ANAYAKATHA — BISHAL NAG / MUKTADHARA / 31 DECEMBER

অন্যকথা — ভুল স্বীকার করতে দ্বিধা করতেন না স্টিফেন হকিং / বিশাল নাগ / মুক্তধারা / ৩১ ডিসেম্বর

সাহিত্যের পাতা

ANAYAKATHA  BISHAL NAG  MUKTADHARA  31 DECEMBER

মুক্তধারা

অন্যকথা

ভুল স্বীকার করতে দ্বিধা করতেন না স্টিফেন হকিং
 

বিশাল নাগ

নাম স্টিফেন হকিং, জন্ম ব্রিটেনের অক্সফোর্ডে, বিশাল মাপের বিজ্ঞানী । সব মানুষের জীবনে ভুল হয়, ভুল হয়েছিল স্টিফেন হকিং-এরও। প্রায় সব মানুষই নিজের ভুল সহজে স্বীকার করতে চায় না। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল স্টিফেন হকিং প্রবাদ প্রতিম বিজ্ঞানী হলেও নিজের ভুল স্বীকারে দ্বিধা করতেন না। তিনি বিশ্বাস করতেন যদি নিজের ভুল স্বীকার করে নেন, তবে পরবর্তী সময়ে সেই ভুল আর হবে না। 
ওনার অন্যতম বিখ্যাত বই “এ ব্রিফ হিস্ট্রি অফ টাইম’ প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৮৮-তে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য রথীন্দ্র নারায়ন বসু একদিন এই বই কিনলেন এবং কয়েকদিনের মধ্যেই পড়া শুরু করে দেন। হঠাৎ একটা লাইনে এসে থমকে যান, মনে হয়েছিল নির্ঘাত ছাপার ভুল। নিজের ধ্ন্দ কাটাতে তিনি সরাসরি স্টিফেন হকিং-কে চিঠি লেখেন ১৯৯৩ সালের ২১-শে মে । রথীন্দ্র নারায়ণ বসুর বক্তব্য ছিল “ ১৩৬ পাতায় চতুর্থ 
ও পঞ্চম লাইনে এক এর পর ৮০টি শূন্য লেখা হয়েছে , এটা ৮৬টি শূন্য থাকা উচিত বলে মনে হয়’। বিষয়টি খতিয়ে দেখার অনুরোধ জানান।  রথীন্দ্র নারায়ণ বসু-র চিঠির ঠিক একমাস পরে হকিং এর চিঠি আসে রথীন্দ্র নারায়ণ বসুর বাড়ি। 
হকিং লিখেছিলেন – “আপনিই সঠিক। আমার ভুল হয়েছে, পরবর্তী সংস্করণে শুধরে দেওয়া হবে”। 
চিঠিটি পড়ে রথীন্দ্র  নারায়ণ বসু একেবারে হতভম্ব, তিনি বলেছেন – “অত বড় মাপের মানুষ কি নির্দ্ধিধায় ভুল স্বীকার করলেন”। 
পরে ১৯৯৩-তে হকিং-এর বক্তৃতা ও সাক্ষাৎকার নিয়ে প্রকাশিত হয়ে একটা বই – “ব্ল্যাকহোলস অ্যান্ড ইউনিভার্স অ্যান্ড আদার এসেজ”। এই বইটিও রথীন্দ্রবাবু কেনেন। ভালভাবে পড়ে তিনি দুটি ভুল চিহ্নিত করেন এবং হকিংকে চিঠি লিখে জানান। লেখেন – “অক্সিজেন থেকে হিলিয়াম তৈরি হয় লেখা হয়েছে , কিন্তু অক্সিজেন নয়, তৈরি হবে হাইড্রোজেন”। দ্বিতীয় ত্রুটিটি ছিল – “মস্তিষ্কে প্রায় ১০এর পর ২৬টি শূন্য কণা রয়েছে লেখা হয়েছে, কণা বলতে কি বোঝানো হয়েছে ?”
এবার তিনি নিজে জবাব দিতে না পারলেও কিছু দিনের মধ্যে তার বিজ্ঞানী সহকারী সু. ম্যাসের চিঠি আসে। ম্যাস লিখেছেন – “আপনার উল্লেখ করা ভুলটি সংশোধনের কথা প্রফেসর জানিয়েছেন, আর দ্বিতীয় প্রশ্নের জবাবে জানিয়েছেন যে কণা বলতে পরমাণুর কথা বলা হয়েছে”। 
এ রকম অনেক রকমের ভুল করেছেন তিনি তার জীবনে। তাকে এমনিতেই শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী বলা হয় না। তিনি তার আগের অনেক বৈজ্ঞানিকদের কাছ থেকে শিক্ষা নিয়েছেন, তার সঙ্গে তিনি নিজেরও অনেক শিক্ষা তাদের সঙ্গে যুক্ত করে জীবনের রাস্তায় এগিয়ে গেছেন। 
অনেকের অনেক সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে তিনি অনেক ভুলও করেছেন, কিন্তু যদি কেউ তার ভুলটা ধরিয়ে দেয় তাহলে তার ভুলটি সংশোধন করে ক্ষমা চেয়ে নিয়েছেন। 
