Post Editorial

হিসাব কষেই মমতার টার্গেট মার্কসবাদীরা

উত্তর সম্পাদকীয়​

লক্ষ্য সিপিআই(এম)। টার্গেট মার্কসবাদীরা। আরএসএস’র প্রয়োজনে তাই মমতা ব্যানার্জি যাদবপুর নিয়ে মুখ খুলেছেন। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্র, স্বপ্নদীপ কুন্ডুর খুনের তদন্ত করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর তদন্তে রাজ্য রাজনীতির তাৎপর্যপূর্ণ মুহূর্তে মার্কবাদীদেরই ‘অপরাধী’ হিসাবে খোঁজ পাওয়া যায়। আরএসএস তাঁর চোখে পড়ে না।
বসিরহাটের দাঙ্গার তদন্ত তিনি করেন না। ধুলাগোড়, উলুবেড়িয়ায় সাম্প্রদায়িক হানাহানিতে কারা যুক্ত— মুখ্যমন্ত্রী বলেন না। কিন্তু জেলা থেকে আসা এক ছাত্রর খুনের ঘটনায় পুলিশের তদন্তের তিনি ধার ধারেন না। দায়ী করেছেন মার্কসবাদীদের। যাদবপুরের হস্টেলে ছাত্রের রহস্যজনক মৃত্যুতে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি বলেছেন, ‘‘যারা ছেলেটিকে উপর থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে, তারা সব মার্কসবাদী।’’ তিনি আরও বলেন,‘‘ওখানে কিছু আগমার্কা সিপিএম আছে। তারা ছেলেটার জামাকাপড় পর্যন্ত খুলে নিয়েছিল।’’ 
যারা করেছে খুন, তাদের আড়াল করলেন। দায়ী করলেন ‘মার্কসবাদী’দের। আর ‘আতঙ্কপুর’ বললেন যাদবপুরকে। কিন্তু র্যা গিং রুখতে তাঁর সরকার কী করেছে গত বারো বছরে? বললেন না। কেন রাজ্যের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে তৃণমূলের দৌরাত্ম্যে ছাত্রছাত্রীরা অতিষ্ট? আসলে মার্কসবাদী এবং যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে ঘৃণা সৃষ্টির চেষ্টা করলেন। আমরা দেখলাম সামাজিক মাধ্যমে অনেকেই সামগ্রিকভাবে ‘যাদবপুর’ সম্পর্কে সেই সময়ে ঘৃণা প্রকাশ করছিলেন। রাজ্যে পঞ্চায়েত নির্বাচন এবং মণিপুর, হরিয়ানার বীভৎসা পরবর্তী দেশ, রাজ্য কোথায় দাঁড়িয়ে আছে হিসাব করেই মমতা ব্যানার্জি যাদবপুরের ঘটনাকে ব্যবহার করতে চেয়েছেন।
এই মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গ এবং দেশ কোথায় দাঁড়িয়ে আছে? পশ্চিমবঙ্গে সিপিআই(এম)’র অগ্রগতি মমতা ব্যানার্জিও দেখতে পেয়েছেন। যেমন অমিত শাহ দেখতে পেয়েছেন। দূরবিন লাগছে না। পঞ্চায়েত নির্বাচনে তা স্পষ্ট। সেই নির্বাচনী লড়াইয়ের সময় সিপিআই(এম)’র কর্মীরা তৃণমূল, বিজেপি’র মুখোমুখি কড়া লড়াই দিয়েছেন। নির্বাচনের আগে, প্রচারের সময় লড়েছেন। নির্বাচনের দিন লড়েছেন। ভোট গণনার সময় লড়েছেন। গণনাকেন্দ্রে তৃণমূল, বিডিও, পুলিশের যৌথ হামলার মুখোমুখি জুঝে বেশ কিছু জায়গায় জয় ছিনিয়ে এনেছেন অনেক পার্টিকর্মীরা। 
