Supreme court

প্রশাসনিক ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ থাকবে দিল্লি সরকারের হাতে

জাতীয়

কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে লড়াইয়ে বড় জয় পেল দিল্লির কেজরিওয়াল সরকার। বৃহস্পতিবার সুপ্রিম কোর্ট এক রায়ে জানিয়ে দিয়েছে, সমস্ত ধরনের প্রশাসনিক ক্ষমতার ওপর নিয়ন্ত্রণ থাকবে দিল্লি সরকারেরই। জমি, পুলিশ এবং জন নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছাড়া বাকি সমস্ত প্রশাসনিক কাজে শেষ কথা বলবে দিল্লি সরকার। একই সঙ্গে লেফটেন্যান্ট গভর্নরকে দিল্লি সরকারের সমস্ত সিদ্ধান্ত মেনে চলতে হবে। বৃহস্পতিবার প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়ের নেতৃত্বাধীন সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ সদস্যের সাংবিধানিক বেঞ্চ সর্বসম্মতভাবে এই রায় দিয়েছে। বস্তুত, বেশ কয়েকটি গুরুতর বিষয় নিয়ে কেন্দ্র-দিল্লি সরকারের ৮ বছরের দ্বৈরথের নিষ্পত্তিও ঘটল এদিনের রায়ে। 
সুপ্রিম কোর্টের রায়কে স্বাভাবিকভাবেই স্বাগত জানিয়েছে আপ। পরিষেবা নিয়ে দু’পক্ষের এই টানাপোড়েনে সুপ্রিম কোর্টের রায়কে বড় জয় বলেই মনে করছে অরবিন্দ কেজরিওয়ালের দল। তারা মনে করছে, এটা গণতন্ত্রের জয়। রাজ্যে রাজ্যে নির্বাচিত সরকারকে ফেলে দেওয়ার কৌশলের ক্ষেত্রে ‘বিরাশি সিক্কার থাপ্পড়’ বলেও মনে করছে আপ। এদিন দলের তরফে এক টুইটে বলা হয়েছে, ‘সরকারি অফিসারদের বদলি কিংবা পদে নিয়োগের সমস্ত ক্ষমতাই থাকা উচিত নির্বাচিত সরকারের। সেই নির্বাচিত সরকারের হয়েই কাজ করবেন অফিসারররা। সেই অফিসারদের দিল্লিবাসীর হয়ে কাজ করা বন্ধ করে দিতে পারেন না লেফটেন্যান্ট গভর্নর।’ সুপ্রিম কোর্টের রায়ে প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল বলেছেন, ‘‘এবার দিল্লির উন্নয়নমূলক কাজের গতি কয়েক গুণ বেড়ে যাবে।’ তিনি সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের প্রতি আন্তরিক অভিনন্দন জানিয়ে বলেছেন, ‘ওঁরা দিল্লিবাসীদের স্বার্থে ন্যায়বিচার করলেন’। এতদিন উন্নয়নমূলক বহু কাজ এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর যে হাত-পা বাঁধা ছিল এবং সুপ্রিম কোর্টের এদিনের রায়ের পর এবার খোলামনে এগিয়ে যেতে পারবেন, সেকথাও জানিয়েছেন কেজরিওয়াল। তিনি বলেন, ‘এতদিন যেসমস্ত অফিসাররা কাজে বাগড়া দিচ্ছিলেন তাঁরা এবার অচিরেই বুঝতে পারবেন।’
সুপ্রিম কোর্টের রায় এবং ‘বাগড়া’ দেওয়া অফিসারদের প্রতি কেজরিওয়ালের কড়া মনোভাব জানানোর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সরিয়ে দেওয়া হলো এক আমলাকে। দিল্লি সরকারের পরিষেবা দপ্তরের সচিব আশিস মোরেকে এদিন সরিয়ে দেওয়া হয়।
শীর্ষ আদালতের এই রায়ের প্রভাব সুদূরপ্রসারী বলেই মনে করা হচ্ছে। অন্যান্য কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের সঙ্গে ন্যাশনাল ক্যাপিটাল টেরিটরি (এনসিটি) প্রশাসনের পার্থক্যও অনেকটা সুস্পষ্ট হয়ে গেল এদিনের রায়ে। সুপ্রিম কোর্ট বলেছে, দিল্লি বিধানসভা এবং নির্বাচিত সরকারের প্রশাসনিক সিদ্ধান্তে হস্তক্ষেপ করার কোনও ক্ষমতাই নেই লেফটেন্যান্ট গভর্নরের। অন্যান্য সরকারের মতোই সম মর্যাদাসম্পন্ন দিল্লির সরকার। শীর্ষ আদালত স্পষ্ট জানিয়ে দেয়, ‘গণতান্ত্রিক কাঠামোয় প্রকৃত প্রশাসনিক ক্ষমতা অবশ্যই নির্বাচিত সরকারের হাতেই থাকা উচিত। এই প্রশ্নে লেফটেন্যান্ট গভর্নরকে দিল্লি সরকারের পরামর্শ মেনেই চলতে হবে। বস্তুত, প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচূড়, বিচারপতি এম আর শাহ, কৃষ্ণ মুরারি, হিমা কোহলি এবং পি এস নরসিমাকে নিয়ে গঠিত সাংবিধানিক বেঞ্চ ২০১৯ সালে এই মামলার খণ্ডিত রায়ে বিচারপতি অশোক ভূষণের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে সহমত পোষণ করেনি। সেখানে বিচারপতি ভূষণ বলেছিলেন যে, পরিষেবার বিষয়টি দিল্লি সরকারের এক্তিয়ারের বাইরে। 
