SIKKIM FLOOD

ভেসে গেছে সিকিমের অসংখ্য গ্রাম, বিপর্যয়ের ধাক্কা উত্তরবঙ্গে

রাজ্য

CPIM TMC BJP AIKS WEST BENGAL PANCHAYAT ELECTION WEST BENGAL POLITICS 2023 BENGALI NEWS

বিপর্যয় এখনো সামলাতে পারেনি সিকিম। এখনও বিচ্ছিন্ন অবস্থায় সিকিমের বিস্তীর্ণ এলাকা। তিস্তা নদীর গ্রাসে তলিয়ে গেছে সিকিমের গ্রামের পর গ্রাম। বাদ পড়েনি রাস্তাঘাট কিংবা সেতু। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় বহু এলাকায় শনিবারেও পৌঁছাতে পারছেন না উদ্ধারকারী দল। পৌঁছানো যাচ্ছে না অতি প্রয়োজনীয় ওষুধ, খাদ্য ও অন্যান্য সামগ্রী।  

সিকিমের লোয়ার জঙ্গুতে তিস্তার সেতু জলের তোড়ে ভেসে গেছে। ওই গ্রামের বহু মানুষ এখনো আশ্রয়হীন অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন। স্থানীয় প্রশাসন ও বেশ কিছু সংস্থার উদ্যোগে জিপলাইন তৈরি করে ট্রলি লাগিয়ে এক পাশ থেকে অন্য পাশে বন্যা কবলিত গ্রামটিতে ওষুধ-খাদ্যের সঙ্গে জরুরি জিনিসপত্র পাঠানোর ব্যবস্থা করছেন। 

ভয়াবহ বন্যার জেরে এখন সিকিমে আটকে বহু পর্যটক, শ্রমিক ও অফিস যাত্রী। বৃহস্পতিবার বিকেলের পর থেকে আটকে থাকা পর্যটক ও সাধারণ মানুষদের ঘুরপথে নিরাপদে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হচ্ছে। পরীক্ষামূলক ভ্রমণে সিকিমে গিয়ে ভয়ানক প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে পড়েছেন আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়ারা। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের প্রায় ২৫ জন পড়ুয়া সহ বিভাগীয় অধ্যাপকেরা আটকে ছিলেন।


আতঙ্কিত ওই দলটিকে দীর্ঘ ১১ ঘণ্টার পর উদ্ধার করা গেছে। ধসে যাওয়া রাস্তার ধারে দীর্ঘসময় গাড়ি বন্দি ছিলেন তাঁরা। শেষে শনিবার তাঁদের শিলিগুড়িতে নিয়ে আসা গেলো। স্বস্তির শ্বাস ফেলেছেন তাঁরা। শিলিগুড়ির কাঞ্চনজঙ্ঘা স্টেডিয়ামের ইয়ুথ হস্টেলে  উঠেছিলেন। সেই রাতের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা মনে করালে শিউরে উঠছেন পড়ুয়ারা। 
জানালেন, প্রাণ সংশয় ছিল। তার মধ্যেও জীবনের ঝুঁকি নিয়েই সিকিম থেকে রওনা হয়েছিলাম। অতিরিক্ত তিনগুন ভাড়া গুনতে হলেও সকলে সুস্থভাবেই ফিরতে পেরেছি। বিপর্যয়ের এই ক’দিন খাবারের খুব সমস্যা ছিল। এদিন শিলিগুড়ি থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পথে রওনা হয়ে গেছেন দলটি।  

সিকিমে নেটওয়ার্কের সমস্যার জন্য আটকে থাকা মানুষদের তাদের পরিবারের সঙ্গে ইচ্ছা থাকলেই  যোগাযোগ করতে পারছেন না। আগের থেকে অবশ্য কিছুটা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। বেশ ভালো সংখ্যায় পর্যটকসহ সাধারণ মানুষকে উদ্ধার করে সমতলের শিলিগুড়িতে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হয়েছে। 

শুক্রবার রাতের দিকে সিকিম পরিবহণের একটি বাস সিকিমে আটকে থাকা প্রায় ৩০ জনকে শিলিগুড়িতে নিয়ে নিরাপদে পৌঁছে দেয়। ৩০ জনের মধ্যে বেশ কয়েকজনকে বন্যা দুর্গত এলাকা থেকে হেলিকপ্টারে করে উদ্ধার করেছিল সেনাবাহিনীর। বিপদের রাত কেটে গেছে। মৃত্যুকে খুব কাছ থেকে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন সেই রাতে। কিন্তু সকলেরই চোখে মুখে এখনও সেই আতঙ্কের ছাপ।  

