রামশঙ্কর চক্রবর্তী: তমলুক
আজও দিনটির কথা ভুলতে পারেন না আরজুনা বিবি। শনিবার সেই দিনটির বর্ষপূর্তি।
একবছর আগে ৩০ ডিসেম্বর নন্দকুমারের বিডিও'র কাছে সরকারি প্রকল্পে ঘর পাওয়ার আবেদন নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি।
কী হয়েছিল তারপর? নন্দকুমার থানার লক আপে বিবস্ত্র করে মেরেছিল পুলিশ। খাওয়ার জল চাইতে পুলিশ তার মুখে প্রস্রাব করবে বলেছিল। ডিসেম্বরের এই ঠান্ডায় সায়া, ব্লাউজ পরে সারা রাত কেটেছিল। এক ফোঁটা জলও মেলেনি। স্বাধীনতার আগে ব্রিটিশ পুলিশের এমন অত্যাচার ছিল বিপ্লবীদের প্রতি। ইতিহাসের পাতায় তার বহু বিবরণ মেলে। কিন্তু গত বছর নন্দকুমারে পুলিশের এমন নির্মম অত্যাচারের সাক্ষী হয়েছিল রাজ্যবাসী। সেই ঘটনা আজও টাটকা আরজুনা বিবির মনে। সেইসব কথা মনে করতে করতেই বলল ‘‘ঘর তো পেলাম না আজও। তবে কি লড়াই করা ছেড়ে দিব? কখনও না। দোষী পুলিশদের আর ঐ বিডিও'র শাস্তি চাই আমি। ভারী কিছু কাজ করতে পারিনি, পানির বালতিটাও তুলতে গেলে কষ্ট হয়। কোটালের সময় সারা শরীরে অসহ্য যন্ত্রণা হয়। সেই কষ্ট আমার স্বামী একমাত্র বুঝে।" তবে সেই ঘটনার সহানুভূতি কেবল নিজের জন্য নিতে নারাজ তিনি। কিন্তু কেন? "দেখ ভাই আমি তো একা মার খাইনি। হ্যাঁ আমার উপর অত্যাচার অনেক বেশি করেছিল পুলিশ। তবে আমার মতো অনেক ভাই দাদাদেরকে তো পুলিশ মেরেছিল। জেল যেমন আমি খেটেছি তারাও তো জেলে ছিল। সিপিএম পার্টির অনেকজন তো মার খেয়েছে। আমি তখন পুলিশের গাড়ির ভিতর থেকে দেখিনি সব। থানায় লিয়ে যাবার সময় পরিতোষ দাদার মুখে লাথি মেরেছিল পুলিশ। সবই মনে আছে। কত লোক আসসিল সেদিন। তখন বুঝলি তাহলে মোর মত কত লোক ঘর পায়নি। শুধু শাস্তি চাই ওই পুলিশের।’’
সরকারি ঘরতো পেল না দাদার ঘরে কতদিন থাকবে এভাবে? ‘‘ঘর যদি নেই দেয় কি করব বল? দাদারও সংসার আছে তারাও থাকে। এখানেই কোনোরকমে আছি। তৃণমূল বলছিল মোদের পার্টি করো তোকে ঘর দিব, কাজও দিব। আমি অদের জানাইছি সরকারি ঘর পেতে গেলে কি পার্টি করতে হবে? কেন মুই কি পাবার যোগ্য নয়? তৃণমূল বলে তুই তো সিপিএমের সঙ্গে মিশু। দেখ সিপিএম পার্টি করলে ঘর পাবিনি। আমি তাদের কইছি, মুই কি সিপিএমের নেতা? না এখানে কারু কাছে সিপিএমের প্রচার করছি? ঘরের দাবি লিয়ে ত বিডিও অফিসে গেসলি। আমান্নে যাতে ঘর পাই সেই দাবি ত সিপিএম করছিল, তোমান্নে ত কওনি কুনওদিন। মোদের ১০০ দিনের টাকা ত তৃণমূল চুরি করছে। পঞ্চায়েত মেম্বারের ঘর বাড়ি বড় হয়রে। আর মোন্নে গরিব লোক কুনও সুযোগ সুবিধা পাইনি।’’ কথাগুলি বলতে বলতে আলু কাটতে লাগলেন আরজুনা বিবি। দুপুর বেলা। খাবারের তৈরি করতে হচ্ছে। স্বামী স্ত্রী খাবেন। খাবারের তালিকায় কি কি আছে? উঁকি দিয়ে দেখা গেল উনুনে ভাত চেপেছে। আলু, আর একটি বেগুন কাটা হয়ে আছে। কি রান্না হবে আজ? ‘‘ঐ ভাত আর আলু, বেগুন ভাতে। মোর স্বামী চলে আসবে ভাটা থেকে। আমি একটু আগেই আসসি রান্নার জন্য। খেয়ে আবার দুজনে ভাটায় চলে যাব।’’
তাহলে কি এখন ইটভাটায় কাজ করেন? "মোর স্বামী তো আগে থেকেই ইটভাটায় কাজ করত। কাছের ইটভাটাটা ছিল। সেটা বন্ধ আছে। একটু দুরে যেতে হয় এখন কাজে। আমিও যাই। ভারী কিছু কাজ করতে পারিনি। স্বামী ইট তৈরি করে। আমিও সাহায্য করি। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ হয়। মাঝে খাবার জন্য ঘর আসি।’’ জানালো আরজুনা। মজুরি কিরকম? "ওই ১ হাজার ইট তৈরি করলে ২০ টাকা। সারাদিনে ৫ হাজার ইট তৈরি করতে পারা যায়। আমরা দু’জনে মিলে মাসে ৪-৫ হাজার টাকা রোজগার করি। তবে এই ইটের সিজিন ৫ মাস। তারপর লোকের ঘরে মজুর খাটি।’’
এখনও ঘর পায়নি আরজুনা বিবি। ইটভাটার মালিকের দয়ায় এতদিন কোনোরকম মাথা গুঁজে ছিল ইটভাটারই এক কোণে। মাটির দেওয়ালে খেজুর গাছের পাতার ছাউনি দিয়ে স্বামী সোনু আলিকে নিয়ে আশ্রয় ছিল আরজুনার। মালিক ভাটা বন্ধ করে দেয়। এবার পুরোপুরিই আশ্রয়হীন হয়ে আরজুনা বিবি দাদার কুঁড়ে ঘরে থাকছেন এখন।
আরজুনা বিবির সাথে কথা বলছি সেইসময় তার স্বামী সোনু বাড়ি আসেন। আমাকে দেখেই একগাল হাসি হেসে জড়িয়ে ধরে— ‘‘অনেকদিন পরে তুমি আসস। দাদা ভালো আছো ত? আর ঐ দাদারা ভালো আছে? আমি তো ব্রিগেড যাব ৭ তারিখ। নরঘাটে পোস্টার দেখছি। মীনাক্ষীর ছবি দেওয়া আছে। মোকে সৌমেন দা বলছিল সকাল ৮টায় বাস ছাড়বে মোদের এখান থেকে। আরজুনাকেও সঙ্গে লিয়ে যাব।’’
কী চাও এখন? কি আবার চাইব। একটা ঘর যাতে পাই। মোর মত বহু লোক আছে তাদেরও ঘর নাই তারাও যেন পায়। তবে যা শুনতিছি চারদিকে তৃণমূল পার্টিতো সব চুরি করেলিছে গরিবের জিনিস। কি হবে কে জানে?" উত্তরে জানালো আরজুনা বিবির স্বামী সোনু আলি।
Comments :0