এক সপ্তাহ পার হলেও কার্যত ভেঙে পড়া বিমান পরিবহণ পরিষেবার অচলাবস্থা এখনও পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি। যাদের জন্য এই অচলাবস্থা সেই বেসরকারি বিমান সংস্থা ইন্ডিগোর পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে স্বাভাবিক হতে আরও দু’-একদিন সময় লাগবে। স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে বিশেষ করে দেশে উদারনীতি চালু হবার পর সর্বত্র বেসরকারি পুঁজির দাপটের মধ্যে এমন বিপর্যয় এটাই প্রথম। তাছাড়া এবারের বিপর্যয় অধিক তাৎপর্যপূর্ণ এই কারণে যে এটা কোনও যান্ত্রিক বা প্রযুক্তিগত দুর্ঘটনা ছিল না। বিশেষ কোনও ব্যবসায়িক স্বার্থসিদ্ধির জন্য সচেতন প্রয়াস ছিল বলে নানা মহল থেকে গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। নির্দিষ্ট করেই আঙুল উঠছে দেশের বৃহত্তম বিমান সংস্থা ইন্ডিগোর দিকে। আর এই কাজে ইন্ডিগোকে পরোক্ষে সুযোগ করে দিয়েছে নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ ডিজিসিও। তাছাড়া এমন অবস্থা তৈরি হবে জেনেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এবং সরকার আগাম কোনও ব্যবস্থা নেয়নি। এমনকি অচলাবস্থা শুরুর পরও কয়েকদিন হাত গুটিয়ে বসেছিল সরকার।
বিশ্বাস করা কঠিন বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম বিমান পরিবহণ বাজারে এমন অচলাবস্থা অবলীলায় তৈরি হয়ে গেল। বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি হবার স্বপ্নে মশগুল কোনও সরকার এমন দায়িত্বজ্ঞানহীন হতে পারে! এমন অপদার্থতার পরও কোন লজ্জায় বিকশিত অর্থনীতির খোয়াব দেখে বলা মুশকিল। উড়ান বিপর্যয়ের যে বার্তা দুনিয়ার সামনে তুলে ধরেছে মোদী সরকার তারপর উন্নত ভারতের কথা উচ্চারণ করাও হাস্যকর মনে হবে।
এখন প্রশ্ন হলো এমন বিপর্যয় ঘটানোর সুযোগ কেন করে দেওয়া হলো? ভারতে বিমান পরিবহণ ব্যবস্থার দ্রুত বিকাশ এবং অল্প সময়ের মধ্যে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম বাজার হয়ে ওঠার জন্য মোদী সরকারের আত্মপ্রচারের অন্ত নেই। আসলে উদারনীতিতে বেসরকারিকরণের ঢালাও সুযোগে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠেছে বহু বেসরকারি উড়ান সংস্থা। আর্থিক সামর্থ্য, যোগ্যতার মাপকাঠি, নিরাপত্তার বিধি যথাসম্ভব শিথিল, যাকে তাকে এই ব্যবসায় নামার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি কম ভাড়ার নামে যাত্রী বাড়ানোর লক্ষ্যে নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিধি বেপরোয়া লঙ্ঘন হতে থাকে। মেয়াদ উত্তীর্ণ বিমান, যথাযথ মেরামতি, নিত্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়া বিশ্রাম না দিয়ে উড়তে থাকে। বিশ্রাম নেই পাইলট কর্মীদেরও। মোটা মুনাফার তাগিদে আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বিধিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে পাইলটদের বিশ্রাম ও রাতে ঘুমোনোর পর্যাপ্ত সুযোগ না দিয়ে বিমান চলে। যাত্রীদের নিরাপত্তা ছেড়ে দেওয়া হয় চরম ঝুঁকির দিকে।
এইভাবেই ভারতে প্রসারিত হয়েছে বিমান পরিষেবা। রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা এয়ার ইন্ডিয়া বিক্রি হয় টাটার কাছে। দেশের বিমান বন্দরগুলি একে একে তুলে দেওয়া হয় আদানিদের কাছে। অর্থাৎ যাত্রী বিমান পরিবহণ ব্যবস্থার পুরোটাই চলে যায় বেসরকারি পুঁজির অধীনে। সরকারের নিয়ন্ত্রণ বা হস্তক্ষেপের অধিকার কার্যত উঠে যায়। এইভাবে তৈরি হয় একচেটিয়া কারবার। শুধু ইন্ডিগোর হাতেই বাজারের ৬০ শতাংশ। টাটাদের ২৭ শতাংশ। ইন্ডিগো চাইলে যখন খুশি যা খুশি করতে পারে।
আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে সম্প্রতি পাইলটদের ডিউটি ও বিশ্রামের নতুন বিধি তৈরি হয়েছে। চালু হবার কথা ছিল এবছরের গোড়ায়। মোদীর দলকে মোটা টাকা চাঁদা দেওয়া ইন্ডিগো চাপ দিয়ে সেটা আটকে রাখে। কিন্তু কোর্টের রায়ে চালু হয় নভেম্বর থেকে। নতুন বিধিতে উড়ান স্বাভাবিক রাখতে নতুন পাইলট ও কর্মী নিয়োগ জরুরি ছিল। ইন্ডিগো সেটা ইচ্ছাকৃতভাবে করেনি। ফলে অনিবার্যভাবে বিপর্যয় ঘটেছে। সরকারকে ঠুঁটো বানিয়ে ইন্ডিগো নতুন বিধি স্থগিত করিয়েছে। বেসরকারি পুঁজির একচেটিয়া কারবারে এমনটাই হয়। জিয়ো, এয়ারটেল চাইলে যে কোনও সময় দেশের টেলিযোগাযোগ স্তব্ধ করে দিতে পারে।
Editorial
সাধু সাবধান হও
×
Comments :0