অরিজিৎ মণ্ডল
কলকাতায় জমা জলে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে ৮জনের মৃত্যু হয়েছে সম্প্রতি। তাঁদের পরিবারের সদস্যদের ‘স্পেশাল হোম গার্ড’-এর কাজ দেওয়ার ঘোষণা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি।
‘স্পেশাল হোম গার্ড’ মানে কী, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। কিন্তু এখানে আলোচনার বিষয় কলকাতায় কাজ। ২০১০ সালে কলকাতা পৌরসভার বোর্ড তৃণমূল কংগ্রেস গঠনের পর থেকে স্থায়ী নিয়োগ হয়নি বললেই চলে। চাকরি কেন কলকাতা কর্পোরেশনে দেওয়া হয় না? কারণ—এখানে কাজ দেওয়া মমতা ব্যানার্জির নীতি নয়।
বামফ্রন্ট যখন কর্পোরেশন পরিচালনা করতো সে সময়ে যে স্থায়ী কর্মীরা ছিলেন তাঁদের অনেকেই অবসর নিয়েছেন। ফলে তৈরি হয় শূন্যপদ। সেই শূন্য পদে স্থায়ী নিয়োগের জায়গায় নেওয়া হচ্ছে ঠিকা কর্মী। সেই ঠিকা কর্মীর সংখ্যাও কম। ১০০ দিনের কর্মীদের দিয়ে বেশিরভাগ অংশের কাজটাই করানো হচ্ছে। দাবি উঠছে ১০০ দিনের যে সমস্ত কর্মী অসুস্থ তাঁদের পরিবর্তে নতুন কর্মী নিয়োগ করা দরকার। কর্পোরেশনের অধিবেসনে গত বুধবার মেয়র পরিষদ সদস্য দেবব্রত মজুমদার দাবি করেন,‘‘কলকাতা কর্পোরেশনে বর্তমানে স্থায়ী অনুমোদিত পদে কর্মী রয়েছেন ১৩ হাজার ৮৪০ জন। কলকাতা পৌরসভা অনুমোদিত স্থায়ী শূন্য পদ রয়েছে ৮ হাজার ৪৬৮। তার মধ্যে ৭ হাজার ৪৩৭ জন ঠিকা কর্মী নিয়োগ হয়েছে।’’ তাঁর দাবি, "বাকি যে শূন্য পদ রয়েছে তার মধ্যে কিছু জনকে নিয়োগ করা হয়েছে এবং বাকি শূন্য পদে নিয়োগের জন্য বিজ্ঞপ্তি ও প্রকাশ করা হয়েছে।’’
কর্মীর প্রয়োজন কমেছে বোঝাতে দেবব্রত মজুমদারের বক্তব্য, আগে কলকাতায় সাফাই কর্মীরা ওপেন ড্রেন পরিষ্কার করত। বর্তমানে তা হয় না। তিনি বলেছেন যে আগে দু’চাকার গাড়িতে জঞ্জাল তুলে নিয়ে আসা হতো। বর্তমানে সব ওয়ার্ডে ১০টি করে ব্যাটারি চালিত গাড়ি দেওয়া হয়েছে। যাতে আগের তুলনায় অন্তত তিন গুণ বেশি জঞ্জাল বহন করা যায়। কলকাতা কর্পোরেশন বর্তমানে যন্ত্র চালিত পরিষেবার ক্ষেত্রে বেশি নজর দিচ্ছে।
উল্লেখ্য, লেদার কমপ্লেক্সের সামনে কিছুদিন আগেই ম্যানহোলে নেমে নিকাশির কাজ করতে গিয়ে মৃত্যু হয় কলকাতা কর্পোরেশেনের কর্মীদের। এমন একাধিক ঘটনা দেখা গিয়েছে গত কয়েক বছরে। জঞ্জাল পড়ে থাকার ঘটনা দেখা যাচ্ছে শহরের বিভিন্ন এলাকায়।
আরও প্রশ্ন উঠছে যে যন্ত্র চালাতে যে কর্মী দরকার তা-ও কেন নিয়োগ করছে না কলকাতা কর্পোরেশেন। বামফ্রন্ট পরিচালিত বোর্ডের সময়ে প্রতিদিন দু’চাকার গাড়িতে জঞ্জাল নিতে আসার লোক থাকলেও এখন সেই পরিষেবায় খামতির অভিযোগও উঠছে। তা’ছাড়া যন্ত্রের কারণে কর্মীর প্রয়োজন কমে গেলে একশো দিনের কাজের মতো অস্থায়ী নিয়োগের বদলে স্থায়ী নিয়োগ বাড়ছে না কেন, উঠছে সে প্রশ্নও।