১৯৯৭ সালে ব্ল্যাক হোল নিয়ে একটি বাজি ধরেছিলেন হকিং। সিগন্যাস এক্স-১ মৃত নক্ষত্রটি ব্ল্যাক হোল কি-না, সেই প্রশ্নে। থর্ন বললেন, ওটি ব্ল্যাক হোল। হকিং-এর মত, মোটেই না। বাজি? 
বাজির পণ? হকিং জিতলে তিনি দু’বছর ধরে পাবেন হাসির পত্রিকা ‘প্রাইভেট আই’। আর থর্ন জিতলে? এক বছর ধরে রগরগে সেক্স ম্যাগাজিন ‘পেন্টহাউস’। থর্ন জিতলেন এবং এক বছর প্রতি মাসের প্রথম দিনে তার লেটার বক্সে পৌছে যেত ‘পেন্টহাউস, আর থর্নের স্ত্রী রেগে কাঁই হতেন। 
হকিং একবার বললেন ব্ল্যাক হোল বলে মহাবিশ্বে কিছু হয় না। পরবর্তী কালে সেই তথ্য সংশোধন করেন তিনি।এই বাজিতে (১৯৯৭) তাঁর পক্ষে ছিলেন আর এক পদার্থ বিজ্ঞানী কিপ থর্ন এবং অন্য পক্ষে ছিলেন জন প্রেস্কিল। পদার্থবিজ্ঞানের ইতিহাসে এই বাজি "থর্ন-হকিং-প্রেস্কিল বাজি" নামে পরিচিত। কিপ থর্ন পরে নোবেল পুরস্কার  পেয়েছিলেন। 
প্রফেসর হকিং এবং থর্ন যুক্তি দেখালেন যে, যেহেতু সাধারণ অপেক্ষবাদ অনুসারে কৃষ্ণ বিবর তার ঘটনা দিগন্তের ভেতরের কোনো কিছুই বাইরে আসতে দেয়না, এমনকি সেখান থেকে আলো পর্যন্ত বের হতে পারে না সেহেতু হকিং বিকিরণের মাধ্যমে বস্তুর ভর-শক্তির যে তথ্য পাওয়া যায় তা কোনো ক্রমেই কৃষ্ণ বিবরের ভেতরের তথ্য নয়, তা নতুন, এবং যেহেতু এটি আবার কোয়ান্টাম বলবিদ্যার সাথে সাংঘর্ষিক সেহেতু কোয়ান্টাম বলবিদ্যা নতুন করে লেখা প্রয়োজন। 
অপরপক্ষে জন প্রেস্কিল যুক্তি দেখালেন , যেহেতু কোয়ান্টম বলবিদ্যা বলে যে, এই তথ্য কৃষ্ণ বিবর দ্বারা উৎসারিত এমন তথ্য যা কৃষ্ণ বিবরের প্রথম দিককার কোনো অবস্থা নির্দেশ করে এবং সেহেতু সাধারণ অপেক্ষবাদ দ্বারা নির্ণীত কৃষ্ণ বিবরের চলতি ধারণায় পরিবর্তন আনা প্রয়োজন।
দীর্ঘদিন পরে ২০০৪ সালে হকিং স্বীকার করেন যে তিনি বাজিতে হেরেছেন এবং মন্তব্য করেন যে, কৃষ্ণ বিবরের উচিত তার দিগন্ত ভেঙে তথ্য নির্গমন করা এবং এটা করার জন্য তিনি মজা করে জন প্রেস্কিল কে বেসবল সম্পর্কিত একটি সম্পূর্ণ বিশ্বকোষ উপহার দিয়েছিলেন যা প্রেস্কিলের কাছে হকিংয়ের মতে কৃষ্ণ বিবর থেকে পাওয়া তথাকথিত তথ্যের মত অকাজের ঈঙ্গিতবহ। তবে কিপ থর্ন পরাজয় মানেননি এবং বাজিতে তাঁর অংশের পুরস্কার দিতে রাজি হননি।
কম্পিউটার সিমুলেশন এর মাধ্যমে দেখা গেছে যে পঞ্চম বা ততোধিকমুখী একধরনের চিকন বৃত্তাকৃতির কৃষ্ণ বিবর কালক্রমে তার বৃত্তের ওপর অনেকগুলো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কৃষ্ণ বিবরের জন্ম দিচ্ছে যার ফলে আইনস্টাইনের 
সাধারণ অপেক্ষবাদ ভেঙে পড়েছে। ঘটনা দিগন্তের বাইরে অবস্থিত কৃষ্ণ বিবরের এ ধরণের উপসর্গ বা"Nacked Singularity" খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কেননা বাইরে থেকে তা পর্যবেক্ষণ করা যাবে।
আমাদের সমাজে এমন কিছু লোক আছে যারা কিছু বোঝে না, কিন্তু নিজেকে খুব বড় বুদ্ধিমান মনে করে। যদি কেউ তাদের বোঝায় তাহলেও সে বুঝতে চায় না, আর অন্যদের ভুল প্রমাণ করতে চেষ্টা করেন। কিন্তু হকিং ছিলেন এমন একজন বিজ্ঞানী যিনি আমাদের সততার পথে নিয়ে গেছেন। তিনি শিখিয়েছেন যে কোনও দিন ভুল স্বীকার করতে দ্বিধা করতে নেই।

 

 

Comments :0

Login to leave a comment