শুধু পঞ্চায়েত নির্বাচনই নয়। তার আগে সাগরদিঘির বিধানসভা উপনির্বাচন দেখিয়ে দিয়েছে বামফ্রন্ট, কংগ্রেস এবং আইএসএফ-র সম্মিলিত বাহিনী রাজ্যে তৃণমূল এবং বিজেপি-কে পিছনে ফেলে দিতে সক্ষম। মানুষ তৃণমূল এবং বিজেপি বিরোধী স্পষ্ট অবস্থান নিচ্ছেন। বাম গণতান্ত্রিক এবং ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিগুলি ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে। বালিগঞ্জ বিধানসভা উপনির্বাচনে সেই সম্ভাবনার ইঙ্গিত দৃঢ় করেছিল। সাম্প্রতিক পঞ্চায়েত নির্বাচন তৃণমূল-পুলিশ-বিডিও, জেলা শাসকদের জোটের সন্ত্রাস-চক্রান্ত সত্ত্বেও এবং গণনার কারচুপির পরেও যে হিসাব সামনে এসেছে তাতে বামফ্রন্ট, কংগ্রেস, আইএসএফ’র ভোট বেড়েছে প্রায় ১২%— গত বিধানসভা নির্বাচনের তুলনায়। এই সময়েই বিজেপি’র ভোট কমেছে অনেকটা, প্রায় ১১%। 
যে লক্ষ্য সিপিআই(এম) তার অন্তত গত দুটি পার্টি কংগ্রেসে নির্দিষ্ট করেছে, তা ক্রমশ বাস্তবে মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে। ফলে এখনই ‘মার্কসবাদী’দের সম্পর্কে নতুন করে ঘৃণা জাগিয়ে তোলার ষড়যন্ত্র জরুরি— তৃণমূলের কাছে। সঙ্ঘের কাছেও। 
এই পরিবেশের দুটি প্রেক্ষাপট আছে। প্রথমত, রাজ্যে মমতা-শাসনকে অপশাসন হিসাবে চিহ্নিত করে ফেলেছেন অনেক পশ্চিমবঙ্গবাসী। সিপিআই(এম)’র নেতা, কর্মীদের ‘চোর ধরো জেলে ভরো’ থেকে ‘লুটেরাদের তাড়িয়ে মানুষের পঞ্চায়েত গড়ো’ পর্যন্ত লড়াইয়ের ধারাবাহিকতা, তীব্রতা রাজ্য রাজনীতিতে বিশেষ পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। দ্বিতীয়ত, জাতীয় ক্ষেত্রে বিজেপি’র অবস্থা আদৌ আর অনুকূল নয়। মোদী-ম্যাজিক উধাও। তাই সঙ্ঘের পথে বিজেপি মণিপুর থেকে হরিয়ানা— বিভাজনের নোংরা রাজনীতির কৌশলে আরও জোর দিতে বাধ্য হয়েছে। রাজ্যেও গত লোকসভা নির্বাচন থেকে বিজেপি’র যে অগ্রগতি দেখা যাচ্ছিল, তা থমকেছে। মানুষের মধ্যে গিয়ে দাঁড়ালেই বিজেপি’র কেন্দ্রীয় সরকারের ব্যর্থতা নিয়ে ক্ষোভ স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। রাজ্যে বিজেপি’র প্রচার ছিল ‘তৃণমূলকে বিজেপিই টাইট দেবে।’ এই প্রচারের আর বিশ্বাসযোগ্যতা নেই। জাতীয় পর্যায়ে ‘ইন্ডিয়া’ মঞ্চ গড়ে উঠেছে। যেখানে মঞ্চের নাম থেকে প্রথম আবেদন— সব ক্ষেত্রেই কমিউনিস্টদের গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় দেখা গেছে। সিপিআই(এম) তার অবস্থান থেকে নড়েনি। পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি এবং তৃণমূল, উভয়ের বিরুদ্ধেই লড়াই হবে। কারণ— মমতা ব্যানার্জিকে পরাস্ত না করতে পারলে নরেন্দ্র মোদীদের হটানো যাবে না। পার্টি নিশ্চিত। পার্টি তার অবস্থান বেঙ্গালুরুতে ‘ইন্ডিয়া’ মঞ্চের বৈঠকের আগে এবং পরে তা স্পষ্ট জানিয়েছে।
