HIDURASHTRA ELECTION

লোকসভা ভোট নজরে, হুঙ্কার হিন্দুরাষ্ট্রের

জাতীয় বিশেষ বিভাগ

HIDURASHTRA ELECTION

গৌতম রায়

আরএসএস’র কাছে এখন প্রধান লক্ষ্য ২০২৫ সালে শতবর্ষ পালন। সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক লক্ষ্য 'ধর্মনিরপেক্ষ' ভারত-কে 'রাজনৈতিক হিন্দু' ভারতে পরিণত করা। সম্প্রতি পানিপথের সামালাখাতে 'অখিল ভারতীয় প্রতিনিধি সভা', সঙ্ঘ এবং সঙ্ঘ পরিবারের শীর্ষস্তরের নেতৃবৃন্দকে নিয়ে তৈরি সমিতির তিনদিন ব্যাপী সন্মেলন হলো। সরসঙ্ঘচালক মোহন ভাগবত এবং সঙ্ঘের শীর্ষস্তরের সব কর্মকর্তা, সঙ্ঘের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি জে পি নাড্ডা, সকলেই অংশ নেন। 

আরএসএস নেতা মনমোহন বৈদ্যের সাংবাদিক সম্মেলনে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী সঙ্ঘ এবং সঙ্ঘ পরিবার গোটা দেশের ৩৮, ৯১৩টি জায়গাতে এখন কাজ করছে। সঙ্ঘ অনুমোদিত ৩৪টি সংগঠনের ১৪৭৪ জন প্রতিনিধি ওই তিনদিনের সভায় অংশ নিয়েছিলেন। আগামী এক বছরে সঙ্ঘের কর্মপদ্ধতি এই সভা থেকে নির্ধারিত হয়েছে। 

নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে বিজেপি একক গরিষ্ঠতা নিয়ে কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর বিজয়া দশমীতে সরসঙ্ঘচালকের বক্তৃতা দূরদর্শনে সরাসরি সম্প্রচার হয়ে থাকে। আরএসএস একটি চরম স্বৈরতান্ত্রিক সংগঠন। এখানে সঙ্ঘ প্রধানই শেষ কথা।                               নিজেদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপিকে একক গরিষ্ঠতায় ক্ষমতায় বসাতে এতকাল নানা কর্মসূচি নিয়েছে সঙ্ঘ। এখন তাদের লক্ষ্য, এই ক্ষমতাকে সংসদীয় গণতান্ত্রিক মোড়ক দিয়ে চিরস্থায়ী করা। সেই লক্ষ্যেই ইন্দিরা গান্ধীর সংবিধান সংশোধন করে সংসদের মেয়াদ বৃদ্ধির সেই অতীতের দৃষ্টান্তকে নতুন করে আরও ক্ষিপ্রতার সঙ্গে অথচ মানুষের মনে যাতে বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি না করে, সেভাবেই ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করবার কৌশল নির্ধারণ এবং প্রয়োগই হল এখন সঙ্ঘের প্রধান উদ্দেশ্য। 

আরএসএস রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলে ধর্মের ব্যবহারে সর্বাধিক অগ্রাধিকার দিয়েছিল ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ ধ্বংসের সময়েই। ভোট রাজনীতিতে এগিয়ে যেতে থাকে তাদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি। তিন দফায় মোট সাড়ে ছয় বছর বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ প্রশাসনকে কাজে লাগিয়ে সঙ্ঘ তাদের সামাজিক প্রযুক্তিকে কাজে লাগায়। ধর্মপ্রাণ হিন্দুদের একাংশ, যাঁরা নিজের ধর্মের প্রতি অনুরাগকে কখনও অপর ধর্মের প্রতি বিরাগ, হিংসা, বিদ্বেষের কাজে ব্যবহার করতেন না, তাঁদের মধ্যেও পরধর্ম বিদ্বেষ, বিশেষ করে মুসলমান বিদ্বেষ ছড়িয়ে দিতে থাকে।

ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর সাম্প্রদায়িক এবং ধর্মপ্রাণ- উভয় অংশের হিন্দুদের কাছে সামাজিক প্রযুক্তির প্রয়োগ ঘটিয়ে এই বিশ্বাস তৈরি করা যে বাবরি মসজিদই রামকাহিনীর নায়ক, দশরথনন্দন ' রাম' এর জন্মস্থান। মসজিদ ধ্বংসের পর এখন সেই দখলীকৃত জায়গাতেই মন্দির তৈরি করা হচ্ছে। পাশাপাশি সংবিধানের ৩৭০ ধারা অবলুপ্তি, অভিন্ন দেওয়ানি বিধির ঘোষণা- এইসব সঙ্ঘের গোপন কর্মসূচিকে গোপনীয়তার আবরণ ভেদ করে প্রকাশ্যে আনা হল।

অপর কৌশলটি হল, সামাজিক বিভাজনের পরিবেশ তৈরিতে সম্ভাব্য রাজ্যভিত্তিক আঞ্চলিক দলগুলিকে ব্যবহার করা।

একদিকে গোটা সঙ্ঘ ও সঙ্ঘ পরিবারের সামাজিক প্রযুক্তি অপর দিকে মমতা ব্যানার্জির মতো দলকে ব্যবহার করা। যারা মুসলিমদের বন্ধু সাজার ভান করতে গিয়ে বিভাজন ছড়ায়। সামাজিক বিদ্বেষ ভোট রাজনীতিতে বিজেপিকে শক্তিশালী করে। এইসবের ভিতর দিয়ে সংখ্যাগুরুর সাম্প্রদায়িকতাকে সংখ্যাগুরুর আধিপত্যবাদে পরিণত করে দেশের সংবিধান বদলে একদম হিটলার, মুসোলিনীর স্টাইলে একটা গণতান্ত্রিক মুখোশ পরে নিজেদের ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করতেই এখন 'হিন্দুরাষ্ট্রে'-র পথে হাঁটছে আরএসএস।

আসন্ন লোকসভা ভোটে (২০২৪) হিন্দু সাম্প্রদায়িক শিবির এই রাজনৈতিক হিন্দুরাষ্ট্রের ইস্যুটিকেই সব থেকে বেশি অগ্রাধিকার দেবে। কারণ বাবরি মসজিদের জমিতে তথাকথিত রামমন্দির তৈরি, সংবিধানের ৩৭০ ধারা অবলুপ্তি ইত্যাদির মত যে সাম্প্রদায়িক ইস্যুগুলিকে সামনে রেখে তারা মেরুকরণের রাজনীতি করে ভোটে জিততো, সেইসব বিষয়গুলিকেই সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে তারা নিজেদের মতো করে হাসিল করে নিয়েছে। হিন্দুরাষ্ট্রের নামে মেরুকরণের রাজনীতির ভিতর দিয়ে এগোনো ছাড়া আরএসএস’র কাছে এখন আর দ্বিতীয় বিকল্প কোনো পথ  নেই।

রাজনৈতিক হিন্দুরাষ্ট্রের অর্থ হলো, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক বানানো।  গোলওয়ালকরের 'সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ’-র প্রয়োগে এনআরসি, সিএএ নাগরিকত্ব আইনের সংশোধনের এই উদ্যোগ। মনে রাখা ভালো, কেবল ধর্মীয় সংখ্যালঘুই আক্রান্ত হবেন না। চালু সংবিধানের কাঠামোতেই একের পর এক সাংবিধানিক অধিকার কেড়ে নিচ্ছে বিজেপি। ঠুঁটো করে দিচ্ছে সংসদেও। নাগরিক অধিকার চাইলেই দেশদ্রোহী বানানো হচ্ছে। কৃষক থেকে শ্রমিক বা সরকারি কর্মচারী, আরএসএস’র নিশানা থেকে বাদ নেই কেউ-ই। হিন্দুরাষ্ট্র শ্রমজীবীকে রক্ষা করবে না। রক্ষা করবে, পূর্ণ সুরক্ষা দেবে বৃহৎ পুঁজিকে। আপাতত যা দেখা যাচ্ছে গৌতম আদানি থেকে মেহুল চোকসি বা নীরব মোদীদের সুরক্ষায় কেন্দ্রের সরকারের তৈরি করা বলয়ে। 

Comments :0

Login to leave a comment