ঋদ্ধি রিত
ফুটবল শব্দটার মধ্যে সবথেকে বেশি যেটা আছে সেটা হলো আবেগ। সারা পৃথিবী এই আবেগে গা ভাসায়। হেরে গিয়ে দুচোখ দিয়ে বয়ে চলা জলস্রোত, আর জিতলে উন্মাদনা সব আছে এই ফুটবল ঘিরে। আছে ভালোবাসা, আছে কষ্ট, আছে আনন্দ, আছে রাজনীতি। মাঠে আছে, মাঠের বাইরেও আছে। এদুয়ার্দো গ্যালাইনোর মতে অনেক বুদ্ধিজীবীরাও শেষ অবধি মেনে নিয়েছেন যে ‘ফুটবল-উপাসনা’ মানুষের ‘ধর্ম’। ফুটবলে আবিষ্ট গরিব খেটেখাওয়া মানুষরা ভাবে তাদের বেঁচে থাকার একমাত্র উপায় এটাই। এই ধরনের আদিম আনন্দের মাধ্যমে তারা তাদের স্বপ্ন পূরণ করে।
আবার এই ফুটবলই হয়ে উঠেছে প্রতিবাদের ভাষা। কাতার বিশ্বকাপই তার প্রমাণ দিয়েছে। বিশ্বকাপ শুরুর দু’মাস আগে প্রতিবাদী মাহশা আমিনির মৃত্যুর পর থেকে ফুঁসছে ইরান। রোজই বিক্ষোভ হচ্ছে গোটা দেশে। কিছু দিন আগেই ইরানের খ্যাতনামী শেফ মেহরশাদ শাহিদিকে পিটিয়ে খুন করেছে রেভলিউশনারি গার্ড ফোর্স বলে অভিযোগ ওঠে। হিজাব-বিরোধী আন্দোলনে পথে নেমেছিলেন শাহিদি। তখনই তাঁকে তুলে নিয়ে গিয়ে হেফাজতে খুন করা হয় বলে অভিযোগ। শাহিদির শেষকৃত্যের সময় প্রতিবাদে পথে নামেন হাজার হাজার মানুষ। যখন ইরানে সরকার-বিরোধী আন্দোলন চলছে তখন ইরানের বিক্ষোভকারী মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে ফুটবল বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচে জাতীয় সঙ্গীতে গলা মেলাননি ইরানের ফুটবলাররা। ম্যাচের আগেই ইরানের অধিনায়ক আলিরেজা জাহানবকশ জানিয়েছিলেন, জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া হবে কিনা সেটা দলের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবেন তাঁরা। জানা গিয়েছে, ইরানের বেশির ভাগ ফুটবলারই জাতীয় সঙ্গীত না গাওয়ার পক্ষে মত দেন। ক্যামেরায় দেখা গিয়েছে, স্টেডিয়ামে হাজির অনেক সমর্থকও জাতীয় সঙ্গীতের সময় চুপ ছিলেন।
এটাই ফুটবল। বহু ধরনের তর্ক বিতর্কও ফুটবলকে ঘিরে আছে। সেই তর্ক থাকা ভালো। আছে বিভিন্ন দেশ ও তাদের সমর্থক। নিজেদের দেশ বিশ্বকাপ না খেলতে পারলেও লাতিন আমেরিকা, ইউরোপীয় দেশগুলির সমর্থনে গলা ফাটায় গোটা বিশ্ব। আমাদের দেশ, রাজ্যও তাতে পিছপা হয় না। পেলে, মারাদোনা, রোনালদিনহো হয়ে এখন রোনাল্ডো, মেসি, নেইমার, মড্রিচ বা এমবাপে। কাটআউট, ফ্ল্যাগে মুড়ে ফেলা হয় শহরের অলি গলি। দেওয়াল লিখন, প্রিয় তারকার ছবি আঁকাও বাদ যায় না। যে দল হেরে বিদায় নেয় তাদের সমর্থকরা এত দূরে বসেও চোখের জল ফেলে। আসলে বাংলার সাথেও তো ফুটবলের যোগ নিবিড়। এখানেই তো দুই প্রধানের খেলা দেখতে গিয়ে প্রাণ যায় ১৬ জন মানুষের। এই শহরের ময়দানের বাইরেই তো টিকিটের লাইনে দাঁড়িয়ে মাউন্টেড পুলিশের লাঠির বাড়ি খায় সমর্থকরা।
কিন্তু শেষ কিছুদিনের সমাজমাধ্যমে যে চরিত্র ফুটে উঠলো তা কি বাংলা ফুটবলের জন্য মঙ্গলময়! হতেই পারেন আপনি কোন এক দেশের সমর্থক। হতে পারে সেই দেশ ছিটকে গেছে। কিন্তু অন্যদেশের বিশেষ কোন প্লেয়ারকে নিয়ে এই ধরনের চূড়ান্ত নিন্মমেধার আচরণ বাঙালি ফুটবল প্রেমকে কোন উচ্চতায় পৌঁছবে? আর ফুটবল তো বাঙালির সংস্কৃতির সাথেও ওতপ্রোত জড়িত। তার মানে কি এই নয় যারা মনে করেন বাংলা সংস্কৃতি চর্চার পীঠস্থান, সংস্কৃতির অগ্রিগতি বাঙালিদের দ্বারাই ধাবমান সেই সংস্কৃতিকেই সপাটে থাপ্পড় কষাচ্ছে এই ধরণের সমাজমাধ্যমে ঘুরতে থাকা বিদ্রুপ। কেন এর প্রতিবাদ হচ্ছে না? অবশ্যই আপনি অন্য দলের বিরুদ্ধে মজা করতে পারেন। কিন্তু বিদ্বেষ কেন? এটা কোন বাংলায় বাস করছি আমরা?এটা কোন ফুটবল প্রেম? প্রশ্ন কিন্তু উঠছে।
Comments :0