এখন রাজ্যে তৃণমূল এবং বিজেপি’র ভোট ভাগাভাগি, জয় ভাগাভাগি এবং মানুষকে বোকা বানানোর কৌশলের সামনে দৃপ্ত চ্যালেঞ্জ হিসাবে স্পষ্ট নিজেদের প্রতিষ্ঠা করেছে সিপিআই(এম)। সিপিআই(এম)’র সভা, মিছিলে অংশগ্রহণ বাড়ছে। আর এই গুণগত পরিবর্তনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অনুঘটক শক্তি হিসাবে কাজ করেছেন তরুণ প্রজন্ম। বাংলার বামপন্থার পুনর্জাগরণের উপর দেশে বামপন্থীদের শক্তিশালী হয়ে ওঠা জরুরি। আর বাংলার বামপন্থার পুনরুন্মেষ আসলে নব প্রজন্মের লাল ঝান্ডার অগ্রণী হয়ে ওঠার উপর অনেকটা নির্ভরশীল। আর ঠিক তাই ঘটছে।
তাই এখন আক্রমণ করতে হবে ‘মার্কসবাদী’দের। কমিউনিস্টদের। সিপিআই(এম)-কে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রকে খুনের ঘটনায় সিপিআই(এম)-কে জড়িয়ে দিতে পারলে মানুষের মধ্যে পার্টি সম্পর্কে ঘৃণা তৈরি করা যাবে। তাতে তৃণমূলের যেমন লাভ, তেমনই বিজেপি, আরএসএস’রও সুবিধা।
মমতা ব্যানার্জি তাঁর দুটি হৃদয়ের জন্য তাই ‘মার্কসবাদী’-দের নাম জড়িয়ে, ঠিক এই সময়ে কথাটি বলেছেন।
এমন কাজের তিনি পুরানো কারিগর।
প্রমাণ? জ্ঞানেশ্বরী এক্সপ্রেসে নাশকতা। নাশকতা চালিয়ে প্রায় ১৫০জনকে খুন করেছিল তৃণমূল-মাওবাদীরা। বিজেপি এবং সঙ্ঘ তখন রাজ্যে তৃণমূলের হয়েই কাজ করছিল। পরবর্তীকালে তা সঙ্ঘ স্বীকারও করেছে।
জ্ঞানেশ্বরী এক্সপ্রেসে গণহত্যায় কী হয়েছিল? ২০১০-র ২৮ মে’র ওই গণহত্যায় ১৪৯ জনের মৃত্যু হয়েছিল। আহত হয়েছিলেন ২০০-র বেশি। তার ঠিক দু’দিন পরেই রাজ্যের ৮১টি পৌরসভার নির্বাচন ছিল। ঠিক সেই মুহূর্তটি রাজ্য রাজনীতি তথা দেশের রাজনীতিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ২০১০-এ সিপিআই(এম)-কে জনমানসে ‘ঘৃণ্য’ প্রতিপন্ন করতে চেয়েছিল তৃণমূল, মাওবাদী, বিজেপি। এই কাজ তার আগে থেকেই চলছিল। কিন্তু ২০২০-র মে ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত। 
সেদিন কী বলেছিলেন মমতা ব্যানার্জি? ওই বর্বরোচিত হামলায় তৃণমূল নেত্রী মমতা ব্যানার্জি সিপিআই(এম)’র হাত আছে বলে ইঙ্গিত করেন। ৩০ মে প্রকাশিত সংবাদপত্রগুলিতে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল এই ভাষায়—‘‘সরডিহায় জ্ঞানেশ্বরী নাশকতার পিছনে সিপিএমের হাত আছে বলে অভিযোগ করলেন রেলমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।...তিনি প্রশ্ন তোলেন, একটি রাজনৈতিক দল ঘটনার পর এত তাড়াতাড়ি মাঠে নেমে পড়ল কী করে ? ...মমতার অভিযোগ, জ্ঞানেশ্বরী এক্সপ্রেসে এতজন নিরীহ যাত্রীর প্রাণহানির ঘটনা একটা গভীর ষড়যন্ত্র।’’ 