ভয়ঙ্কর তিস্তার ধ্বংসলীলায় এখনো নিখোঁজ অনেকে। আবার নদী বক্ষে ঘরবাড়ি স্বজন হারিয়ে সর্বস্বান্ত হয়েছেন অনেক মানুষ। তিস্তাপাড়ের বাসিন্দারা অসহায়। দিশেহারা মানুষের কান্নার রোল ভেসে আসছে খরস্রোতা তিস্তার দুইপাশের গ্রাম থেকে। তিস্তার হড়পা বানে তলিয়ে যাওয়া দু’টি দেহ বাংলাদেশে বয়ে যাওয়া তিস্তার চরে শুক্রবার রাতে ভেসে উঠেছিল। সেই দু’টি দেহ ভারতকে হস্তান্তর করেছে বাংলাদেশ। 
শুক্রবার রাতে ভারত-বাংলাদেশের গীতালদহ সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশের লালমনিরহাট থানার কর্ণপুরের চওড়াটারি গ্রামে দুই দেশের মধ্যে ফ্ল্যাগ মিটিং অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশ সীমান্ত রক্ষীবাহিনী ভেসে আসা দু’টি দেহ ভারতীয় সীমান্ত বাহিনীর হাতে তুলে দেয়।  


বিপর্যয়ের পরে ধ্বংসস্তূপের মাঝেও উদ্ধার কাজ শনিবার অব্যাহত রয়েছে। একের পর এক মৃতদেহ উদ্ধার করা হচ্ছে। বাংলা সিকিম লাইফ লাইন ১০ নম্বর জাতীয় সড়ক মেরামতির কাজও চলেছে যুদ্ধকালীন তৎপরতায়। সিংটামের বারদাংঙে ক্ষতিগ্রস্ত সেনাছাউনির নিখোঁজ জওয়ানদের খোঁজেও তল্লাশিকে বাড়ানো হয়েছে।

জানা যাচ্ছে, চুঙথাংঙের দক্ষিণ লোনাক হ্রদের বাঁধ ভেঙে ভয়াবহ বিপর্যয়ের পর উত্তর সিকিমের ‘সাকো চো’ নামে আরো একটি হ্রদে ভাঙন নিয়েও হাই অ্যালার্ট জারি করা হয়েছে। তিস্তার নদীর হড়পা বানে সিকিমের পাশাপাশি কালিম্পঙ জেলার বহু মানুষ গৃহহীন, অন্নহীন অবস্থায় দিন গুজরান করছেন। ত্রাণ শিবিরে আশ্রয় নিয়েছেন বিপর্যয়গ্রস্তরা।  

দুর্যোগে ভেঙে পড়েছে দিকচু সেতু। কালিম্পঙে ১০ নম্বর জাতীয় সড়কের বেহাল অবস্থা। রম্ভি বাজারের কাছে প্রায় ৫০ ফুট রাস্তা ধসে গেছে। উদ্বেগ কাটিয়ে পরিস্থিতির স্বাভাবিক হতে দীর্ঘ সময় লাগবে বলেই প্রশাসন সূত্রে জানা যাচ্ছে। কালিম্পঙ জেলার তিস্তার দুইপাশ ধরেই বাড়ি ঘর ভেসে গেছে। মানুষদের বাঁচানো গেছে, এটা যা রক্ষা।

এদিকে, বন্যার বিভীষিকা যেন কিছুতেই পিছু ছাড়ছে না জলপাইগুড়ির মানুষদের। এখন এই জেলার তিস্তা নদীর পাড় থেকে উদ্ধার হয়ে চলছে মৃতদেহ। শনিবার ফের উদ্ধার হয়েছে দেহ। জলপাইগুড়ি সদর ব্লকের বোয়ালমারী নন্দনপুর গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার তিস্তা নদীর পার থেকে পাওয়া গেছে ওই দুই  মৃতদেহ। পুলিশ এবং এনডিআরএফ কর্মীরা তা উদ্ধার করেছেন। এই নিয়ে গত ৩ দিনে জলপাইগুড়িতে উদ্ধার হওয়া মৃতদেহের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ালো ২৯।