ভারতের কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল, দিল্লির শাসন ব্যবস্থা কার হাতে থাকবে এনিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরেই সংঘাত চলছিল। কেন্দ্রীয় সরকার এনসিটি আইন পরিবর্তন করায় প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয় কেজরিওয়াল সরকার। দুই সরকারের সীমারেখা বা এক্তিয়ার কী হবে, তার ব্যাখ্যা চেয়ে আপ সরকার আবেদন করে শীর্ষ আদালতে। গত জানুয়ারিতে চার দিন এই মামলার সওয়াল শোনার পর রায়দান স্থগিত রাখে সাংবিধানিক বেঞ্চ। এদিন সেই রায় ঘোষণা হলো এবং সেই রায় গেল দিল্লির আপ সরকারের পক্ষেই।
দিল্লির নির্বাচিত সরকারের হাতে কেন প্রশাসনিক ক্ষমতা থাকবে তার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে পাঁচ সদস্যের সাংবিধানিক বেঞ্চ বলেছে, ‘জনগণের ইচ্ছার প্রতিনিধিত্ব করার জন্যই দিল্লি বিধানসভাকে আইন প্রণয়নের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এদিন রায় ঘোষণা করতে গিয়ে প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচূড় বলেছেন, ‘‘সরকারি অফিসাররা যদি মন্ত্রীদের কাছে রিপোর্ট করা বন্ধ করে দেন, তাঁদের নির্দেশ অমান্য করেন তাহলে সামগ্রিকভাবে যৌথ দায়বদ্ধতার নীতিই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’’ তিনি আরও বলেছেন, ‘‘গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারকে যদি তার অফিসারদের নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা না দেওয়া হয় এবং তাঁদের জবাবদিহি করতে না দেওয়া হয়, তবে দায়বদ্ধতার ত্রিমাত্রিক নীতি অনাবশ্যক হয়ে যায়। বস্তুত, বিধানসভা ও জনগণের প্রতি সরকারের দায়বদ্ধতা কমে যায়।’’ এপ্রসঙ্গে এদিন সাংবিধানিক বেঞ্চ সরকারি আধিকারিকদের দায়বদ্ধতার বিষয়টিও জানিয়ে দিয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট বলেছে, সরকারি আধিকারিকদের ‘রাজনৈতিকভাবে নিরপেক্ষতা’ বজায় রাখতে হবে। মন্ত্রীদের প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণে থেকে নির্বাচিত সরকারের প্রতিদিনের সিদ্ধান্ত রূপায়ণ করাই তাঁদের কাজ।
লেফটেন্যান্ট গভর্নর প্রশাসনিক কাজে হস্তক্ষেপ করতে না পারলেও সুপ্রিম কোর্টের সাংবিধানিক বেঞ্চ এও বলেছে যে, ওই পদ থেকে তিনি মুখ্যমন্ত্রী এবং মন্ত্রীসভার সদস্যদের পরামর্শ দিতে পারবেন।
উল্লেখ্য, সম্প্রতি দিল্লির আবগারি নীতি সহ একাধিক বিষয়ে লেফটেন্যান্ট গভর্নর ভি কে সাক্সেনা প্রশাসনিক কাজে হস্তক্ষেপ করছেন বলে অভিযোগ ওঠে। কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের নির্দেশেই তিনি কাজ করছেন বলে অভিযোগ করেন মুখ্যমন্ত্রী কেজিওয়াল। সাংবিধানিক বেঞ্চের এই রায়ের ফলে প্রশাসনের উপর দিল্লির আপ সরকারে নিয়ন্ত্রণ অনেকটা বাড়ল বলে মনে করা হচ্ছে।
এদিকে, সুপ্রিম কোর্টের রায়কে সম্মান জানালেও দিল্লির নির্বাচিত সরকারকে খোঁচা মারতেও ছাড়েনি বিজেপি। ওই দলের তরফে বলা হয়েছে, দিল্লির নির্বাচিত সরকারের ক্ষেত্রে প্রশাসনিক ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে যেমন ঠিক তেমনই বদলি এবং কর্মী নিয়োগের রাজনীতিও ফিরে আসবে। বিজেপি’র আশঙ্কা, এবার ব্যাপাক হারে অফিসার বদলি শুরু হবে। সিপিআই(এম) দিল্লি রাজ্য কমিটি অবশ্য সুপ্রিম কোর্টের রায়কে স্বাগত জানিয়ে বলেছে যে, এটা কেন্দ্রের সরকারকে বড় ধরনের থাপ্পড় যারা লেফটেন্যান্ট গভর্নরকে দিয়ে দিল্লির মানুষের ওপর খবরদারি চালাতে চায়।

Comments :0

Login to leave a comment