সেই ‘ষড়যন্ত্রের’ সিবিআই তদন্ত করিয়েছিল বামফ্রন্ট সরকার। মমতা ব্যানার্জি তখন কেন্দ্রের সরকারের শরিক। মুকুল রায় রেলমন্ত্রী। তবু সিবিআই চার্জশিটে মমতা ব্যানার্জির ‘সাবোতোজ’, ‘সিপিএম-র চক্রান্ত’-র তত্ত্বকে আমল দিতে পারেনি। নৃশংস সেই ঘটনার পান্ডা বলে যারা চিহ্নিত হয়েছিল, তাদের বেশ কয়েকজন ছিল পরিচিত তৃণমূলী। যেমন উমাকান্ত মাহাতো, মনোজ মাহাতো। মমতা ব্যানার্জি নিশ্চই ভুলে যাননি।
পরবর্তীকালেও মমতা ব্যানার্জি এই মডেল নানা ভাবে ব্যবহার করেছেন। যেমন কামদুনিতে। কামদুনিতে মমতা ব্যানার্জি গিয়েছিলেন ২০১৩-র ১৭ জুন। সেখানে তৃণমূল কংগ্রেসের আশ্রিত দুষ্কৃতীরা এক ছাত্রীকে ধর্ষণ করে খুন করেছিল। মুখ্যমন্ত্রী মৃতার বাড়ি গেছিলেন চাকরির প্রতিশ্রুতি জানাতে। তখন গ্রামবাসীরা তাঁর সঙ্গে এলাকার দুষ্কৃতী এবং পুলিশি নিষ্ক্রিয়তা নিয়ে কথা বলতে চাওয়ায় তিনি বলেছিলেন, ‘‘চোপ। সব সিপিএম, সব সিপিএম’’।
যাদবপুরে ছাত্র খুনের ঘটনায় যারা অভিযুক্ত, ধৃত, তারা যে সংগঠনে যুক্ত, সেটি মূলত তৃণমূল, বিজেপি এবং সিপিআই(এম)-বিরোধী বিভিন্ন শক্তির এই মঞ্চ। কাজ করে ‘স্বাধীন’ নামে। ভাব দেখানোর চেষ্টা করে ‘অরাজনৈতিক।’ অরাজনীতি শাসক শ্রেণির বরাবরের একটি অস্ত্র। অরাজনীতি আসলে ‘মার্কসবাদ’কে ঠেকানোর একটি হাতিয়ার। সেই ‘অরাজনৈতিক’, ‘স্বাধীন’ সংগঠনটির কুকীর্তির কারণেই নিহত হতে হয়েছে কলকাতা লাগোয়া একটি জেলা থেকে আসা ছাত্রকে। প্রসঙ্গত, বিজেপি এবং তৃণমূলের অনেক হিসাব উল্‌টে দিয়ে স্বপ্নদীপের জেলায় এবারের পঞ্চায়েত নির্বাচনে ভালো ফল করেছে সিপিআই(এম)। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী এসএফআই লাগাতার তথাকথিত ‘অরাজনৈতিক’দের বিরুদ্ধে, আরএসএস-তৃণমূলের বিরুদ্ধে লড়াই করছে। সাফল্যের সঙ্গেই সেই লড়াই চালাচ্ছে ছাত্রছাত্রীরা। তৃণমূল-মাওবাদী জোটের নৈরাজ্য, নাশকতার দিনগুলিতেও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা এসএফআই’র পতাকাতলে সেই অতি বিপ্লবী বুলির আড়ালে তৃণমূল, বিজেপি’র ফায়দার জন্য কাজ করতে থাকা শক্তির বিরুদ্ধে জোরদার লড়াই করেছে।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র খুনের ঘটনায় নতুন করে মাথা তুলতে চাইছে সঙ্ঘ এবং তৃণমূল। ওই ঘটনাকে তারা সমগ্র পশ্চিমবঙ্গে নিজেদের ভাঙা হাটের পসরা করতে চাইছে। ঠিক যেভাবে এই সুযোগে তারা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে জমি পাওয়ার চক্রান্ত করেছে।
তাই যাদবপুর শুধু যাদবপুর নয়। এখন সারা রাজ্য। লড়াই তাই শুধু ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের নয়। যাদবপুরের লড়াই আসলে আগামী দেশের লড়াই। ভোটের লড়াই। বুথের লড়াই। মতাদর্শেরও লড়াই।

Comments :0

Login to leave a comment