কলকাতা কর্পোরেশনের বামফ্রন্টের পরিষদীয় দলনেতা মধুছন্দা দেব বলেন,‘‘যন্ত্রচালিত বিভিন্ন গাড়ি বা মেশিন চালানোর জন্য দক্ষ কর্মীর প্রয়োজন। কলকাতা কর্পোরেশন কি তাদের কর্মীদের ট্রেনিং এর কোনও ব্যবস্থা করছেন বা দক্ষ কর্মী নিয়োগের কি কোনও বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে?’’ তিনি আরও বলেন,‘‘কর্মীর সঙ্কট দীর্ঘদিন থেকেই। শেষ ১৫ বছরে তৃণমূল পরিচালিত কর্পোরেশন কোনও স্থায়ী কর্মী নিয়োগ করেনি। কেন নিয়োগ হচ্ছে না তা নিয়েও কোনও কথা বলছেন না মেয়র।’’ ১০৩ নম্বর ওয়ার্ডের সিপিআই(এম) কাউন্সিলর নন্দিতা রায় বলেন,‘‘১০০ দিনের কর্মীদের দিয়ে অতিরিক্ত কাজ করানো হচ্ছে। তাই কর্মীর অভাব মেটানো হচ্ছে, তাদের দিয়েই। আমার ওয়ার্ডেই স্থায়ী কর্মী মাত্র ১৯ জন।’’
কর্মসংস্থানের প্রশ্নে ডিওয়াইএফআই একাধিকবার কলকাতা কর্পোরেশন অভিযান করেছে। তাঁরা প্রশ্ন করতে চেয়েছে মেয়রের কাছে কেন স্থায়ী পদে নিয়োগ হচ্ছে না। কলকাতা কর্পোরেশন অভিযানের জন্য পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হতে হয়েছে, পড়েছে পুলিশের লাঠির বাড়িও। ডিওয়াইএফআই কলকাতা জেলা সম্পাদক শ্রীজীব গোস্বামী বলেন,‘‘কলকাতা কর্পোরেশনের যে পরিষেবা তাদের দেওয়ার কথা সেই পরিষেবা তারা দিতে পারছে না। আর প্রধান কারণ স্থায়ী কর্মী নেই। নিয়োগ করার বদলে কন্ট্রাকচুয়াল, ক্যাজুয়াল নিয়োগ করছে। এতে স্থায়ী সমাধান হয় না। একদিকে যেমন বেকারির যন্ত্রণা, অন্যদিকে মানুষের পৌর পরিষেবার অভিযোগ বাড়ছে। ডিওয়াইএফআই স্থায়ী পদে নিয়োগের জন্য লড়াই করেছে ভবিষ্যতেও করবে।’’
বর্তমানে যে শ্রমিক কর্মচারীরা পৌর পরিষেবা দেন প্রতিটি ওয়ার্ডে, তাঁদের বেতন কত?
পৌর পরিষেবার জন্য মূলত তিন ধরনের শ্রমিকদের ওপর নির্ভর করতে হয়। প্রথমত, যাঁরা কলকাতা কর্পোরেশনের স্থায়ী শ্রমিক ও কর্মচারী। তাঁদের সরাসরি নিয়োগ করে কর্পোরেশন এবং তারা পিএফ-গ্র্যাচুইটি সমস্ত সুযোগ-সুবিধা পান। এই শ্রমিকদের মাসিক বেতন প্রায় ২৫ হাজার টাকা থেকে ৫০ হাজার টাকার মধ্যে। দ্বিতীয়ত, ২০১১ সালের পর থেকে যে স্থায়ী পদগুলি খালি হয়েছে তাতে স্থায়ী নিয়োগের জায়গায় চুক্তিতে নিযুক্ত শ্রমিক ও কর্মচারীরা। এই চুক্তি শ্রমিকদের মাসিক বেতন ৮৮০০ টাকা থেকে ৯২০০ টাকার মধ্যে। এছাড়াও যাঁরা ‘কন্ট্রাকচুয়াল সুপারভাইজার’ পদে রয়েছেন তাঁদের বেতন প্রায় ৯,৮০০ টাকা থেকে ১০,৪০০ টাকার মধ্যে।
তৃতীয়ত, কর্পোরেশনের স্থায়ী কর্মীর অভাব মেটাতে নিযুক্ত একশো দিনের কর্মীরা। তাঁদের দৈনিক মজুরি ২০২ টাকা। একশো দিনের কাজে সুপারভাইজারদের মজুরি দৈনিক ৩০৩ টাকা। ১০০ দিনের কাজে নিযুক্ত দক্ষ শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি ৪০৪ টাকা। তাঁদের না আছে প্রভিডেন্ট ফান্ড, না গ্র্যাচুইটির মতো সামাজিক সুরক্ষা।
তাঁরা কাজ করে ‘নো ওয়ার্ক নো পে’ শর্তে। অসুস্থতার মতো কারণেও কাজে না এলেই কাটা যাবে পুরো মজুরি। এছাড়াও সরকারি ছুটি বা অন্য কোনও ছুটির দিনে তাদের সবেতন ছুটি থাকে না।
Comments :0