Editorial

ভূতের মুখে রামনাম

সম্পাদকীয় বিভাগ

লোকসভায় বিতর্কের সময় যাঁকে জিগরি দোস্তের মতো ‘বঙ্কিমদা’ বলে সম্বোধন করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সেই সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় জন্মেছিলেন ১৮৭ বছর আগে। বঙ্কিমচন্দ্র বন্দে মাতরম রচনা করেছেন ১৫০ বছর আগে। আর ১০০ বছর আগে ধর্মীয় বিভাজন ও সাম্প্রদায়িকতাকে ভিত্তি করে উগ্র ও অন্ধ হিন্দুত্ববাদী আরএসএস’র জন্ম হয়েছিল। এই আরএসএস’র মতাদর্শের গর্ভেই জন্ম হিন্দু মহাসভা, জনস্বাস্থ্য এবং আজকের বিজেপি। নরেন্দ্র মোদী তো কোন ছাড়, যাদের হাত ধরে তিনি হিন্দুত্ববাদী ঘৃণা ও বিদ্বেষের রাজনীতি শিখেছেন, তাঁর সেই পূর্বসূরিরা কখনো কোনোদিন ভুল করেও ‘বন্দে মাতরম’ শব্দটি উচ্চারণ করেছেন বলে শোনা যায়নি। কেন্দ্রে ১১ বছর সরকারে নেতৃত্ব দিয়ে মোদী নিজেও কোনোদিন বন্দে মাতরম গাওয়া তো দূরে থাক উচ্চারণও করেননি। আজ হঠাৎ বঙ্কিম রচিত বন্দে মাতরমের প্রতি তাঁর, তাঁর দলের এবং তাঁর সরকারের দরদ উথলে উঠেনছে। বন্দে মাতরমের প্রতি মোদীর হৃদয়ের আকুতি এতটাই মাত্রাতিরিক্ত যে খোদ রাজধানীর বুকে সরকারি উদ্যোগে সাড়ম্বরে বন্দে মাতরমের শতবর্ষ উদ্‌যাপন করে সেখানে জ্বালাময়ী ভাষণ দিয়েও তাঁর সাধ মেটেনি, অনতিবিলম্বে সংসদে দু’দিনব্যাপী আলোচনারও ব্যবস্থা করে ফেলেন। দেশজুড়ে বিমান পরিবহণ বিপর্যয়, ১১ বছরে ডলারের তুলনায় টাকার মূল্য ৬০ টাকা থেকে ৯০ টাকায় নেমে যাওয়া, রাজ্যে রাজ্যে সাধারণ মানুষের এসআইআর যন্ত্রণা, বন্ধু ট্রাম্পের গুঁতোয় বাণিজ্যে ভরাডুবি, লাগাতার ভারতের বাজার থেকে বিদেশি লগ্নি চলে যাওয়া ইত্যাদি হাজারো জরুরি বিষয় নিয়ে সংসদে দশ মিনিট আলোচনারও সময় জোটে না। সেখানে বন্দে মাতরম নিয়ে দু’দিন ধরে আলোচনার শুরুতে মোদী নিজেই এক ঘণ্টা বক্তৃতা দিয়ে ছিলেন। আর সেই বক্তৃতার ছত্রেছত্রে বাংলার ইতিহাস, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য সম্পর্কে নিজের অজ্ঞতা প্রমাণ করলেন। পদে পদে অসম্মানিত ও অপমান করলেন, খোদ বঙ্কিমচন্দ্র থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মাস্টারদা সূর্য সেন সহ অনেককে। হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িক রাজনীতির চুলায় বাতাস দিতে যথেচ্ছভাবে মিথ্যা, অর্ধসত্য, বিকৃত ইতিহাসকে মনের মাধুরী মিশিয়ে সাজিয়েছেন। আসলে যাদের গর্ব করে বলার মতো কোনও ইতিহাস নেই, ঐতিহ্য নেই তারা নিজেদের প্রাসঙ্গিক করতে মিথ্যা ও বিকৃতির আশ্রয় নেবেন সেটাই স্বাভাবিক।
যে আরএসএস কোনোদিন স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নেয়নি, তালেগোলে দু’-এক জন অংশ নিলেও পরে ভুল স্বীকার করে সরে এসেছেন। ব্রিটিশদের চর হিসাবে কাজ করেছে স্বাধীনতা সংম্রামীদের বিরুদ্ধে। যারা ব্রিটিশ শাসন-শোষণ, লুণ্ঠনকে ভারতের জন্য আশীর্বাদ মনে করত, স্বাধীন দেশের জন্য যাদের কোনও ত্যাগ নেই তারা আজ হঠাৎ স্বাধীন দেশের সেবা দেশপ্রেমীর মুখোশ ধারণ করেছে। যারা স্বাধীনতাকেই মর্যাদা দেয়নি, জাতীয় পতাকাকে অস্বীকার করেছে, জাতীয় সঙ্গীতকে মান্যতা দেয়নি, সংবিধানকে অবজ্ঞা করেছে তারা এখন দেশভক্তির জ্ঞান বিতরণ করছে। আসলে মোদীদের লক্ষ্য ক্ষমতার অপব্যবহার করে ইতিহাস বিকৃত করে কল্পনা ও মিথ্যার ভিতের উপর ধর্মান্ধ রাজনীতির ইমারত তৈরি করা। ভারতের মুক্তি সংগ্রামে অংশগ্রহণকারী লক্ষ লক্ষ মানুষের মুখে উচ্চারিত হতো বন্দে মাতরম, জয় হিন্দ, ইনকিলাব জিন্দাবাদ স্লোগান। মোদী ও তার পূর্বপুরুষরা এইসব স্লোগানের মর্মার্থ বোঝেননি। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার অন্ধকুপে তারা ঘুরপাক খেয়েছেন। তাই বন্দেমাতরম নিয়ে বাড়াবাড়ি করে তাদের হাসির খোরাক না হওয়াই ভালো।

Comments :0

Login to leave a comment