচে নেমে আসছি, দেখলাম বাঁকের মুখে তেলচিটে সোয়েটার গায়ে সাত- আট বছরের একটি ছেলে হাতে একটা কাগজের প্লেট নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চোখাচোখি হতেই জিজ্ঞাসা করলাম, ‘জিলিপি খাওগে?’ শুনেই সে লজ্জায় পড়ে গেল। আমি ওর হাতে দুটো জিলিপি তুলে দিতেই ছেলেটি একগাল হাসি দিয়েই দে ছুট। ছেলেটিকে ওভাবে দৌড়তে দেখে আমার মনে কয়েকটি প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে শুরু করল। আমাদের মতো অপরিচিত মানুষদের মাংস- ভাত কিংবা জিলিপি খাওয়ানোর জন্য যাদের আন্তরিকতায় কোনও ঘাটতি ছিল না, এমনকি মিষ্টি হাতে আমাদের অনুসরণ করলেন, তাদের নজরে ওই শিশুটি পড়ল না কেন? ভারতীয় ঐতিহ্যের পরম্পরা মেনে অপরিচিতদের কাছে টেনে নেবার মতো উদারতা যারা দেখাতে পারেন, তাদের আতিথেয়তা থেকে নিস্পাপ শিশুটি বঞ্চিত রইল কীভাবে? বিয়ে বাড়ির ভোজসভার দ্বার তো সকলের জন্যেই অবারিত ছিল, তাহলে শিশুটি সেখানে ঢোকার সুযোগ কিংবা সাহস পেল না কেন? এত উৎসবের মাঝেও শিশুটি কেন রয়ে গেল অবহেলিত, বিচ্ছিন্ন? তথাকথিত ওই সহজ সরল সমাজ জীবনে এমন অদৃশ্য পাঁচিল কে নির্মাণ করল, যা অলঙ্ঘনীয় হয়ে রইল শিশুটির কাছে? 
এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না, পুঁজিবাদী সমাজে দারিদ্রের সাথে সামাজিক প্রতিষ্ঠা তথা গুরুত্বের বিষয়টি অঙ্গাঙ্গীভাবে সম্পর্কিত। আর্থিকভাবে যে যত শক্তিশালী সমৃদ্ধবান, সমাজে  প্রভাব প্রতিপত্তি তার তত বেশি। ফলে, সমাজে যারা বিত্তবান সুবিধাভোগী, কালক্রমে তারাই হয়ে ওঠেন সমাজের নিয়ন্ত্রক শক্তি। এই শক্তি কেবল সমাজকেই নিয়ন্ত্রণ করে না, সমাজের প্রান্তিক মানুষদের সামাজিকভাবে প্রান্তিকীকরণের পথে ঠেলে দেয়। সমাজের বিত্তবান, ক্ষমতাশালী, সুবিধাভোগী এবং সুযোগ-সুবিধা আদায়কারী অংশের প্রতিনিধিত্বকারী মানুষেরা একজন প্রান্তিক মানুষ বা গোষ্ঠীকে ভাবতে বাধ্য করে যে, এই সমাজে না আছে তার কোনও গুরুত্ব, না আছে তার ন্যূনতম সম্মান। যার ফলে, সমাজের দুর্বলতর অংশের মানুষেরা সবসময় একটা হীনমন্যতায় ভোগেন। এটাই পুঁজিবাদী সমাজে  দস্তুর। যে কারণেই নোংরা সোয়েটার গায়ের শিশুটিকে উৎসব বাড়ি থেকে দূরে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছিল। অনুষ্ঠান বাড়িতে সকলে যখন আনন্দ উৎসবে মত্ত, তখন থালা হাতে শিশুটি একাকী দাঁড়িয়ে ছিল রাস্তার ধারে। 