উদ্ধার হওয়া দু’টি দেহই সেনা কর্মীর বলে সন্দেহ। দু’টি মৃতদেহকে নিয়ে আসা হয়েছে জলপাইগুড়ি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে রয়েছেন সেনার আধিকারিকরা। দেহ দু’টোকে শনাক্তকরণের সব রকম চেষ্টা চালানো হচ্ছে। এলাকাবাসীরা জানিয়েছেন, দু’দিন থেকে ওই দু’টি পচা-গলা দেহ উলটে পড়ে ছিল। চারদিকে দুর্গন্ধে ভরে গেছিল। বারবার প্রশাসনকে জানানোর পরে শেষে শনিবার কোতোয়ালি থানার পুলিশ এবং এনডিআরএফ কর্মীরা দেহ উদ্ধারে নামেন।

এসবের মধ্যেই শনিবার সকাল থেকে বাড়ি ফেরা শুরু করেছেন কোচবিহারের মেখলিগঞ্জের তিস্তা চরের বাসিন্দারা। সিকিমে বিপর্যয়ের পর তিস্তার চর থেকে তাঁদের নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে দিয়েছিলেন বিএসএফ জওয়ানরা। শনিবার তাঁরা একে একে ফিরছেন ঘরে। আর বিপদের আশঙ্কা নেই, প্রশাসনের তরফে এমন অভয়বাণী শোনার পরেই ফিরছেন সঙ্কটে থাকা সাধারণ মানুষরা।

সিকিমে এখনও আটকে রয়েছে কোচবিহারের অনেক পরিযায়ী শ্রমিক। এর মধ্যে রয়েছেন শিতলখুচির ৩০ জন পরিযায়ী শ্রমিক। তাঁদের কাছে কোন খাবার নেই। ফিরে আসার গাড়ি হাঁকছে মোটা অংকের টাকা। শিতলখুচিতে থাকা সেই সব দরিদ্র পরিবারের সদস্যরা এখন এর থেকে ওর থেকে টাকা জোগাড় করতে ব্যস্ত। স্থানীয় প্রশাসনকে বলেও কোন লাভ হয়নি।  

সিকিম বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকতেন নুর আলম, সইদুল ইসলাম, হেমন্ত বর্মণরা। ওরা সকলেই নির্মাণকর্মী। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবন নির্মাণের কাজে গেছিলেন তাঁরা। ভয়াবহ রাতে ওরা কিছুই বুঝতে পারেনি। সকালে উঠে দেখে এলাকার কোনও দোকানে খাবার নেই। সব কিনে নিয়েছে স্থানীয়রা। বুধবার থেকেই নামমাত্র খাবার আর জল ভরসা করেই বেঁচে আছে তাঁরা।

সিকিম থেকে শিলিগুড়ি ফিরতে গাড়ি যাচ্ছে নামচি, লাভা হয়ে। মাথাপিছু ভাড়া চাইছে দুই হাজার টাকা। কারো কাছে এত টাকা নেই। বাড়ি থেকে টাকা না পাঠালে ফেরাই তাঁদের মুসকিল। আড়াই মাস আগে কাজে গিয়েছিল ওরা। ঘরে ফেরার জন্য টাকার জন্য ওই তিরিশ জন শ্রমিক।  


এদিকে, তিস্তার চরের বাসিন্দাদের জলে স্রোতে প্রচুর গবাদি পশু ভেসে গেছে। আমনের জমিতে পড়েছে পুরু বালির স্তর। অনেকের বাড়ি ভেঙেছে। তিস্তার অন্যান্য চরের বাসিন্দারা যারা প্রাণ বাঁচাতে আশ্রয় নিয়েছিলেন ত্রাণ শিবিরে তারাও এই সমস্যায় পড়েছেন। সকলের মুখে একটাই কথা— ‘প্রাণ তো বেঁচেছে। কিন্তু মাথার ওপরের ছাদ থেকে গবাদি পশু আর জমির ধান সবই তো গেছে ! এরপর আমাদের চলবে কি করে ?’

নবান্নের নির্দেশে শনিবার রাজ্যের কৃষি সচিব ওঙ্কার সিং মীনা ঘুরে গেছেন ত্রাণ শিবিরে। কিন্তু সরকারি সাহায্য মিলবে কি ? তিস্তা চরের বাসিন্দাদের সহজ সরল প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেননি ওই অফিসার। 

Comments :0

Login to leave a comment