বই — মুক্তধারা
রাষ্ট্রীয় অপশাসনের বিরুদ্ধে উচ্চকিত স্লোগান
সৌরভ দত্ত
২৩ সেপ্টম্বর ২০২৫, বর্ষ ৩
জনপ্রিয় কমরেড সরোজ দত্ত ছিলেন একজন ভারতীয় কমিউনিস্ট বুদ্ধিজীবী এবং কবি।যিনি ৬০ এর দশকে বাংলার নকশালবাড়ি আন্দোলনে উল্লেখযোগ্য সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিলেন। কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী-লেলিনবাদী) সিপিআই(এম এল) এর পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির প্রথম সম্পাদক ছিলেন।১৯৪০ এর দশকে অমৃতবাজার পত্রিকার প্রধান সম্পাদক ও ছিলেন।১৯৭১ এর উত্তাল নকশালবাড়ি আন্দোলনের সময় পুলিশ এনকাউন্টারে তিনি নিহত হন। বন্ধু দেবপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের বাড়ি থেকে ৪-৫ আগস্ট রাতে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে।এবং কলকাতা ময়দানের এরিয়ান ক্লাব মাঠে পুলিশ তাকে নৃশংস ভাবে এনকাউন্টারে হত্যা করে।ভোরে মর্নিং ওয়াকরত অবস্থায় মহানায়ক উত্তম কুমার গুলির আওয়াজ শুনে ঘটনাটি প্রত্যক্ষ করেন।যা উনি অনেক পরে প্রতিক্রিয়ায় জানিয়েছেন। চলচিত্র সোপান ও দিব্যেন্দু পালিতের সহযোদ্ধা উপন্যাসে ঘটনাটির ছায়া রয়েছে। সম্প্রতি শহীদ সরোজ দত্ত স্মৃতি রক্ষা কমিটি প্রকাশ করেছে বিপ্লবী কবি সরোজ দত্ত’র কবিতা সংগ্রহ।যা তাঁর প্রতিবাদী সত্তার এক দলিল।কবি অরুণ মিত্র এ গ্রন্থের ভূমিকায় জানিয়েছেন–“তাঁর কাব্য রচনাই আমাদের জানিয়ে দেয় যে,তাঁর মননে এবং সৃজনে কোনো শৈথিল্যের প্রশ্রয় নেই, চিন্তা ও অনুভূতি সুসম্পন্ন, প্রকাশও সুসম্বন্ধ।”চতুর্থ সংস্করণের ভূমিকাংশে প্রকাশনা সংস্থাটি জানিয়েছে–“১৯৭৭ সালের অক্টোবর মাসে, সরোজ দত্ত তখন ও এক গোপন চর্চার বিষয়, অনুবাদ কবিতা সহ মাত্র ১৭টি কবিতা নিয়ে কবির পারিবারিক সহায়তায় প্রকাশিত হল সরোজ দত্ত’র প্রথম কবিতা সংকলন:‘ঘৃণা ও ক্রোধের ’কবিতা।” প্রকাশনা সংস্থা আরো বলেছে যে–“নামে-বেনামে-ছদ্মনামে তাঁর আরও অনেক কবিতা বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ছড়িয়ে আছে;”। সরোজ দত্ত’র কবিতা সংগ্রহ–মৌলিক কবিতা, অনুবাদ কবিতা, চূর্ণ কবিতা,অল্প বয়সের কবিতা এরকম চারটি পর্বে বিন্যস্ত।প্রতিটি পর্বে ভিন্ন ভিন্ন বীক্ষণ ও দ্রোহে জারিত হয়েছে কবিতাগুলি।‘রম্যাঁ রল্যাঁ’ নামক শীর্ষক প্রথম কবিতায় মহাসমর প্রেক্ষিতে তিনি লিখেছেন–“মৃত্যুর দুঃস্বপ্ন হতে জাগিয়া প্রাণের পুরোভাগে,/সোনার কুঠার ফেলি’ ধরিয়াছে লোহার লেখনী।”প্রতিবাদের প্রদীপ্ত স্বরায়ণ ঋদ্ধ করেছে কবিতাটিকে।‘অসি ও মসী’ কবিতাংশে ফুটে ওঠে–“গাণ্ডীব র’বে না আর/রাজকন্যা উত্তরার/ক্লীব-সখী বৃহন্নলা-বেশে।” এ কবিতাতেও মৃত্যুময়তা ও অন্ধকার মহাভারতীয় পর্বের মতো অস্থির সময়ের চলচ্ছবি রয়েছে।‘বর্তমান বুদ্ধিজীবীর প্রতি’ কবিতার গভীরে–“প্রাণশক্তি প্রাণহীন, ধরিয়াছ প্রাণঘাতী নেশা;/চরণে কাঁদিছে কায়া,ছায়া ভাবি হাসো উপহাসে–/করেছ গতির রক্তে পঙ্গুয়ার প্রশস্তি রচনা,/বিচ্ছেদ ভুলিতে চাহ বিরহের নির্বীর্য বিলাসে।” ‘ডি এইচ লরেন্স ’ নামাঙ্কিত কবিতার কবি জীবনযন্ত্রণার কথা তুলে ধরেছেন–“তবুও চিতার পোড়া কয়লার লাগে/নূতন পৃথিবী চুম্বিবে অনুরাগে।”‘কোনো বিপ্লবী কবির মর্মকথা’ কবিতাটি যেন কবির আত্মভাষ্য–“আমার পাবে না দেখা আমার কাব্যের পৃষ্ঠপটে,/যেথায় আমার সীমা অসংখ্যের অসীমে বিলীন,”।মহামতি লেনিন স্মরণে ‘লেনিন’ নামক কবিতাটিতে কবি বলেছেন–“মরণে মেলেনি ছুটি, মৃত্যু তার হল অর্থহীন,--/মরিয়া জীবন্ত হাতে আজো সে গড়িছে ইতিহাস,”। অনুবাদ কবিতা পর্বের দ্বিতীয় কবিতাটি হল–‘অক্টোবর:১৯১৭’ ।সেখানে তিনি ভ্লাদিমির মায়াকোভস্কির কবিতার অনুবাদে লিখেছেন–“কার পতাকার আছে এত গাঢ় লাল?/কে পারে বিঁধিতে বুলেটে মোদের প্রাণ?/নেই আমাদের রাইফেল,নেই সেনা;/কী বা আসে যায়?কন্ঠে রয়েছে গান।” এ গান উজ্জীবনের গান, বিপ্লবের মুখরিত সংগীত।যা কবি সরোজ দত্ত’র কবিতাগুলিকে আচ্ছন্ন করেছে। রাষ্ট্রীয় শক্তির বিরুদ্ধে সর্বদা গর্জে উঠেছে তাঁর কলম–“রাষ্ট্রের শক্তি, রাষ্ট্রের প্রভুত্ব/প্রহরীর মত দাঁড়িয়ে আছে তোমার স্বার্থ রক্ষায়।”
গ্রন্থ নাম–সরোজ দত্ত’র কবিতা সংগ্রহ
প্রকাশনা–শহীদ সরোজ দত্ত স্মৃতিরক্ষা কমিটি
প্রচ্ছদ শিল্পী–অমিতাভ মল্লিক
অলংকরণ–সন্দীপ মল্লিক
Comments :0