এ দৃশ্য তো কেবল হিমাচলের নয়, পুঁজিবাদী দুনিয়ায় এরকম অসহায়তার অমানবিক দৃশ্য আকছার আমাদের চোখে পড়ে। যদিও খুব একটা আমরা তাতে আমল দিই না, দেবার চেষ্টাও করি না। আসলে পুঁজিবাদী ব্যবস্থাটাই এমন। নিপীড়িত বঞ্চিত অসহায় দরিদ্র মানুষের মানসিক যন্ত্রণাকে কোনও দিনই সে গুরুত্ব দিতে চায় না। কারণ, পুঁজিবাদী ব্যবস্থা দুর্বলতর এই শ্রেণির মানুষগুলিকে সমাজের মূলস্রোতের অংশ বলে গণ্যই করে না। উলটে, সমাজের মূল ধারায় এদের গুরুত্বহীন করে রাখা হয়, যাতে সামাজিক এবং মানসিক পরিসরে তারা নিজেদের বৃহত্তর গোষ্ঠী থেকে বিচ্ছিন্ন বলে ভাবতে বাধ্য হয়। এতে নিশ্চিতভাবেই তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের উপর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়ে। কিন্তু যেহেতু পুঁজিবাদী পরিমণ্ডলে আমাদের বেড়ে ওঠা, তাই আমাদের চিন্তা- চেতনা, বিচার- বুদ্ধিগুলিও পুঁজিবাদী ভাবধারা নিয়েই বিকশিত হতে থাকে। যার ফলে আমরা উপলব্ধি করতে পারি না, ওই মুহূর্তে শিশুটির অন্তরে চলতে থাকা মানসিক টানাপোড়েন তথা যন্ত্রণাগুলিকে। তাদের প্রতি সামান্য সহানুভূতি দেখানো দূর অস্ত, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আমরা থাকি ভাবলেশহীন। সমাজের মধ্যে থেকেও যারা সমাজ বহির্ভূত জীবনযাপনে বাধ্য হচ্ছেন, সেই সমস্ত  প্রান্তিক মানুষগুলির অব্যক্ত মানসিক যন্ত্রণা উপলব্ধি করার মতো মানসিকতা কি আমরা হারিয়ে ফেলেছি? 
নিজের অজান্তেই, কেবলমাত্র দারিদ্রের কারণে যে বয়সে ছেলেটি সমাজে কোণঠাসা হতে শুরু করল, সেই বয়সে তার এটা বোঝার ক্ষমতা থাকার কথা নয়, কেন সমাজ তাকে প্রতি পদে হেয় প্রতিপন্ন করে। ফলে, অলঙ্ঘনীয় সেই পাঁচিলের ওপার থেকে সে কেবল হাঁ করে দেখতে থাকে বিত্তবানদের বৈভব প্রদর্শন, যেখানে তার প্রবেশের অনুমতি নেই। এই হীনমন্যতা পরবর্তীতে তার মধ্যে এমন এক মানসিকতার জন্ম দেয়, সে প্রশ্ন তুলতে ভুলে যায়, কেন সেখানে তার প্রবেশাধিকার নেই! এবং সেটা ভুলে যায় বলেই, করুণা করে কেউ যদি তার হাতে সামান্য কিছু তুলে দেয়, সেটাকে মহানুভবতা মনে করে ওই দাতাকে সে মসিহা ভাবতে শুরু করে। বলা বাহুল্য, মোদী- মমতারা সেটাই চান। সমাজের একটা বিশাল অংশকে চিরকালের মতো আর্থ- সামাজিক এবং মানসিক দিক থেকে বিপর্যস্ত, পঙ্গু করে রাখার জন্যেই তাদের কেউ আশি কোটি মানুষকে বিনা পয়সায় রেশন দেবার কথা বুক বাজিয়ে ঘোষণা করেন, কেউ আবার সন্তুষ্ট রাখতে উদ্যোগী হন যৎসামান্য ভাতা প্রদানের মাধ্যমে। পুঁজিবাদী অর্থনীতিবিদরা এই দান- খয়রাতিকে যে নামেই ব্যাখ্যা করুন, আসলে তা প্রান্তিক মানুষদের আর্থিক, সামাজিক এবং মানসিকভাবে পঙ্গু করে রাখার এক চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত।

Comments :0

Login to leave a comment